Sunday, February 4, 2018

প্রবন্ধ ২৫ - রোমান হরফে বাংলা বই


ফেসবুক খুললেই এখন বইমেলা বইমেলা গন্ধ। কে কতগুলো বই কিনেছে , নতুন কি বই রিলিস হয়েছে , কোন স্টলে কি পাওয়া যাচ্ছে পুরো পূজা পূজা ধারাবিবরণী। হবে নাই বা কেন, বাংলা তো আর ভাষা নয়, হিন্দু মুসলিমের মতো আরেক ধর্ম আর বইমেলা তার তীর্থ।যাকে বলে অমরনাথ অফ বং। প্রতিবছর এই সময় আমাদের কালচারাল লিঙ্গ উচ্চতার শীর্ষে পৌছোয় আর কাতারে কাতারে বাঙালি সেই অভিনব দৃশ্য দেখতে হাজির হয়। 

এই ধর্মে এতদিন কোনো সমস্যা ছিল না। বাঁ হাতে ফুল ছুড়লেও যেমন চলে , সকালে খবর কাগজ বা নিদেনপক্ষে রবিবাসরীয় পড়লেই ধর্মরক্ষা হয়ে যেত। কেউ এসে বলতো না বাংলা না পড়লে বাংলা ধ্বসে যাবে । ওই যেরকম বলে না হিন্দু বাঁচাও , ইসলাম বাঁচাও টাইপ। এ ধর্ম নিজের তালে নিজের খেয়াল খুশিতে এগিয়ে চলতো । হাজার বছরের এই ভাষা কখনো না বলেনি । ঠ্যাঙানি থেকে পেটানি থেকে প্যাঁদানি থেকে ক্যালানি দিব্যি বাংলা এগিয়ে চলেছে।

কিছু লোককে ক্রমাগত বলতে দেখি বাংলা মিডিয়াম এ ছেলেদের পড়াচ্ছে না বলে ভাষা তলানিতে যাচ্ছে। মশাই বিখ্যাত ভাষা সাহিত্যিকেরা, যাদের বই দেখে এখনো বইমেলাতে গিয়ে হামলে পড়েন, তারা কিন্তু কেউ বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করেননি । বস্তুতপক্ষে সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র বাংলায় বি-এ  এম-এ করা ছাড়া এখনো বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার কোনো মানে হয়না।  যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তাদের পক্ষে বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ লিখতে লিখতেই জীবন কেটে যায়।  বিশ্বাস করুন , ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ বাংলায় পড়াতে আমাকে এখনো খেসারত দিতে হচ্ছে।  

ভাষার গতি , দ্রুতি , স্থিতি ও বিস্তার তার বক্তার ওপর নির্ভর করে।  সাহিত্য তাকে একটা অবলম্বন দেয় মাত্র। পৃথিবীর প্রচুর মৃত ভাষাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ভাষা ছিল সংস্কৃত।  কেন এই ভাষা মৃত এবং এর থেকে বেরিয়ে এসে শতাধিক ভাষা কেন তাদের নিজ অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছে তার কারণ সেই অভিশ্রাবণ আর অভিযোজন। সংস্কৃতর আগেও একটা ভাষা ছিল যা সংস্কার করে সংস্কৃত সৃষ্টি হয়েছে।  পানিনি যার ব্যাকরণ সৃষ্টি করেছিলেন।  লেখা হয়েছিল হাজার হাজার অমর সাহিত্য। কিন্তু সম্ভব হয়নি মানুষের জিভে তুলে দেওয়া। তার ওপর ছিল নাক উঁচু ব্রাম্ভন্য ধর্মের কড়া নজরদারি।  নতুন কিছু ঢোকাবে না।  তাই ধীরে ধীরে সেই চরম সায়েন্টিক সব থেকে সুন্দর ভাষাটি ধীরে ধীরে মৃত হয়ে যায়।     

 বাংলা লিখতে গেলে বাংলা পড়তে হয়না।  বাংলায় ভাবতে হয়। আসলে জানেন , বাঙালি বাংলার বাইরে বেশি বাঙালি।  ভুলে যাওয়া অনেক কিছু বাঙালিয়ানা এখনো বাংলার বাইরে সমান ভাবে বিরাজমান। কূপমণ্ডূক বাঙালি কেঁদে হেদিয়ে পড়লো যে বাংলা ভাষা যাচ্ছে ডুবে, আর বাংলার বাইরে থেকে বাংলা ভাষায় কালজয়ী উপন্যাস লিখে গেলেন বিভূতিভূষন। যারা বাংলায় আছেন তারা বাংলার ধ্বজা ধরুন আর যারা বাইরে আছে তারা তার বিস্তার করুন এইতো সোজা হিসেব।  

এই এতবড়ো গৌরচন্দ্রিকা মারার একমাত্র কারণ একই কথা ঘ্যানর ঘ্যানর না করলে অনেকেই আসল কথা বুঝতে পারে না।  তাই কবিতার পাঠক কম আর বড় উপন্যাস সবাই পড়েছে।  যাহোক , যেদিন শুনলাম রোমান হরফে বাংলা বই বেরোচ্ছে আমি ভাবলাম ‘এইতো ‘ . কিন্তু দুদিনের মধ্যেই ফেসবুক , টুইটার , ইমেইল , খবরের কাগজ পরে আমারও  মনে হতে লাগলো , ‘তাইতো’ বাংলা এবার শেষ।  একেতেই ছেলেপুলেরা এখন বাংলাতে নাক সিঁটকোয় তারওপর যদি হরফ যায় পাল্টে তাহলে কি হবে।  

 সেদিনই আমার সবথেকে প্রিয় মাসতুতো বোন হঠাৎ আমাকে ফেসবুকে পিং করলো , ‘ভাই , তুই তো অনেক লিখছিস বাংলায়।  ওগুলো যদি পারিস আমাকে ইংলিশ হরফে লিখে পাঠাবি ? ‘  আমি বুঝলাম আমার চিন্তা ভুল। আমাদের সাহিত্যচিন্তার গোঁড়ামি আমাদের এক বিশাল সংখ্যক প্রবাসী পাঠকদের ভুলেই গেছে যারা বাংলা অক্ষর চেনেনা।  বাঙালি বহির্মুখী , সারা বিশ্বে তারা ছড়িয়ে আছে।  কেউ বিয়ে করেছে ভিন্নভাষীদের।  কেউ জন্মেছে বাঙালির গর্ভে বাংলা তাদের মাতৃভাষা , বাড়িতে বাংলায় কথা বলা হয় অথচ অক্ষরজ্ঞান ভিন্নভাষায়।  তাদের আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন।  তারাও তো বাঙালি।  তারাও তো বাংলা ধর্মে দীক্ষিত।  নেটফ্লিক্স এ বাংলা সিনেমা দেখে।  তারা কি দোষ করেছে।  

 আটশো কোটির পৃথিবীতে কুড়ি কোটি বাঙালি।  আমরা যদি সবার কথা মাথায় নিয়ে না চলি তাহলে তো আমরা অচিরেই শেষ হয়ে যাবো। ইংরেজি বিশ্ববন্দিত শুধু এই কারণে না যে তারা সারা পৃথিবীতে রাজ্ করেছিল।  তারা ভাষাকে করে তুলেছে সর্বজনবিদিত করে।  তাদের কাছে ব্রিঞ্জলও যেমন ইংরেজি , এগপ্লান্ট ও তেমনি ইংরেজি।  তারা প্রতি বছর সমস্ত ভাষা থেকে শব্দ তুলতে থাকে।  ‘গুরু’, ‘ঘেরাও’ , ‘জুগার’ আজ ইংরেজি ডিকশনারির পার্ট।  তাতে কি ভাষা মরে যাচ্ছে।   

আমার মা প্রবাসী , মাসিরা এখনো প্রবাসে , তাদের ছেলে মেয়েরা দূর্গা পূজায় বাঙালিআনার ষোলোআনা পরিবেশন করে।  প্রতিমাসে একটা অন্তত বাঙালি সিনেমা দেখে।  আমার ভাগ্নে বিদেশে জন্মেছে কিন্তু বাংলা বলতে বা পড়তে পারে না কিন্তু বুঝতে পারে।  ফেলুদা থেকে শুরু করে যা যা অনুবাদ হয়েছে সব পড়েছে।  আমার কলিগের বাচ্চারা যারা সো কল্ড এ বি সি ডি তাদের অবস্থাও সমান। বাংলা সাহিত্য চূড়ান্ত সমৃদ্ধ।  তাই সারা পৃথিবী চায় বাংলা সাহিত্যের স্বাদ নিতে।  স্প্যানিশ , পর্তুগিজ এই দুই ভাষা পৃথিবীর দশটি সর্বোচ্চ কথিত ভাষা হওয়া সত্বেও এদের নিজস্ব কোনো লিপি নেই।  ইংলিশ লিপি থাকার কারণে তারা ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুততার সাথে।  কারণ মানুষ প্রথমে  শুনে শেখে , তারপর পড়ে।  

মান্দারিন বা জাপানিজ লিপি তাদের নিজের দেশেই অনেকে লিখতে পড়তে পারেনা।  তাই প্রচুর বই ইংলিশ হরফে পাওয়া যায়।  তাতে কি তারা মনে করেছে যে ভাষার মৃত্যু এসে গেছে।  

আমি রোমান হরফে বাংলা ভাষার বই বেরোনোর পক্ষে।  এবং চূড়ান্ত পক্ষে।  আমি খুশি যে কেউ আমার ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।  না কি ফালতু ফেসবুক সমালোচনা করে কূপমণ্ডূকতার পরিচয় দিচ্ছে।  বাংলা , আছে , থাকবে এবং বৃদ্ধি পাবে - এই আশা না , বিশ্বাস নিয়ে এবার থামছি।  

আগের প্রবন্ধগুলি 

No comments:

Post a Comment