ধপাস করে ফোনটা রেখে দিলো অর্চনা। অভীক ফোনটা পাশে রেখে আইপ্যাড খুলে অর্ধেক শেষ হওয়া উপন্যাসটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। ঘরটা অন্ধকার , তাই নাইট রিডিং মোড ও আছে। কালো পাতার ওপর সাদা লেখা। শব্দগুলোর ওপর ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে কিছুক্ষনেই মধ্যে অভিকের মনে হলো গতি দুরন্ত কিন্তু পায়ের ছাপ পড়ছে না। পড়ে যাচ্ছে কিন্তু কি পড়ছে মনে থাকছে না। এরকম তো আজকাল হয় না। আগে হতো।
আগে অর্চনা ঝগড়ার মাঝে ফোন রেখে দিলে একে একে রাগ , অভিমান, ভয় সব এসে হাজির হতো। মুখের ওপর ফোন রেখে দেওয়া, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার এক আধুনিক অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যদি ভিখারি বা সেলসম্যান
হয় , তাহলে সে জানবে তার কার্যসিদ্ধি হবে না। তাই সে পরের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বে। ওই নো স্ট্রিং এটাচড রিলেসনের মতো। যদি প্রতিবেশী হয় , তাহলে দরজা বন্ধর আওয়াজ সে কোঁচড়ে বেঁধে ভবিষ্যৎ প্রতিদানের পরিকল্পনা করতে করতে বিদায় নেবে। যদি আত্মীয় হয় তাহলে আবার আসিব না ফিরে বলে প্রত্যাবর্তন করবে। কিন্তু লোকটি যদি স্বয়ং গৃহস্বামী হয় তখন বুঝুন তার কি অবস্থা হয়।
অর্চনার এই অভ্যাসটা চিরন্তন। অভীক জানতো না যে অর্চনা জানতো যে তার এই ফোন রেখে দেওয়া কতটা কার্যকর। যে কোনো ঝগড়ায় , অর্চনা চীৎকার করে ফোন রেখে দিতো। অভীক তখন থতমত। সে জানে যে গার্হস্থ্য যুদ্ধের কুরুক্ষেত্রে কৌরব আর পান্ডব কে। কিন্তু প্রতিবার প্রথমে তার একটাই কথা মনে হতো, মুখের ওপর ফোন রেখে দিলো? এতো অপমান। যদি নিজের স্বামীর জন্য এইটুকু সম্মান না থাকে তাহলে সংসারের কি দরকার। ভালোই তো ছিল সে ব্যাচেলর হিসেবে। পাওনা অনেক কম ছিল। কিন্তু চাহিদাও তো কম ছিল। তখন তো কখনো ভাবেনি তার প্রেমিকা তার জন্য রান্না করে খাবার টেবিলে সার্ভ করে দেবে। বরঞ্চ তাকেই সবসময় উঠে গিয়ে ভিড়ে দাঁড়িয়ে মারামারি করে ঝালমুড়ি , চুড়মুড়
, আইসক্রিম নিয়ে আসতে হয়েছে। আর আনার পরেও অর্চনার থেকে বাহবা তো পায়নি , বরঞ্চ ঝালমুড়িতে নুন কম , চুড়মুড়ে টক
কম , ভুল ফ্লেভারের আইসক্রিম , এই অপটু উপমা পেয়ে এসেছে। আর তাতেও তো খুশি ছিল অভীক। অটো তে তুলে দিয়েই বন্ধুদের কল করতো কোথায় তোরা ?
ঝগড়ার কারণ যদি রিলেসন ভিত্তিক হয় তাহলে অভীক বেশ চাপে পরে যেত। এবার করবে কি। বিয়ের পর সমস্ত রিলেসন গুলো এমন ঘেঁটে গেছে যে সে থৈ হারিয়ে ফেলে। কখনও বৌয়ের দিকে , কখনো মায়ের দিকে হেলা তো চিরন্তন সমস্যা। তার পড়া উপন্যাসের চরিত্র গুলো মাঝে মাঝেই দপ দপ করে জ্বলে ওঠে চোখের সামনে। তারা যেমন করেছে , সেরকম সিলেবাসে মিলে গেলে , তার মনে শান্তি আসে। কিন্তু তার যে একান্ত আপন সমস্যা সেগুলোর সমাধান সে কোনো বইতে পায়না। যেমন স্কুলের
বন্ধুদের মধ্যে গভীর রিলেসন অভীকের জীবনে অনুপস্থিত। এখানে উল্টো সমস্যা। যদি সে তার নিজের বন্ধুদের সাথে কোনো রকম সম্বন্ধ রাখে তাহলে অর্চনা উগ্রমূর্তি
ধারণ করে । আর এই নিয়ে ঝগড়ায় যদি ফোন বন্ধ
হয়ে যায় , তখন অভীক কিছুতেই বুঝতে পারে না করবে কি ? নিজের ছোটবেলাকার বন্ধুদের সাথে
কি রিলেসন না রেখে পারা যায়। অর্চনা তার বন্ধুদের
থেকে প্রচুর ঘা খেয়েছে । সেও ভাবে এখানেও সেরকম
কিছু হতে চলেছে। তাই বন্ধুদের থেকে যেন তেন
প্রকারেন দূরে রাখাটাই তার উদ্যেশ্য। আর তার জন্যেই ধপাস করে ফোন বন্ধ করে একটা মায়াজালের সৃষ্টি করে। যাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অভীক মাথায় হাত রেখে শুয়ে পরে আর পরের দিন ব্যপারটা মিটে যায়।
এই পরের দিন মিটে যাওয়া ব্যাপারটা মনে হয় সব পুরুষের সমান। মনেই থাকে না আগের দিনের সমস্যা। বেশ আপোষ করে নিয়েছিল অভীক অর্চনার সাথে। বলেছিলো কোনো ঝামেলা যেন সকাল থেকে শুরু না হয়। কিন্তু অর্চনার কথায় সায় না দিলে সে ব্যাপারগুলোকে বেশ কিছুদিন টানতে পছন্দ করে। ওর মানসিকতায় যে ঝামেলা ক্ষণস্থায়ী , তার উদ্যেশ্যসিদ্ধিও ক্ষণস্থায়ী। তাই অভীকের এই আর্জিতে সম্পূর্ণ গুরুত্ব কখনই দেয়নি। যেহেতু তারা কর্মবশতঃ এক ছাদের তলায় থাকে না , তাই এই লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপে স্বামীর বশ্যতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অভীক তাই কনফিউসড।
রাগ অভিমানের যন্ত্রনা সয়ে গেলে, অভীকের মাথায় ভয় চেপে বসে। নানা পরিস্থিতিতে অর্চনা যখন ফোন বন্ধ করে দেয় , তখন সেই পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতিতে অভীক ভয় পেয়ে যায়। গাড়ি চালাচ্ছিল , আর ফোন বন্ধ, তাহলে নিশ্চই এক্সিডেন্ট হয়েছে। স্নান করতে যাচ্ছিলো , ফোন বন্ধ , তাহলে হয়তো বাথটবে উল্টে পড়েছে। লিফটে ছিল , ফোন বন্ধ , নিশ্চই লিফ্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আর সবথেকে বেশি যা মনে হয় সেটা ঝগড়ার কারণে সুইসাইড করেছে। এ নয় যে ফোন বন্ধ হওয়ার পর অভীক আর ফোন করেনি উল্টে। বরঞ্চ বার বার ফোন করে আর অর্চনা ফোন কেটে দেয়। অর্চনা বেশ মজা পায় এটা করে। তার কাছে অভীকের এই বার বার চেষ্টা করাটা প্রমান দেয় যে অভীক এখনো তারই আছে। কিন্তু অভীকের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু এসবই পুরানো কথা। বার বার বারণ করা সত্বেও যখন অর্চনা এই ফোন রেখে দেওয়া খেলা থেকে বিরত হয়নি, তখন অভীক ধীরে ধীরে তার মাথা নিয়েছে সরিয়ে। তার খুব কষ্ট হতো। পুরুষের কাঁদা বারণ , কিন্তু একেক সময় ভয়ে , দুঃখে , অভিমানে সে নিজের ভেতরে চিৎকার করতো। একদিন সে নিজেকে বোঝালো যে কিছুই হবে না। কিছুতেই কিছু হয় না। যখন যার সময় আসে তখন সেটাই হয়। সে তো তার দিক দিয়ে চেষ্টা করেছে। অর্চনা যখন সংকীর্ণ রাস্তায় গাড়ি রিভার্স করতে পারছিলো না, তখন সে তো ভিডিও চ্যাটে ডাইরেকশন দিয়েছে। অর্চনা যখন একবার জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি চালাতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো আর জি পি এস চলছিল না , তখন তো ওর লোকেশন ট্র্যাক করে ওকে রাস্তা বাতলে দিয়েছে। সবাই নিজের সুরক্ষা প্রথমে ভাবে। অর্চনা তখনিই ফোন বন্ধ করে যখন সে নিজে পূর্ণ ভাবে সুরক্ষিত। খামোখা অভীক চিন্তায় পাগল হয়ে যায়।
অভীক একদিন, একদিন করে শুরু করে এই ফোন বন্ধ হয়ে গেলে বার বার ফোন না করতে। প্রথম প্রথম সকালে ঝগড়া হয়ে ফোন বন্ধ হলে , সে আবার রাতে ফোন করতো। খুব অসুবিধায় সারাদিন কাটাতো, কিন্তু তাও ফোন করতো না। রাতে যখন অর্চনা ভালো ভাবে ফোন তুলতো , এবং অভীক জানতে পারতো যে তার বৌ সুরক্ষিত আছে , তখন সে নিশ্চিন্ত হতো। অর্চনা ব্যাপারটা ধরে ফেলে , আর সেই দিনের মতো ফোন বন্ধ করে রেখে দিতে থাকে। অভীক তার অশান্ত দিনটা এক দিনের থেকে দুদিন, দুদিন থেকে তিনদিন এরকম করে বাড়াতে বাড়াতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। ফোন বন্ধ করে দিলে , তার কাছে অনেক সময় চলে আসে নিজের কাজ করার জন্য। সে তাই করতে থাকে। মাথা গুঁজে দেয় কোনো কাজে যে সময়ের অভাবে সে করে উঠতে পারেনি। এদিকে অর্চনার ব্যাপারটাতে প্রচন্ড অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। সে সব দিক থেকে চেষ্টা করে যে আগের দিন ফায়ার আসুক। কখন প্রেমে , কখনোও চিৎকারে। যেহেতু তার উদ্যেশ্য অভীক কে বশে আনা , তাই অশালীন চিৎকারই তার বেশি উপযোগী মনে হয়।
সে অভীকের চরিত্রের দিকেও আঙ্গুল তোলে। এমনকি অভীকের বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকেও সে চেষ্টা করে জানতে যে সত্যি সে অন্য নারীসঙ্গে পড়েছে কিনা। কিন্তু না কিছুই খুঁজে পায়নি। কিন্তু অভীক যেন ধীরে ধীরে তার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। উদ্ভ্রান্তের মতো ঝগড়া তাদের মধ্যে দিন কে দিন বেড়ে চলতে থাকে। কিন্ত অভীক এখন চিদানন্দ। সে জানে সে ভুল নয়। আর তার কোনো ভয় নেই। সে জানে যদি সমস্যা হয় তাহলে অর্চনা তাকে কল করবেই আর তখন সে কোনোরকম হেঁয়ালি ছাড়া কর্তব্য কর্ম করে যাবে। সে বুঝেছে , মোহ মানুষকে এতো অসহায় করে দেয় , সেটা জিতে নিলেই কেল্লা ফতে। তার মনের শিকলগুলো যায় ছিঁড়ে।
কিন্তু আজকে তার আবার কেন সেইরকম পুরোনো অস্বস্তি হচ্ছে কেন। এই অস্বস্তি তো অনেক বছর আগে সে কাটিয়ে ফেলেছে। পাগলের মতো সেই দিনগুলো সে মনে করতে চায়। কিন্তু মনে পড়েনা সেই দিনগুলো যখন ধীরে ধীরে সে নিজের অস্তিত্বকে জাগিয়ে তুলছিলো। আজকের অস্বস্তি যেন আরো দশ গুন। আরো গভীর , আরো ভীতি প্রদর্শক। আইপ্যাডটা সাইডে রেখে সে উঠে যায় বাথরুমে। মুখে চোখে জল দিলেও বিন্দুমাত্র অস্বস্তি কম হয়না। নানা সমস্যা মাথায় এসে চাড়া দেয়। বুকের রক্ত গলায় উঠে আসে। খাটের পাশে পরে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নেয় সে। আনলক করতেই ফুটে ওঠে তার নবজাতকের হাসি হাসি মুখ। সমস্ত সংযম হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে
অর্চনার নাম্বার ডায়াল করতে থাকে। একবার নয় , বার বার, বার বার।
No comments:
Post a Comment