Saturday, September 2, 2017

2) ক্ষমা নেই


ছেলেটাকে আজ স্যাক করে দিতে হলো।  ছেলেটা কাঁদছিলো।  বার বার বলছিলো ম্যাডাম আমাকে একবার সুযোগ দিন আমি ঠিক আমার ভাষা শুধরে নেবো।  মাদ্রাসা থেকে পাস করেছিল ছেলেটা।  ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজে উর্দু।  এরপর এক অখ্যাত কলেজ থেকে পাসে ইতিহাস নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে সে।  চাকরির বাজারে গরুতে খাওয়া ফুলকপির মতো অবস্থায় যখন এদোর ওদোর ঘুরছে তখন একদিন আমার প্রাইমারি স্কুলের ওনারের সেফারিসে টিচারের চাকরি পায়।  মাইনে তিন হাজার।  আমি তাকে ইন্টারভিউ পর্যন্ত করিনি। আমার হাত বাঁধা।  আমায় সাধারণ ভাবেই আমার বসের কথা মেনে চলতে হয়।  এই স্কুলের প্রাইমারি সেকশান চালানোর জন্য যা যা আমাকে করতে হয় সে আমিই জানি।  এই সাধারণ মাইনে দিয়ে অসাধারণ কাজ বার করে নেওয়ার চূড়ান্ত পরিশ্রমে আমার শরীর মনের সমস্ত শক্তি সবসময় আমাকে বলে এবার ক্ষান্ত হও। 

মাঝে মাঝে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতে থাকি কি করে এই জোয়ান জোয়ান ছেলেরা এই দু তিন হাজারের চাকরি নিয়ে খুশি থাকে।  মানছি তারা একবার চান্স পেলে অনেক টিউশন পায়।  সেই  টিউশনি করেই তারা সংসার চালাচ্ছে।  কি অপমান করে তাদের স্যার।  কথায় কথায় লাথি মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে।  বলে এরকম অনেক আসবে।  এরা তো শিক্ষিত করছে আগামী প্রজন্ম কে। এরা তো শিক্ষক।  হতে পারে তারা যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারেনি।  কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় পাশ করার মতো মেধা তাদের নেই।  কিন্তু একই জিনিস পড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।  অশিক্ষিত মা যখন তার বাচ্চাকে শেখাতে পারে,  তখন এরাও পারে এক সে এক স্টুডেন্ট বার করতে। 

আমার এই প্রাইভেট স্কুলের এখন অনেক নাম।  কারণ আমরা সত্যি এখানে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করি।  কিন্তু জন্তু সেতো  জন্তুই থাকে।  মানুষ করে তুলতে পারিনা। যে কোনো ব্যাকগ্রাউণ্ড থেকে ছেলে পিলে এখানে পড়তে আসে।  একটাই মাপকাঠি , বাবা মার্ পড়ানোর ক্ষমতা।  টাকা ঢালতে পারলেই, গাধাদের ঘোড়া করে রেসের মাঠের জন্য তৈরী করি আমরা।  সেখানে মানুষ আসে এদের দৌড় দেখতে। এরা দৌড়ায়।  জানেনা কেন।  শুধু জানে দৌড়াতে হবে।  এদের ওপর বাজি লাগে।  কয়েকদিনের মধ্যে যখন বুড়ো হয়ে যায় তখন তাদের স্থান হয় শান দেওয়া ছুঁড়ির আগায় - ফ্রম স্টেবল টু টেবিল। 

আমি চাই মানুষ তৈরী করতে।  কিন্তু বাঁদরের থেকে মানুষ হতে কতগুলো জেনারেশন লেগেছিলো খেয়াল আছে ? প্রতি জেনারেশন নিজের প্রাণপণ চেষ্টা করেছে তার পরের জেনারেশনকে নিজের থেকে বেশি শিক্ষিত করে তুলতে। আজ এই ঘোড়াগুলো হয়তো পরের জেনারেশনে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে , তার পরের জেনারেশনে হয়তো ক্ষুর থেকে আঙ্গুল বার করে কমলালেবুর খোসা ছাড়াবে , তার পরের জেনারেশানে হয়তো কথা বলবে।  তবে না , আজকে আমি তাদের গাধা থেকে ঘোড়াই বানাচ্ছি।  আমি তাদের নাতি নাতনির মানুষ হয়ে যাওয়া দেখে যেতে পারবো না। 

তবে আমি চেষ্টা করি।  আমি চেষ্টা করি এদের মধ্যে থেকেই কিছু জনকে বার করতে , যারা ঝাঁকের কই হয়ে এক সাথে আত্মহত্যা করতে চায়না।  আমি রোজ সকালে এই অন্বেষণেই নিজের কর্মের সার্থকতা খুঁজি।  কিন্তু এই মুষ্টিমেয় হীরকমণ্ড কয়লা থেকে আলো বিচ্ছুরণ করে না। তার জন্য আমার চাই যোগ্য হিরকশিল্পী, যার অভাব এই স্বল্প উপার্জনে।  মানুষ সর্বদা মার্কেটে নিজের কদর যাচাই করে।  আর এক এক পা করে  এগোতে এগোতে সমাজের কাছে নিজের যোগ্যতার পারিশ্রমিক বৃদ্ধি করতে থাকে। আমার স্কুল তাই সর্বদা সেইসব কারিগর পায় বা রাখে , যারা কোনো না কোনো কারণে পলায়নে অক্ষম।  আর তাতেই কিছু কয়লা , কয়লাই থেকে যায়। 

আমার উচ্চশিক্ষিত , উচ্চমেধা এবং উচ্চব্যবসামননসম্পন্ন বসের ভাষায় , "শেখানোর জন্য শিক্ষা লাগে না। পদ্ধতি লাগে।" তিনি বলেন , "কেউ ১০ শেখে কিন্তু ১ শেখাতে পারে।  কেউ ১০ শেখে ২  বিশ্লেষণ করে আর ১২ শেখায়। আমার চাই তাদের যারা ৮ শেখে আর ৩ শেখাতে পারে। বাকি ৫ তোমার পদ্ধতির দৌলতে শিখে যাবে।" এই মানুষগুলো খুঁজে বার করা , আর পদ্ধতির ঘেরাটোপে মাইক্রোম্যানেজ করা আমার কাজ।  বাংলায় ট্রেনার আর টিচার দুটোর মানেই শিক্ষক।  তাই আমি সর্বদা হেরো।  তত্বের লড়াইয়ে পরাজিত এক হেডমাস্টার। 

ছোটবেলায় নামতা মুখস্ত করতে দুলতে হতো।  পরে যখন তিন তিন সংখ্যার গুন্ করতাম তখন বুঝেছিলাম দোলার দরকার সবসময় পরে না।  মুঘলদের নাম মনে করার জন্য যখন সেই "বাবার হলো আবার জ্বর , সারলো ঔষধে " শিখেছিলাম তখন স্যার বলেছিলো ইতিহাস মুখস্তের বিষয় নয়।  তাদের সেই পদ্ধতি হয়তো আমার পাথেয় কিন্তু আমি তো সর্ববিদ্যা বিশারদ নই।  কর্মী তাদের শর্টকাট বার করবে আর শেখাবে।  কিন্তু তারাই এখনো যোগ করে আঙ্গুল গুনে গুনে। 

সাথে আছে সেফারিশ নামক অত্যন্ত নোংরা এক পদ্ধতি।  গুড বুক্স আরেক পাঁচফোড়ন।  নূন্যতম যোগ্যতা সবক্ষেত্রে খাটেনা।  আর যোগ্যতায় যদি বংশ লতিকা যুক্ত হয় তাহলে ব্রাহ্মনের  বাড়াবাড়ি সৃষ্টি হয়।  আর তাতেই বাঁধে গোল। শিশু তার মায়ের কাছে সবথেকে ভালো শেখে, তার কারণ মা কনস্ট্যান্ট আর সবাই ভ্যারিয়েবল। মাতৃভাষা শিক্ষার সর্বোত্তম মাধ্যম তখনি হয় যখন সেই ভাষা জীবনে কনস্ট্যান্ট হয়।  শিক্ষকের পরিবর্তন শিক্ষার ভয়ানক অন্তরায়।  কিন্তু আমায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে যেতে হয় শিক্ষকদের , কারণ হয় তারা শিক্ষাদানে অযোগ্য বা বসের পদলেহনে। 

ছেলেটি যখন কাঁদছিলো , আমি বললাম , "তোমার বয়স এখন এতো কম , সবে পঁচিশ, কেন তুমি এখানে নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করছো।" সে বললো, "আমার বাবা রিটায়ার , আমার পরে আরো তিনটে ভাই বোন আছে।  আমি একমাত্র কাজের।  এখন কিছু একটা করে টাকা জোগাড় করা আমার কাছে সবথেকে বড় প্রাধান্য।  আমি মানছি আমার ইংলিশ ভালো নয়।  কিন্তু শিখতে কদিন।  শিখে নেবো , আমায় সুযোগটুকু দিন।" সে শিখবে তারপর ডেলিভার করবে।  আমার তখন নিজের ছেলের কথা মনে পরে গেলো।

বড়টা যখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তখন বিশ্বব্যাপী রিসেশান।  কোথাও চাকরি পাচ্ছে না।  রোজ সকালে একটা ব্যাগে জেরক্স করা সিভি নিয়ে বেরোতো।  রাতে যখন ফিরত বলতো , "মা , আজকে আমি দারোয়ানের কাছেও ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছি। দেখি যদি কেউ নেয়। " আমি ওর বাবার কাছে রাতে কাঁদতাম। ওর বাবা বলতো চাকরি খোঁজা এরকমই।  বাজার খারাপ , বাজার একদিন ঠিক হয়ে যাবে।  ভয় হতো , জোয়ান ছেলে , একটা আবার গার্লফ্রেন্ডও আছে।  সিরিয়াস প্রেম।  বিয়ে করবে মনে হয়।  ছেলেটা পাগল হয়ে উঠেছিল।  যদি সুইসাইড করে বসে।  এঁটুলির মতো লেগেছিলো একটা চাকরির জন্য।  মাঝখানে একটা ছোট টিচিং ইনস্টিটিউটে কয়েকদিন পড়িয়েছিলো।  কোথায় একটা ছোট ওয়েবসাইট লঞ্চ করে দেওয়ার জন্য ন শো টাকা পেয়েছিলো।  আজ যদি সে সেই একই কাজ করতো তাহলে হয়তো আমার স্কুলেই এর মতো কাজ করতে হতো।  বুকটা ধড়াস করে উঠলো। 

ছেলে বলতো, "মা, কেউ অপেক্ষা বা ক্ষমা করে না। " চাকরি পেয়েও দিনের পর দিন আমার কাছে ফোন করে কেঁদেছে। বলেছে শুধু মদ খায়না বলে রেটিং ভালো পায়না।  যারা বসের সাথে বসে উইকেন্ড এ বসে মদ খায় , তারা ওর রেটিং মদের চাটের সাথে খেয়ে নেয়।  আমি মা হয়ে বুকের ওপর পাথর চেপে বলেছিলাম , খেয়ে দেখ মদ , নেশায় না পড়লেই হলো।  কম্পিটেন্সি কম্পিটেন্সি করে মাথা খারাপ করতো, এখনো করে।  বলে আমি সবসময় নতুন নতুন অস্ত্র নিয়ে রেডি হয়ে থাকি।  কখন কোনটা দরকার পড়বে কে জানে।  এখন তো মাল্টিস্কিলের যুগ।  ছেলেটা আমার বুদ্ধিমান নয় , কিন্তু খাটিয়ে।  বলে , মা কাটলেই হলো , ধারেই কাটি আর ভারেই কাটি।  প্রতি এপ্রিলে মন মেজাজ বেশ কিছুদিন খারাপ থাকে।  মনমতো কখনো হয়না তার এপ্রেইসল।  আমি বলি এতো টাকা টাকা করিস না।  ভালোই তো কামাচ্ছিস।  উত্তরে বলে , মা টাকা নয়, আমার পরিশ্রমের মর্যাদা পাইনা।  সবার তো জীবন আছে , কেউ ঘুরতে যায় , কেউ দিন রাত  সিনেমা দেখে , শুধু বাড়িতে বসে মজা করে।  আমি তো তাদের দলে পড়িনা।  আমার তো একমাত্র লক্ষ্য কি করে কিছু কন্সট্রাক্টিভ কাজ করে কিছু শেখা  যায়।  আমার সমগ্র শক্তি আমি তো এর পেছনে ব্যয় করি।  তাহলে কেন হয় না। 

আমি দেখেছি ছেলের অধ্যাবসায়।  আমি দেখেছি তার লেগে থাকার ক্ষমতা।  আমি দেখেছি তার সব সময় রেডি থাকার প্রবণতা।  একটা সমস্যা দিলে দশটা সল্যুশন খুঁজে রাখে সে।  আমি তার সাফল্য আর বিফলতা কাছ থেকে দেখেছি।  আমি সেই ছেলের মা হয়ে কি করে আজ এর পেছনে দাঁড়াই।  কেন আমি একে  সুযোগ দেব। আমার নিজের রক্তে গড়া মানুষটিকে তো কেউ ছেড়ে কথা বলেনি যখন চাকরির জন্য ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতো।  কেউ তো একবারের জন্যও সুযোগ দেয়নি।  পাগলের মতো পরিশ্রম আমি দেখেছি এই চোখ দিয়ে। আজ যদি আমি প্রশ্ন করি এই ছেলেটাকে যে কেন তুমি ইংলিশ শেখোনি।  কেন তুমি চেষ্টা করোনি ভালো পড়াশোনা করার। হতে পারে সে তার বাবা মার দোষ দেখাবে।  কিন্তু আমার ছেলের তো কোনো ত্রুটি রাখিনি আমার দিক থেকে।  তবু তো তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে।  সে তো বাবা মার দোহাই দিয়ে করুণা  পেতে পারতো। কিন্তু সে তো পায়নি।  আমি কেন করুণা করবো একে। 

আজ যদি আমি একে করুনা করি।  কাল এর দ্বারা তৈরী হওয়া মানুষ গুলো মানুষ হতে পারবে না।  যে মানুষ অপরের করুণার পাত্র , সে কি করে কাউকে শিক্ষা দিতে পারবে।  আজ যদি সে ভুল করতো।  ভুল স্বীকার করতো।  তাহলে ক্ষমা করে তাকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারতো।  আমার ছেলেটাও বাঙালি মিডিয়াম এ পড়েছে।  বাংলা তার মাতৃভাষা।  বাংলায় গল্প কবিতা লেখে।  যখন ট্রেনিং নিতে কেরালা গেছিলো , সবাই ওর হিন্দি ইংলিশ নিয়ে কত খিল্লি করেছে।  আজ সে এক রাশ লোকের মধ্যে সেমিনার দেয়।  সে পেয়েছিলো সুযোগ।  সুযোগ দু রাত্রির।  আটচল্লিশ ঘন্টা এক নাগাড়ে মুখস্ত করে প্রথম সেমিনার দিয়েছিলো তার ট্রেনিং এ।  সে পেরেছিলো কারন তার চেষ্টা ছিল। 

আমি একেও দিয়েছি সুযোগ। প্রত্যেক দিন ভুল শুধরে দিতাম।  আজ মনে পড়ছে , তার বার বার একই ভুল শুধরে দেওয়ার সময়গুলো।  মিষ্টি হেসে কখনো সরি বলতো , কখনো মজাদার কোনো এক জবাব দিয়ে কথা ঘুরিয়ে দিতো।  আমি কখনো গায়ে মাখিনি।  কারণ আমার কাজ ভুল শুধরে দেওয়া , কিন্তু এটা আমার মাথায় থাকে না , যে কে কতবার ভুল করেছে।  আজ অন্তিম বিশ্লেষণে চুলচেরা বিচারে আজ সেগুলো সব এক এক করে সামনে চলে আসছে।  নাহ , আমি একটা অর্গানাইজেশান চালাই।  এই চোখের জলে তার গতি প্রকৃতি পাল্টাতে পারবো না।  যারা কাজ করছে তারা প্রাণ দিয়ে করছে।  চেষ্টা করছে নিজেদের ভুল ত্রুটি শুধরে নেওয়ার।  ক্ষমা চাইছে ভুল করলে , কিন্তু করুণা চাইছে না। 

আমি পারলাম না ছেলেটার পেছনে দাঁড়াতে।  মাথা নিচু করে ছেলেটা চলে যাওয়ার সময় দরজা থেকে একবার পিছু ফিরে আমার চোখে চোখ মিলিয়ে বলে উঠলো , "ম্যাডাম , আমার সাথে যা করলেন, আমার জায়গায় নিজের ছেলেকে বসিয়ে যদি ভাবতেন তাহলে হয়তো পারতেন না।" আমার আর কোনো দ্বিধা রইলো না।  মনে প্রফুল্লতা ছেয়ে রইলো।        

আগের গল্পগুলো

No comments:

Post a Comment