Thursday, June 14, 2018

৫০) আধ্যানের ডায়েরী - দ্বিতীয় জন্মদিন



সকাল থেকে দেখছি বাবা আর মা ছুটোছুটি করছে।  আমার নাকি জন্মদিন।  কালকে প্রচুর লোক আসবে।  প্রচুর খাওয়ানো হবে তাই প্রচুর রান্না বান্না।  মা বাবা তাই ব্যস্ত।  আমার দিকে মন নেই।  আচ্ছা ব্যাপারটা তো আমার।  জন্মদিনটা তো আমার, আর আমিই ইগনোর্ড।  অদ্ভুত ইনহিউম্যান না ব্যাপারটা ।  কোথায় আমাকে নিয়ে তোলা তোলা করে রাখবে , তা না , দু দিন ধরে শুধু আমাকে খ্যাঁচাতে লাগলো।  সারাদিন শুনতে লাগলাম, “এতে হাত দিসনা” , “ওখানে আসিস না” , “সেখানে জাবি না”।  আমি কি করি? 

আমি টিভি দেখি।  এই সুযোগে আমি সারাদিন টিভি দেখে নিলাম চাড্ডি।  সারাদিন বাবা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে বেড়িয়ে পরিষ্কার করে গেলো আর মা সারাদিন রান্নাঘরে রান্না করে কাটিয়ে দিলো।  পরের দিনও তাই।  কোনো পরিবর্তন নেই।  

বাবার দৌড় দেখে কষ্ট হলো।  ওই বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে থপ থপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর একজায়গায় জিনিস আরেক জায়গায় রাখছে।  আমি ভাবলাম হেল্প করে দিই। কিন্তু হেল্প করতে গিয়ে চোখে পড়লো জলের বোতল।  সবাই খাবে বলে বাবা জলের বোতল নিয়ে এসেছে প্রায় ফিফটি টা।  এগুলো আবার ছোট ছোট বোতল।  ব্যাস আমিও একটা একটা করে তুলে সাজিয়ে রাখতে লাগলাম টেবিলের ওপর।  একটা করে বার করছি আর বাবা একটা করে তুলে এনে অন্য জায়গায় রাখছে।  আরে সবাই তো টেবিল থেকেই তুলে নিয়ে খাবে।  আমি তো বুদ্ধিমানের কাজই করেছি।  কিন্তু না , অন্য জায়গায় আমার নাগালের বাইরে না তুলে রাখলে শান্তি নেই।  

এর পর বাবা আমার সব কিছু খেলনা তুলে তুলে রাখতে লাগলো।  মাও দেখি হাত লাগালো।  আমি হাত লাগাতেই হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো।  আমি ভাবলাম সেই পুরোনো সিস্টেম , জন্মদিনে কাজ করা যাবে না, সেই জন্যেই ভালোবেসে সরিয়ে দিচ্ছে।  কিন্তু না , ব্যাপারটা সেরকম না।  ব্যাপারটা হলো আমি নাকি আরো নোংরা করে ফেলছি তাই আমাকে হাত লাগাতে দেবে না।  

শেষে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারই হাতে তুলে নিলাম।  বাবা শুরু করেছিল , কিন্ত আমি জোর করে নিয়ে নিলাম।  বাবাও ছেড়ে দিলো।  আমি বেশ করে সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে পরিষ্কার করে ব্যাপারটা বাসযোগ্য করে তুললাম।  হাজার হোক , অনেক লোক তো আসবে।  প্রেস্টিজের একটা ব্যাপার আছে।  কিন্তু বাবা আমার কাজে ভরসা করে না আর মা বাবার কাজে।  তাই প্রথমে বাবা আমার হাত থেকে নিয়ে ভ্যাকুয়াম করলো।  আবার মা বাবার হাত থেকে নিয়ে বাকিটা করে দিলো।  বাবা ততক্ষন চলে গেছে রান্নাঘরে।  

বাবা যে কি করলো জানিনা রান্না ঘরে, সারা ঘর এক অদ্ভুত গন্ধে ভরে গেলো। আর আমার দু চোখ দিয়ে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগলো।  সে কান্না থামতেই চায়না।  যখন মায়ের ম্যাক্সিতে মুখ লুকোলাম তখন দেখি বাবা নিজেই এসে কাটা পিয়াঁজ দেখাতে লাগলো।  ও হরি , তাহলে এতক্ষন পিয়াঁজ কাটছিলো।  আমি ভাবলাম কত না কি। 

পিয়াঁজ কাটা হয়ে গেলে , বাবা আবার পরিষ্কার করতে চলে গেলো, আর মা রান্না ঘরে আর আমি টিভির সামনে।  কি ভয়ানক দিনটা গেলো।  সব কিছু এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলো।  বাবা মাঝে মাঝে বলে উঠতে লাগলো , জায়গা বার করতে হবে।  অনেক জায়গা বার করতে হবে।  আর আমার সমস্ত খেলনা গুলো একদম এক সাইডে পাঠাতে লাগলো।  আমার বইগুলো সব জায়গায় পরে থাকে, আমি যখন তখন একটা একটা করে তুলি , আর পড়ি।  কিছুটা পড়ি , আর যেটা পড়তে পারিনা সেটা খেয়ে নি।  কিন্তু একী , সবাই বই হাওয়া।  বাবা সবগুলো তুলে একটা বাক্স বন্দি করে ফেলেছে।  

সারাদিন চলে গেলো বাবা মার্ কাজ দেখে দেখে।  রাত তখন অনেক।  আমার খিচুড়ি খাওয়া হয়ে গেছে।  আমি খুব স্লীপি।  বিছানায় যাওয়ার আগে দুধলিনের খোঁজ করছি।  এমন সময় যেন ঘরে আগুন লাগলো।  আবার বাবা ছুটছে , মা ছুটছে একটা ছোট সাদা বাক্স খুলে গেলো।  বাক্সে দুটো গোল গোল কেক।  আমার কেক খেতে একটুও ভালো লাগে না।  তারওপর , তার ওপর দুটো ক্যান্ডেল লাগিয়ে দিলো।  বাবার হাতে একটা ফোন তাতে ঠাম্মা এসে গেলো, মায়ের হাতে একটা ফোন সেটাতে দিদা এসে গেলো।  এবার বাবার হাতে দুটো ফোন আমার দিকে তাক করে বসে আছে।  মা আমাকে কোলে নিয়ে শুরু করে দিলো , “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। ” সবাই সাথে চিৎকার করতে আরম্ভ করলো।  আমিও দু চারবার বললাম , “হ্যাপি” . ওর বেশি বেরোলো না।  মা একটু কেক কেটে আমার মুখে দিলো।  আমি থু থু করে ফেলে দিতে দেখি বাবা ঝাঁপিয়ে পড়েছে।  ফোন টোন ফেলে অর্ধেক কেক আমার মুখে দিলো মাখিয়ে।  কি রগড় রে বাবা।  তার ওপর আবার ছবি তোলার ঢং।  

আমার ঠিক আজ থেকে এক বছর আগের কথা মনে পরে গেলো।  যখন বাবা ছিল না আমার কাছে।  মা আর দাদু ঠিক এই ভাবে জন্মদিন করেছিল।  আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।  খুব করে চেয়েছিলাম বাবা চলে আসুক।  কিন্তু তখন আসে নি।  আসতে পারেনি।  আজ যখন বাবা আছে , তখন করে নিক যত আনন্দ চায়।  

বাবা কিন্তু চুটিয়ে আনন্দ করেছে আমার জন্মদিনে। চুটিয়ে খেটেছে , আর চুটিয়ে মজা করেছে।  শুধু আমাকে পাত্তা দেয়নি।  পরেরদিন সকালে আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই কিসব কাবাব টাবাব বানাতে বসে গেছিলো।  বাইরে ব্যালকনিতে একটা কালো জায়গার ওপর কি সুন্দর গোল গোল করে জিনিস বানাচ্ছিল।  আমি যতবার কাছে যেতে যাচ্ছি , আমাকে ঘাড় ধরে সরিয়ে দিচ্ছে , “খুব গরম ” বলে।  আমি আর কি করি , মায়ের পেছনে  পেছনে ঘুর ঘুর করছি।  কিন্ত ঘুর ঘুর করে তো লাভ নেই।  মা তখন চারটে কড়াইতে কি কি সব করছে।  আর সারা ঘরে একটা গুমোট গন্ধ।  

এইসময় একে একে সবাই ফোন করলো।  বাবা বাইরে ছিল , তাই মা আর আমিই বসে বসে কথা বললাম।  সবাই হ্যাপি হ্যাপি করছিলো।  আমিও করছিলাম।  এদিকে বেলা অনেক বেড়ে গেছে , খুব খিদে পেয়ে গেছে।  অথচ , খাবার দেওয়ার নাম নেই।  কোনো খাবার নেই।  এদিকে মা বাবা দুজনেই কিছু না কিছু রান্না করে যাচ্ছে।  কখনো গ্যাসের কাছে কিছু করছে , কখনো মাইক্রোওয়েভে কিছু করছে।  আর এদিকে আমার পেট চুঁ চুঁ করছে।  

যখন বিরক্তি তুঙ্গে উঠে গেছে  তখন   বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বসলো টেবিলে।  দেখি অনেক খাবার।  অনেক অনেক খাবার।  কিন্তু আমার খিচুড়ি কৈ।  আমার তো মাথা গেলো গরম হয়ে।  আমার জন্মদিন আর আমার জন্য খিচুড়ি বানানো নেই।  রেড , ইয়ালো , পিঙ্ক , পার্পল কত কিছু আছে খাবারে।  অথচ খিচুড়ি নেই।  বাবা আবার প্রথমেই একটা চামচে করে সাদা কিছু একটা মুখে তুলে দিলো।  ইশশ মিষ্টি পায়েস।  ধুর ধুর।  আমি একটা আলুভাজা তুলে মুখে দিলাম , কিন্তু খিদের চোটে বুক ফেটে কান্না চলে এলো।  তখন সেই খাওয়া ছেড়ে আমাকে ফাইনালি আমার খিচুড়ি দেওয়া হলো।  জন্মদিনে কি কেউ এই ভাবে না খাইয়ে রাখে।  

বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি সোফার একদিকে মা , একদিকে বাবা , হাত পা ছেড়ে পরে আছে।  আমি অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম , ঘুম ভেঙে যেই এই ঘরে এসেছি , দুজনেই তিড়িং করে লাফিয়ে পরে আমাকে ধরে আপেল সস খাইয়ে দিলো।  খাইয়েই স্নান করিয়ে দিলো।  আমিও ভ্যা ভ্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওরা যা বলছিলো তা করে গেলাম।  এরপর এলো আমার জন্মদিনের ড্রেস।  এ ধরণের ড্রেস আমি কোনোদিন পড়িনি।  পাঞ্জাবি আমি আগেও পড়েছি।  কিন্ত ধুতি ইস টু ফানি।  হেব্বি মজাদার একটা ব্যাপার।  বেশ হাওয়া পাস করছিলো।  কিন্তু অসুবিধার বিষয় হলো বেশ লটপট করছিলাম।  তার ওপর কোমর গেছে নেমে , একটু পেট টেনে ধরলেই সড়াৎ করে নেমে যাচ্ছিলো ধুতিটা।  মা শেষ মেশ ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দিলো।  আমার ধুতিটাও একটা দড়ি আছে, সেটা ধরে , টেনে পেটের সাথে এমন চেপে দিলো যে আর খুললো না।  

কিছুক্ষন পরেই দেখি সবাই এসে গেলো।  সবাই মানে অনেকে।  আমার সব বন্ধু বান্ধব আর মা বাবার সব বন্ধুরা। সবাই আমাকে হ্যাপি হ্যাপি করে গেলো আর আমিও সবার সাথে হ্যাপি হ্যাপি করে দিলাম।  কিন্তু এবার একটা ভয়ানক জিনিস হলো।  একটা বি-শা-আ-আ-আ-ল বড় কেক বেরোলো একটা বি-শা-আ-আ-আ-ল বড় বাক্স থেকে।  আমার আজকাল চকোলেট খেতে ভালো লাগে বলে , কালকেও চকোলেট কেক ছিল , আজকেও।  কিন্ত এতো বড় কেক নিয়ে আমি কি করব।  আর আমি জানতাম যে আমার মুখেই প্রথম ঠোসার প্ল্যান আছে এদের।  দিলোও তাই।  আর আমিও অভ্যাসমতো মুখটা মুছে নিলাম আমার পাঞ্জাবি তে।  আমার তখন মন পরে আছে ভুজিয়ার দিকে।  সবাই আমাকে ছেড়ে নিজেদের খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে আমি আমার ভুজিয়া নিয়ে বসলাম। 

রাতে সবাই যখন চলে গেলো , তখন মা আমাকে গিফট গুলো দেখালো।  কত্ত গাড়ি।  ছোট থেকে বড় থেকে মাঝারি।  আর প্রচুর প্রচুর জামা কাপড়।  একজন তো একাই পঞ্চাশটা গাড়ি দিয়েছে।  কিন্তু বাবাটা কিছুতেই খুলতে দিলো না।  বললো , আরেকটু বড় হোক। 

আর কত বড় হবো।  দেখতে দেখতে দু বছর পেরিয়ে গেলাম। গত বছরের ভয়ঙ্কর সময় গুলো এ বছর নেই।  আমি এখন হাঁটতে না দৌড়াতে পারি , বাবা মার ভাষায় কত শব্দ বলতে পারি, এখন আমি নিজে নিজেও অনেক কিছু খেতে পারি , কাঁটা চামচ দিয়ে মা কে খাওয়াতে পারি , বলতে পারি আমি স্লীপি , মা কে জড়িয়ে ধরে হামি খেতে পারি , আর পারি লুকোচুরি খেলতে , দোলনায় দুলতে।  আমি আর এখন প্যারোট ক্লাসে থাকবো না , আমার ট্রান্সিশশান হবে ফ্লেমিংগো তে।  আমি অনেক অনেক বড় হয়ে গেছি।  সারাটা বছর ধরে আমার প্রচুর শেখা হয়েছে।  আরো শেখা বাকি , আরো কত কথা বলার আছে, আরোও কত কিছু এডভেঞ্চার আমার সামনে আছে।  এখন শুধু শুরু। …………. 

আধ্যানের ডায়েরি



No comments:

Post a Comment