হেঁ হেঁ ,
হেঁ হেঁ রবি ঠাকুর। তাইতো তাইতো।
লিখতে তো হবে রবি ঠাকুর নিয়ে। তাও আবার
আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ। আমি আবার রবীন্দ্রবিরোধী। পার্লামেন্ট এ বামপক্ষ না থাকলে খেলা জমবে কি করে।
সবাই হাতে কাদা , পচা টমেটো , নিজের না হলেও অন্যের বিষ্ঠা নিয়ে পড়তে আরম্ভ
করো।
আমার জীবনে
রবীন্দ্রনাথ বাংলার আর দশটা লোকের থেকে খুব একটা বেশি বা কম জড়িয়ে নেই। কুমোর পাড়ার গরুর গাড়িতে কে না চড়েছে। জোর করে নাকে মুখে ঠুসে রবীন্দ্রনাথ নামক আলুভাতে
সবার পাতেই কম বেশি পড়েছে। যখন থেকে বোঝার
ক্ষমতা হলো তবে থেকে দেখছি বাড়ির শোকেসে বিশাল রবীন্দ্র রচনাবলী। কেউ পড়েনা।
পড়লেও পুরোটা পড়া কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি , কিন্তু কথায় কথায় , "ভালো
মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে " ঝাড়তে কেউ ছাড়ে না। বিশেষত রেজাল্ট বেরোনোর আগে।
প্রতি বছর
বাংলা পরীক্ষা এক জীবনযন্ত্রণার সূত্রপাত ঘটাতো।
বাংলা বলতে ভালো লাগে , শুনতে ভালো লাগে কিন্তু লিখতে , ইশশশ । লোকে বড় হওয়ার
অপেক্ষা করে স্বাধীনতা, পয়সা আর প্রেয়সীর জন্য । আমি অপেক্ষা করতাম , কবে বড় হব আর
বাংলা পরীক্ষা দিতে হবে না । ওই সমচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দযুগলের অর্থপার্থক্য নির্ণয়
আমার রাতে ঘুমের মধ্যে এসে চিমটি কাটত। আর ছিল রচনা বউদির ডিমান্ড । ওয়ার্ড লিমিট আরেক
হুল । জ্ঞানীরা চাইতো আরো বেশি বেশি শব্দ। আর আমি চাইতাম যত কম হোক। আমার দ্বারা ভাব সম্প্রসারণ হতো না, হতো সংকোচন। তাই সাহিত্য বলতে রহস্য রোমাঞ্চ সেই বয়সে অতিরিক্ত
প্রিয় ছিল। হঠাৎ করে পরীক্ষার আগে এক হাওয়া
এলো যে, রচনায় যদি কোটেশন দেওয়া যায় তাতে নাকি নম্বর বেশি পাওয়া যায়। আমার আবার মুখস্থ করতেও গায়ে জ্বর আসতো। কোনো ভাবে মুখস্থ করে নিলেও সেটা ভাবের প্যান্ট
পরিয়ে ঠিক জায়গায় চেন বসিয়ে টানা আমার কাছে ভবিষ্যতের মতো - অন্ধকার। কিন্তু এই সময় শরীরে কিছু ঢেউ খেলার কারণে মাঝে
মাঝে ছন্দ মিলিয়ে দু চারটে কবিতাও লিখে ফেলেছিলাম। মাথায় এলো ফন্দি। পরীক্ষার খাতায় ফটাফট দুটো লাইন ঝেড়ে দিয়ে নিচে
লিখে দিতাম রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। এটুকু কনফিডেন্স
ছিল যে কেউ রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কবিতা পড়েনি, আর পড়ে থাকলেও মুখস্ত রাখা ইম্পসিবল।
রেজাল্ট বেরোনোর পর খাতা দেখার দিন রবীন্দ্রনাথকে যে কি ভাবে থ্যাংকু বলেছি সে আর এখানে
লিখছি না।
এরপর ধীরে
ধীরে শরীরে ও মনে হাজার হাজার পরিবর্তন এলো।
যে কোনো মেয়েকে দেখে ভালো লাগতে শুরু করলো। সব কিছুই ছন্দময়। প্রচুর কবিতা লিখতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু কবিগুরুর কবিতা যেই পড়তে আরম্ভ করলাম আমার
বমি পেতে আরম্ভ করলো। এই গুলো কবিতা বলে ?
কি স্লো , কি বেকার। এর থেকে রগরগে নজরুল আর বাংলা ব্যান্ড তো অনেক ভালো। সেই বয়সটা এমন থাকে , যে লোকের ন্যাকামো সহ্য হয়
না। আর আমারও তখন রবীন্দ্রনাথের ওই ন্যাকা
ন্যাকা কবিতা গুলো ভালো লাগতো না। বীররস বা স্বাধীনতা সম্বন্ধীয় কবিতাগুলো মন কাড়তো বটে , কিন্তু
সে আর কটা।
বন্ধুরা তখন
প্রেমে চুপচুপে। সবাই শেষের কবিতা শেষ করছে। আমি পড়ে তো থ।
উপনাস্যেও নেকিয়েছে ? অমিত আর লাবন্যর
মতো বেকার নাম আমি কিছুতেই ক্যারেক্টার হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। তার ওপর যে ডায়লগের গভীরতা। এতো গভীরে ঢুকতে হতো যে আমি বললাম "থাক"
. কবিগুরুর কবিতা ও উপন্যাস দুটো থেকেই আমি চোখ তুলে নিলাম। বাবা তখন আমার ঠুলি ঠিক করতে ব্যস্ত। ছেলে রবীন্দ্রনাথ না শিখলে আর কি শিখবে। তার থেকে গলায় দড়ি দিক। বাড়িতে তখন নতুন টেপরেকর্ডার
এলো। বাবাই নিয়ে এলো। সাথে দুটো ক্যাসেট নচিকেতা আর কি একটা আলবাল রবীন্দ্র
সংগীতের ক্যাসেট।
এরপর শুরু
হলো অত্যাচার। বাবা রোজ অফিস থেকে ফিরে রবীন্দ্র
সংগীত চালিয়ে দিতো। লক্ষ করলাম বাবা আর আমাকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু বলছে না। বাড়িতে ধীরে ধীরে ক্যাসেটের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। যেহেতু বাবার পয়সা বেশি , তাই রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট
বেশি আসতে লাগলো। আমার এই রবীন্দ্র সংগীতে এতো এলার্জি ছিল সে আর
কি বলবো। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আর শুনে আসছি
সমস্ত জলসাতেই কেউ না কেউ মাইক ধরে কুকুরের কান্না গাইবে। আর সেটাই লোকে বলবে দারুন। আমি নাম নিতে চাইনা , লোকেদের মনে দুঃখ লাগবে, কিন্তু
নামকরা সব রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েরা সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথের গানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
আমার কিছুতেই
ভালো লাগতো না। কিন্তু বাবার ওপর চ্যাঁচানো
যেত না। কারণ আমি যখন ঢিনচ্যাক গান চালাতাম
তখন বাবা কিছু বলতো না। এ আমাদের মধ্যে চুপচাপ
চিৎকার ছিল। একদিন রাতে আমি এক বান্ধবীর প্রেমে
পরে গেলাম, ধড়াম করে। পরেরদিন সকালে বাবা নতুন
একটা ক্যাসেট এনে চালালো আর তাতে বেজে উঠলো শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ভালোবাসি
ভালোবাসি" . কি সাংঘাতিক টান ছিলো গানটাতে।
মনের কথা উগলে উঠছিলো। আমি মাথার পেছনে
হাত রেখে সেই যে রবীন্দ্রসংগীত শুরু করলাম।
আজও থামেনি। প্রতিটা সময়ে প্রতিটি সমস্যায়
কোনো না কোনো গান আমার কানের কাছে বেজেই গেছে।
রবীন্দ্রনাথ নাকি স্বয়ং বলে গেছিলেন যে সবাই তাঁর সব সৃষ্টি ভুলে গেলেও গান
অমর হয়ে থাকবে । আর এই অমরত্বে বাঁধ সেধেছিল স্বয়ং বিশ্বভারতী । কপিররাইট ওঠার সাথে
সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে বিকৃতি শুরু হয় ধীরে ধীরে তা কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়
। উৎকৃষ্ট বস্তু যখন সহজলভ্য হয় তখন প্রথমে জথেচ্ছ ব্যাবহার হয় । তারপর প্রকৃতির নিয়মে
সে আবার তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে । তখন
একের পর এক যুগোপযোগী বাদ্যযন্ত্রের সাথে আধুনিকতা মিশিয়ে চিরনবীন রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ
ব্যাপৃত হয় শিশু থেকে তারুণ্যে। সেই বন্যার
সময় আমি দেশত্যাগ করি।
বিদেশের মাটিতে
শুধু একটু বাংলা শোনার , পড়ার জন্য মন হু হু করতো। কিন্তু তখনও ইন্টারনেটে বাংলার প্রচলন নিতান্ত কম। অথচ জীবনে তখন পরিবর্তনের তোলপাড়।
নতুন বধূর গৃহপ্রবেশে "তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, একটুকু ছোয়া লাগে
সব কি মধুময় লাগতে থাকে সন্ধ্যার মেঘমালার সাথে ।
শুধু ভাবি , এমনি করে যায় যদি দিন যাকনা।
আমার তখন ফাগুন লেগেছে বনে বনে। ক্যালিফোর্নিয়ার
রাস্তায় তখন পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে , আমি বলছি ধীরে বউ উতল হাওয়া। সেকি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে , আনন্দ বসন্ত
সমাগমে।
কিন্তু সুন্দর
চিরস্থায়ী হয় না। খরবায়ু বেগে বইতে থাকে ,
আমরা দুজনে দুদিকে ছিটকে পড়ি। তবু কষে হাল
ধরে দীর্ঘদিন এই তরণী বয়ে চলি। মাঝে মাঝে যখন
হাঁফ ছেড়ে সব ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে , তখন একলা চলার গান এসে পেছনে এক লাথি মেরে বলে
টুকরো করে কাছি পালে হাওয়া লাগা। মন তখন মেঘের
সঙ্গী, উড়ে চলে দিক দিগন্তের পারে। ঝগড়ার মাঝে
অসহায় পুরুষ কেঁদে উঠে বলে ভালোবাসা সেকি শুধুই যাতনাময়। একাকিত্বের দোলায় দুলতে দুলতে সেদিন দুজনের দোলার
কথা মনে আসে।
লিখতে লিখতে
রাত ভোর হয়ে যাবে , তবু শেষ হবে না একের পর এক রবীন্দ্রসংগীতের প্রভাব আমার জীবনে।
কি বিচিত্র সেই সৃষ্টি , কি বিচিত্র শব্দের খেলা, কি বিচিত্র সুরের সমাগম। না , ঢং করে সেই প্রাণের কবি , মনের কবি বলতে পারবো
না। কিন্তু জীবনের প্রত্যেক পদে পদে তার ছোঁয়া
যে আমার গায়ে লেগে আছে , সেটার অবমাননা করি কি করে।
যবে থেকে লেখা
শুধু করলাম তবে থেকে মনে একটা ভয় থাকতো। এই
কেউ এসে না বলে যে রবীন্দ্রনাথ টুকেছি। বাঙালির
আঁতেল সম্প্রদায়ের এই এক অদ্ভুত চুলকানি। আর এতেই আমি রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে পড়ি। রবীন্দ্রনাথ তার আশপাশের চরিত্র নিয়ে লিখেছে , আমিও
তো তাই। তিনি বিখ্যাত আমি অখ্যাত। যেমন পৃথিবীতে সাত জন এক রকম হতে পারে। তাহলে তাদের চরিত্র কেন এক হতে পারে না। আমার মতো হাজার হাজার লেখক কে গলাটিপে মেরেছে এই
রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষগুলো। যে রবীন্দ্রনাথ
মুক্তচিন্তা প্রচার করে গেছেন , তারই পাঠকরা বদ্ধ হয়ে কুক্ষিগত করে রেখেছে তাদের চিন্তাগুলোকে। কল্লোল
যুগের এই বিদ্রোহ আজও বর্তমান।
না , আমার
ভালো লাগেনি চোখের বালি , না ভালো লেগেছে শেষের কবিতা। অনেক চেষ্টা করেছি , আর এখনোও করে চলেছি। চব্বিশ খন্ডের রবীন্দ্র রচনাবলী এখনোও আমার কাছে
আছে। পরে চলেছি। কিছু ভালো লেগেছে , কিছু না। কিন্তু তাদের মতো আমি বলতে পারবো না কার থেকে রবীন্দ্রনাথ
ভালো। রবীন্দ্রনাথ তার নিজের থেকে ভালো - প্রতি
পরের পৃষ্টায়।
শেষ করি তার
ছোটগল্প নিয়ে। আমি দেশে বিদেশের অনেক ছোটগল্প
পরেছি , আর পড়েছি সম্পূর্ণ গল্পগুচ্ছ। নাঃ
, এখানেও রবীন্দ্রনাথ এক নম্বরে নয়। কিন্তু
তার সেই বিশ্লেষনি পংক্তি , "নাহি বর্ণনার ছটা , ঘটনার ঘনঘটা , নাহি তত্ব নাহি
উপদেশ , অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়েও হইলো না আর শেষ।" এর কোনো
জুড়ি নেই। প্রতিটি নভিস লেখক একটা কাঠামো খোঁজে
শুরু করার। তিনি সেই কাঠামো দিয়েছেন ছোটগল্পের। ছোটোগল্পের ব্যাপ্তি তিনি যে বাঁধনে বেঁধে দিয়ে গেছেন তার জন্য সত্যি তিনি আমার গুরু। না কবিগুরু নন, গল্পের গুরু।
এই হলেন আমার
নাইটি পরা ইন্ডিয়ান সান্টা ক্লস যিনি আত্মসমালোচনায় প্রখর আর জগদ্দলের তীব্র নিন্দুক। তোমরা যে যা বল ভাই , আমার পরান যাহা চাই , ইনি তাই।
No comments:
Post a Comment