Thursday, August 24, 2017

শব্দজব্দ


"তুই নরকে যাবি ছিনাল।" হাতে নাতে বৌকে ধরে ফেলে এই উক্তিটাই করেছিল ইদ্রিস। ইদ্রিসের বৌ হিন্দু। তাই জাহান্নামের অভিশাপ দিতে গিয়েমুখে আটকালো। শব্দ নিয়ে খেলা করা যার অভ্যাস, সে কি করে এই চরম মুহূর্তেও তার শব্দজ্ঞান বজায় রাখে তা নিতান্ত ঈর্ষণীয়। কিন্তু ইদ্রিসের "শড়া অন্ধা আছি" হয় না। প্রত্যেক শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের পেছনে সে যে সময় ব্যয় করে তার বদলে যদি জীবিকা উপার্জনের জ্ঞান সে সংগ্রহ করতো হয়তো তাতে বেশি লাভ হতো। 

শব্দের প্রতি তার এই যে প্রীতি তার কারণ শব্দজব্দ। সে এক নাম করা ক্ষেতের জোত্চাষী। ক্ষেতটি নাম করেছিল যখন পাশের পাড়ার মৃন্ময় সাধুখাঁ ক্ষেতটি তার নিজের রক্ত দিয়ে আল দিয়েছিলো। অবাক লাগলো, না? ইদ্রিসেরও অবাক লেগেছিলো।  চার মেয়ের পর যখন শেষ মানতে মৃন্ময়ের ছেলে হয়, তখন তার ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে বুকের রক্ত দিয়ে গন্ডি কেটে দান করেছিল আবু হাসান মোল্লা কে।  মৃন্ময় গ্রামের মোড়ল এবং উচ্চশিক্ষিত ধনী।  কমুনিস্ট সরকার সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়ার পরেও যা তার হাতে পরেছিল তা প্রায় অর্ধেক গ্রামের পেট চালায়। অর্থ বড় স্বার্থপর  এবং অভিমানী।  তাই পরবংশে বিলিয়ে না দিয়ে , নিজ বংশে রক্ষা করার জন্য সব ধর্মের সব দেবতাকে এক সাথে মানত করেছিল মৃন্ময়।  তার মানতের কথা শুনতে পেরেছিল এই হাসান মোল্লা নামের মুসলমান।  বলেছিলো , দশ শতাংশ জাকাত তো তোরা দিবিনা।  তাই অন্তত কিছু দান করিস।  ওদিকে রামু পন্ডিত শুনে বলেছিলো কিচ্ছু দান করিস না।  তার থেকে বুকের রক্ত মানত করিস।  কাজ দেবে।  তাই যখন যেকোনো একটা ভগবান তার কথা শুনলো তখন সে ষোলো একর জমি নির্ধারণ করলো দান করার জন্য।  আর দাগ দিলো তার বুকের রক্ত বেলকাঁটা ফুঁড়ে ফুঁড়ে। 

সেই থেকে ইদ্রিস সেই জমিতে নিজের পছন্দ মতো সবজি ফলায় আর জাকাতের বদলে যা ফসল হয় তার দশ শতাংশ গ্রামের স্কুলের মিড্ ডে মিলের সাথে জুড়ে দেয়। সেখানেই তার পরিচয় হয় হতভাগী রুপার সাথে। সে সেখানে মায়ের সাথে রান্না করতে আসতো। তারুণ্যে কুক্কুরীও সুন্দরী হয়। রঙ উজ্জ্বল, নাক টিকলো, পীনস্তনী, পরিমিত উচ্চতা , গুরু নিতম্ব। লিখতে গেলে সমস্তই উর্বশীর সঙ্গ সমতুল্য , কিন্তু আদপে মাঝারি রূপ। তবু গ্রামের পুরুষ মহলের সে স্বপনচারিণী। সেই সৌন্দর্য্যে চোখ ঝলসে গিয়ে ইদ্রিস তার হাত চেয়ে বসে। রূপা ঘাবড়ে গিয়ে পিছু হটলেও ইদ্রিশকে বলে, ‘ধর্মে মানলে তবেই করব বিয়ে’। ইদ্রিশের কথা জানাজানি হতে দেরি লাগে না ।  প্রায় দাঙ্গা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয় গ্রামে।

গ্রামে আগেও দুই ধর্মে বিয়ে হয়েছে।  কিন্তু কেউ তারা গ্রামে ফেরেনি।  কিন্তু রুপা কিছুতেই চায় না তার মা কে ছাড়তে ।  আর ইদ্রিস তার ক্ষেত।  যখন কথাটা জানাজানি হয় তখন পোড়ামা কালির মন্দিরের পুরুত রজত ভট্টাচার্য , যাকে দুই ধর্মের সবাই মান্যি গন্যি করে, সে ডেকে পাঠায় ইদ্রিসকে।  গোপালের চায়ের দোকানে মসজিদের আখতার মোল্লার সাথে চা খেতে খেতে সামনে বসে থাকা ইদ্রিস কে প্রশ্ন করে , "বিয়ে করবি হিন্দুর মেয়েকে। জানিস তো জাহান্নাম নসিব হবে।" ইদ্রিস দুই হাঁটুর মধ্যে মুখে গুঁজে উত্তর দেয় , "আগে তো স্বজ্ঞানে জন্নত দেখি।" আখতার  মোল্লা বলে , "এক রুপার জন্য বাহাত্তর হুরী ছাড়বি?" ইদ্রিস বলে , "একই রুপার তো সহস্র রূপ। আগে তো সেইসব রূপ দেখি।" রজত বলে , "না না মোল্লা , এ ঠিক হবে না।  এ তো ছোঁবে।" ইদ্রিস বলে , "ধুয়েও রাখবো। ওই গ্লাসটার মতো।" হাতের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে রজত বললো , "আর যে বাচ্চা দিবি সে কোন ধর্মে যাবে ?" ইদ্রিস ঈষৎ হাসি হেসে বলে , " কাফের বানাবো , যাকে আপনারা নাস্তিক বলেন। " হাসান ভ্রূ কুঁচকে বলে , "হারামজাদা , বলিস কি। " ইদ্রিস বলে , " এদেশে তো শরিয়া মানা হয়না , তাই আল্লাহ তাকেও মৃত্যুর পর জাহান্নমে পাঠাবে আর ভগবান ওরে কিছুই বলবে না কারণ আস্তিকও হিন্দু , নাস্তিকও। নাহয় নরকে যাবে। আমিও তো সেখানেই ওর জন্য অপেক্ষা করবো।" রজত অবাক হয়ে বলে , "হ্যা রে , নিজের বাচ্চার সম্বন্ধে এতো খারাপ তো কাউকে ভাবতে শুনিনি।  শুধু রুপার জন্য বাচ্চার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবি?"    

"নষ্ট কেন বলছো কত্তা।  আপনারা  মরার পর কথা বলছো আমি মরার আগের কথা বলছি। ঐতো সেদিন তো  শুনলাম আপনি রুপার মা রে বলেছেন,  কলিযুগে নাকি ভক্তিই সার। ভক্তি থাকলেই নাকি স্বর্গপ্রাপ্তি।  তা কত্তা আমিও তদবির করি।  পাঁচক্তো নামাজ পড়ি , রোজা রাখি আর রুপাও তো শিবের মাথায় জল না ঢেলে খায় না।  দুয়ের ভক্তি সার কি পোলা পাবে না।" রজত আখতারের দিকে তাকিয়ে বলে , "মোল্লা সাহেব , কি বলে তোমার ধর্মে।  পিতার পুন্য কি পুত্র পেতে পারে।" মোল্লা বললো , "রজত , সব শিশুই ফিতরাহ নিয়ে জন্মায়। ইসলাম তো প্রাকটিস।" রজত বলে , "সে তো আমরাও বলি , হিন্দু বলে কি কোনো ধর্ম আছে।  সব শিশুই তো হিন্দু। যাকগে বাজে তর্ক। একটা কথা বল ইদ্রিস। রুপারে ইসলামে পালাটাইবি না তো।" ইদ্রিস বলে , " সে তার ইচ্ছা।" রজত এই মোল্লাদের কারচুপি বোঝে , " এইটাই শুনতে চাইছিলাম। তবু, না বলবি না।  তার ইচ্ছা , তার ইচ্ছা , তার মানে সেই ইচ্ছায় জোর করে বুরখা পড়াবি তাই তো।" ইদ্রিস এতো প্যাঁচ জানে না।  প্রথমে থতমত খেয়ে একটু সামলে নিয়ে বললো , "কি বলেন কত্তা।  ইসলামে বলে বটে জোর করে ধর্মান্তরিত কর, কি মোল্লা সাহেব, আপনেই তো বলেন।  কিন্তু হিন্দুতেও তো বলে যে ধর্মই পালন করো না কেন হিন্দুই থাকবে।" রজত মাথা নাড়লো , "তা ঠিক। তাই হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরণের কোনো নিয়মি নেই।  কিন্তু গোত্র তো পরিবর্তন হয়ে যাবে। তোর গোত্র কি?" ইদ্রিস পরাজিত।  কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো , "কি করে জানবো।  এটাই জানিনা কোন পুরুষে হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছি আর তার আগে কি গোত্র ছিল।" এবার আখতার মোল্লার গায়ে লাগলো কথাটা , "তুই মুসলমান হারামজাদা , এই তোর পরিচয়।  গোত্র কেন হতে যাবে।" রজত বললো , "রাগ কোরো না আখতার।  কথাটা ভেবে দেখো।  গোত্র তো ইসলামের পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে ছিল। পরে তো ইসলাম হয়েছে।  সবারই গোত্র আছে।  কিন্তু কালক্রমে ভুলে গেছে। সে শুধু তোমার মুসলমানরা নয় , বৌদ্ধ বা জৈনরাও তো গোত্র বলতে পারে না।" আখতার বলে , "থাক সে কথা। আমার এই বিয়েতে আপত্তি নেই। কারণ হিসেবে মতে ইসলাম ধর্মেরই প্রসার হচ্ছে।" রজত বলে , "আমার একটু ওই গোত্রে খুঁতখুঁত করছে কিন্তু গান্ধর্বমতে বিয়ে করলে তো আমার কিছু বলারই নেই।  শাস্ত্র তো উঠিয়ে নিয়ে বা মদ খাইয়ে বিয়েকেও মেনে নেয়।  ওই রাক্ষস আর পিশাচ বিয়ে আর কি।  মাঝে মাঝে ভাবি এতো ফ্লেক্সিবিলিটি দিয়েছে তাও লোকে কেন যে অন্য ধর্মের পেছনে ছোটে। " এই ছোট্ট টিপ্পনি রজত আখতারকে শুনিয়ে বলে।  আখতার উত্তর দিতে গিয়ে থেমে যায়।  পুরুষটা তার ধর্মে।  তাই জোর তার বেশি।  তাই বেশি না ঘাঁটিয়ে দুজনেই মত দিয়ে  দেয়। 

ঘটা করে দুই ধর্মের নিয়মেই বিয়ে হয়। ইদ্রিসের দেনমোহর ফিরে আসে যৌতুক হয়ে। এতদিন রুপা একবারের জন্যও প্রশ্ন করেনি ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাদের বিয়ে ধর্মসম্মত, তাই সর্বসম্মত। কিন্তু যখন বছর ঘুরতে না ঘুরতে একটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো তখন তার মনে প্রশ্ন এলো , "আমি তো হিন্দু , মুসলমান কে বিয়ে করেছি।  আমি তো সর্বংসহা হিন্দু তাই ধর্ম খোয়াইনি।  কিন্তু এ তাহলে কি? এ যদি হিন্দু হয় তাহলে সমস্যা নেই।  কিন্তু হিন্দুত্বেও তো বলে পিতার ধর্ম সন্তানের ধর্ম।  তাহলে। " ইদ্রিস চুপ করে থাকে।  রুপা ধর্মকর্মে বিশ্বাসী মেয়ে। তার সামনে মেয়েকে নাস্তিক বানানো সম্ভব নয়।  এক দু বার বলার চেষ্টা করে , "এ তোমার গীতা অনুসারে বিধর্মী। মানে বিশেষ ধর্মী।" রুপা গীতা পড়েনি।  ইদ্রিসও না।  শুধু রজত পন্ডিতের মুখে একবার শুনেছিলো ভাগবতে বি শব্দের ব্যবহার বিশেষ হিসেবে।  সেটাই ঝেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মদ্ভগবৎগীতার সাথে জুড়ে।  ব্যাপারটা রুপা খাইনি।  প্রতিনিয়ত এই তর্কবিতর্ক চলতে থাকে।  শেষে একদিন রুপা বলে ওঠে এবার যদি ছেলে হয় তাহলে সে হবে মুসলমান।  আর আমার মেয়ে হিন্দু।  ইদ্রিস খবরটা শুনে বিশাল খুশি।  মীমাংসায় নয়।  তারও এক পুত্রসন্তানের কামনা আছে।  কিন্তু প্রয়োজন নেই। 

মাস ছয়েকের মধ্যে মায়ের সমস্ত রূপ নিংড়ে নিয়ে আবার এক পরমাসুন্দরী কন্যার জন্ম দেয় রুপা। মেয়ের রূপে ইদ্রিস মুগ্ধ হয়ে যখন বাচ্চাটিকে নিয়ে সদ্যচেতন রুপার পাশে এসে বসে, তখন রুপা মুখে ফিরিয়ে নেয়। ইদ্রিস বলে , "স্নিগ্ধা তোমার হিন্দু মেয়ে আর এই নাজনীন আমার মুসলিম মেয়ে। শোধবোধ।" দু মাস বুকের দুধ থেকে বিরত থাকে নাজনীন।  রুপা কথা বলে না।  মেয়েকে কোলেও নেয় না।  ইদ্রিস অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই বুঝতে পারেনা রুপার এই ব্যবহারের কারণ। মা কি এই ভাবে নিজের বাচ্চার থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে থাকতে পারে। ইদ্রিশের অনেক বলা কয়ায় কোনও লাভ হয়না । শেষে রজত পণ্ডিতের কথায় তিন মাসের নাজনিন প্রথম মায়ের দুধ পায় । ততদিনে দুধও শুকাতে শুরু হয়ে গেছে ।  কিন্তু রুপার মনের কোনও পরিবর্তন নেই । ইদ্রিশ সকাল বিকাল নানা ভাবে চেষ্টা করে তার ভেতর থেকে কথা বার করার জন্য । ইদ্রিশ জানে কালশিটের রক্ত বার করে দিলে জন্ত্রনা কম হয়। কিন্তু রূপা জেন প্রায় মরে গেছে। এ কেমন ধারা সমস্যা। মেয়ে হলে বাবারা দুধে চুবিয়ে মেরে দেয় শুনেছি। কিন্তু এখানে তো ইদ্রিশ খুব খুশি । স্নিগ্ধা অনেকটা বাবার মত , কিন্ত নাজনিন তো একদম মায়ের রূপ পেয়েছে। কচি কচি হাতগুলো বারিয়ে যখন ইদ্রিশের দাড়িতে হাত বুলয় তখন ইদ্রিশের ইচ্ছা করে দাড়ি কেটে ফেলে নগ্ন গালে ওই নরম হাতের স্পর্শ নিতে । শেষে একদিন রুপাকে নিয়ে  পূর্ণিমার রাতে  গ্রামের নদীতে নৌকাবিহারে বেরোয়। 

রুপা অনিচ্ছা সত্বেও যায় । বিয়ের আগেও সে কয়েকবার গেছে । তার খুব প্রিয় এই নৌকাবিহার। ছল ছল করে জলের শব্দ ছাড়া আর অন্য কোনও শব্দ নেই। শুধু মাঝি আর সে । সে আর তার মাঝি বর । নদীর মাঝখানে গিয়ে হাল ছেড়ে দিলেও নৌকা এগতে থাকে জোয়ারের টানে।  কেউ ঝামেলা করতে আসে না । অন্য মাঝিরা পাড়ের দিকে মাছ  ধরে । কথার মাঝখানে গায়ের ওপর দিয়ে পিঁপড়ে চলে যায় না , ককিল ডেকে উঠে মন পালটে দেয়না, কুকুরের ঘেউ ঘেউ নেই , কেউ এসে মাঝখানে কাজের কথা বলেনা । শুধু দুইজন নিজেদের মধ্যে, নিজেদের মনে , নিজেদের কথা বলতে থাকে। 
দাঁর টানতে টানতে নৌকা নদীর মাঝখানে নিয়ে আসে ইদ্রিস। হাল ছারতেই দেখে নৌকা তীরের দিকে দউরাচ্ছে । সে শক্ত করে হাল ধরে বলে , "এবার বলো।  কি সমস্যা। নাজনীনের তো কোনো দোষ নেই।  এই ধর্মের চক্করে কেন ফেলছো তাকে। " এতদিন চুপ করে থাকা রুপা এবার বলে , "আমি ধর্মের জন্য নয়।  স্নিগ্ধার ভবিষ্যতের জন্য চিন্তিত।" ইদ্রিস অবাক হয়ে বলে , " কেন? " "সবাই তোমার আমার মতো হয় না ইদ্রিস।  আজ আমরা প্রেমের জন্যে ধর্মের জলাঞ্জলি দিয়ে সুখে সংসার করছি। আমাদের মেয়েদের যে তোমার মতো স্বামী মিলবে , কে তা বলতে পারে।" ইদ্রিস আরো অবাক , "কি বলতে কি চাও তুমি?" রুপার চোখ ছল ছল করে।  ইদ্রিস বুঝতে পারেনা কি এই দুঃখের কারণ।  কিছুক্ষন চুপ থাকার পর রুপা বলে , "আমি একটা ছেলে চেয়েছিলাম কেন জানো? যদি আমার স্নিগ্ধাকে কেউ বিয়ে না করে তাহলে যেন আমার ছেলে তাকে বিয়ে করে।" হাল ছেড়ে সোজা উঠে দাঁড়ায় ইদ্রিস , "তৌবা তৌবা।  কি বলছো রুপা।  এ তো হারাম।  পাগল হয়ে গেছো নাকি।" রুপা আরো অবাক হয়ে যায়।  এক অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠে , "কেন ? তোমার ধর্মে তো এসব চলে।" এবার ইদ্রিস রেগে যায় , "রুপা , আমি কখনো ধর্মকে আমাদের মধ্যে আসতে দিইনি।  তোমায় তাই কোনোদিন পবিত্র কোরান শরীফ পড়তে বলিনি।  তার মানে এই নয় যে তুমি যা ইচ্ছা তাই বলবে।" " কিন্তু মা তো তাই বলেছিলো" , "তোমার মা অজ্ঞান, শুনেছে হাতি, বুঝেছে ব্যাঙ, বলেছে টিকটিকি। আর তুমি কেন এই ধন্দে আছো যে আমাদের মেয়েদের কেউ বিয়ে করবে না?"

রুপা এবার কান্নায় ভেঙে পরে, "যখন তোমার সাথে বিয়ে হয়েছিল তখন কি আর জানতাম যে ওই রজত পন্ডিত আমায় শিবের মাথায় জল ঢালতে বারণ করবে। " "কৈ আগে তো বলোনি এই কথা।" "বলিনি কারণ তুমি দুঃখ পাবে বলে।  বিয়ের পরেই যখন গেলাম জল ঢালতে তখন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে - শিব তো পেয়ে গেছিস আর জল ঢেলে কি হবে। যা কাটা শিবলিঙ্গে সেবা কর।" ইদ্রিসের গেলো মাথা গরম হয়ে , "তুমি উত্তর দিলে না? আমি তো তার অমতে বিয়ে করিনি।" "কাকে কাকে উত্তর করবো। তোমার খালা যখন আসে তখন আমার হাতে খাবার খায় না। বলে আমার জন্য নাকি তোমার ঈদ নষ্ট হয়। বৌদি আমায় ঠাকুর ঘরে ঢোকানোর আগে গায়ে গোবর গঙ্গাজল মাখায়। তোমার আব্বু হজের টাকা কেন বিলিয়ে দিয়েছে জানো? আমার জন্য। কাফের কে ঘরে স্থান দিলে , মক্কায় যাওয়া যায় না।  তুমি আমাকে তিন তালাকেরও যোগ্য রাখোনি।  কারণ আমি ইসলাম অবলম্বন করিনি। তুমি যখন ক্ষেতে বীজ বোনো।  আমি দিন গুণি প্রাশ্চিত্যের।" "কিসের প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছো?" "রজত পন্ডিত বলেছে, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্য আমার বাচ্চার হিন্দু ধর্মের প্রচারের মধ্যে দিয়ে হবে।" "কি যা তা বলছো। এসব কে শেখাচ্ছে। এসব কোথা থেকে আসছে। আমি তো কিছুই মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না। আমরা তো সর্বসম্মতিক্রমে বিয়ে করেছি। তাহলে? রুপা ধর্ম মিথ্যা নয়, ব্যাখ্যা মিথ্যা। যারা বলছে সব স্বারথসিদ্ধির জন্য বলছে।  তোমার এগুলো আমাকে আগে বলা উচিত ছিল।" "বললে কি করতে ? তর্ক। পুরুষের পাপ লাগে না।  নারীকে সব পাপ সহ্য করতে হয়।" "আবার ভুল করছো রুপা।  তোমার নরেন মাস্টার অনেক বেদ  পড়েছে।  বলেছিলো তোমার ধর্মেই মেয়েছেলেদের  কোনো পাপ নেই। যা পাপ সব পুরুষের। কারে মানবো।" "ওর কথা মেনে কি হবে।  ও বলেছিলো , ধর্ম আফিমের মতো। ও নরকে যাবে।"

ইদ্রিস দেখলো ব্যাপারটা তার  হাতের বাইরে চলে গেছে।  ক্ষুদ্র জ্ঞানের স্বল্প নীতিবাক্যে  পরাস্ত করে যাদের  হাত দিয়ে ধর্মের নোংরামো সরিয়ে মানব ধর্মের আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করেছিল, সেই ধর্ম তার বিরুদ্ধে না গিয়ে সমাজ কে লেলিয়ে দিয়েছে তার পেছনে।  রুপা তখনও বলে চলেছে, "আমার একটা ছেলে হলে আমার কোনো ভয় থাকতো না।  কিন্তু তোমার বীর্যে দম নেই।  তাই তো নরম মাটি খাবলে তুলে গায়ে লাগিয়েছো।  ডাক্তার সায়েব বলেছে আমার কোনো দোষ নেই।  ছেলে হবে না মেয়ে হবে স্বামীর বীর্যের জোরেই হবে। " ইদ্রিস বুঝতে পারলো , আবেগের জোয়ার এসেছে।  মেয়েছেলের আবেগ বড় অদ্ভুত।  যখন বেরিয়ে আসে , তখন বইতে থাকে।  বাঁধলে ভাঙবে , তবু বইবে।  সে শান্ত হয়ে দাঁড় বইতে থাকে।   ঘাটে যখন ফেরে , কাঁদতে কাঁদতে রুপা তখন অচেতন।  কোনোরকমে কাঁধে তুলে ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দেয় রুপাকে।  পাশে শুয়ে নিয়তির কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পরে। 

সকালে উঠে কিছু না খেয়েই ক্ষেতে চলে যায়।  এবার সে পিয়াজ লাগিয়েছে।  বেশ বড় হয়েছে।  আর তার বিশেষ কাজ নেই পাহারা দেওয়া ছাড়া। এই সময়টা সে তার শব্দজব্দের ছেঁড়া পাতাগুলো খোলে।  গ্রামের লাইব্রেরিতে খবরের কাগজের সাথে আসে এই শব্দজব্দ। লাইব্রেরিয়ান গত দশ বছর ধরে তার জন্যে প্রত্যেকদিনের শব্দজব্দ কেটে কেটে জমিয়ে রাখে।  কত শব্দ , কত প্রশ্ন জাগায় মনে।  অর্ধেক পারে অর্ধেক খালি থাকে।  সেই নিয়ে বুধ আর শনিবার সে ছোটে মৃন্ময় সাধুখাঁর বাড়ি।  মৃন্ময় তখন আরাম কেদারায় বসে এক এক করে সব সমাধান করে আর এক এক করে শব্দের মানে বোঝাতে থাকে।  নয় ক্লাসের পর ইদ্রিস আর স্কুল মুখ হয়নি।  কিন্তু শব্দজব্দের এই মজায় আর মৃন্ময়ের তত্বাবধানে সে জানতে পেরেছে শব্দের পূর্ণসত্য না জানলে শব্দ কখনো জব্দ হয় না, ঘরগুলো ফাঁকা থাকে। মৃণ্ময় বলে এই শব্দই ব্রম্ভ।  আর তাকেই পূজা করা উচিত , যাতে এক সাথে জীবনের সত্য ও জীবন চালনের কূটনৈতিক অস্ত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ হয়। মৃন্ময় এই জমি হাসান মোল্লাকে দান করার পরের দিন হাসান ইদ্রিশকে নিয়ে আসে মৃন্ময়ের কাছে। মৃন্ময় তখন দালানে বসে শব্দজব্দ করছে। হাসান পরিচয় করিয়ে দিলে মৃন্ময় বলে , “হাসান, তুই যখন বলছিস তখন এ ছেলে ভাল। পরাশুনা কদ্দুর।” “আজ্ঞে নয় ক্লাস। তারপর নানা খেতে চাষ করি আর দুপুরে বই পড়ি” । মৃন্ময় খুব কম চাষি দেখেছে যারা পরতে লিখতে ভালোবাসে। “কি বই পরিস।” “যা পাই। নরেন মাস্টার মাঝে মাঝে একটা দুইটা বই বলেন পড়তে। অদ্ধেক মাথামুণ্ডু বুঝতে পারিনা। শুধু শব্দগুলো বলতে দারুন লাগে।” “তা একটা বইয়ের নাম বল দেখি।” “দুর্গেশনন্দিনী।” নামটা শুনে , মৃন্ময় দমফাটা হাসি হাসতে থাকে। এক চাষির কাছে বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, হাসির‍ই উদ্রেক করে । “তার মানে শব্দে তোর বেশ মজা লাগে।” “শুধু শব্দে নয় কত্তা, শিখতে খুব ভালো লাগে। যে শব্দগুলো বুঝিনা সেই শব্দগুলো নিয়ে জাই নরেন মাস্তারের কাছে। উনি এক এক করে সব বুঝিয়ে দেন, আর প্রত্যেক শব্দের ওপর গল্প বলেন। আমার গ্যান অতদুরই। বাকি কত্তা , আকাশ দেখ বলতে পারি কবে বৃষ্টি, মাটি দেখে বলতে পারি ক ফুট নিচে জল, বীজ ছুঁয়ে বলতে পারি কত ফসল তুলব।” মৃন্ময় বেশ খুশি হয়। আরও কিছুক্ষন কথা বলে সে বুঝতে পারে , যুবকটি বেশ কিছু জানে । কিন্তু সে জ্ঞানের কোনও মানে নেই । মৃন্ময় তাকে তার খেতজমির দায়িত্ত্ব দেয়। যেহেতু দান করেছে তাই ফসল তার নয় , হাসান মোল্লার । মৃন্ময় বলে, “বুধ আর শনিবার আমি বিকালে বাড়িতে থাকি। তুই রোজ গিয়ে লাইব্রেরি থেকে আগের দিনের খবরের কাগজের শব্দজব্দ কেটে আনবি । আমি বলে দেব দিপেশ কে। ওগুলো চেষ্টা করবি শেষ করতে, যা পারবি না , নিয়ে আসবি । সাথে করব । আর তোর নরেন মাস্তারের থেকে আমি বেশি ভালো গল্প বলতে পারি। বুঝলি।” সেইস্তক শব্দের মানের পিছনে ধাওয়া করতে করতে ইদ্রিশ সমস্ত কিছু সম্বন্ধে জ্ঞান নিতে থাকে মৃন্ময়ের কাছ থেকে। এক শব্দের পেছনে থাকে ব্যাখ্যা, ব্যখার পেছনে থাকে গল্প , গল্পের মিমাংশায় আসে প্রশ্ন আর প্রশ্নের উত্তরে থাকে শব্দ । গুরু শিশ্যের সেই সংলাপ থেকেই আজকেও সে চেষ্টা করতে থাকে আজকের শব্দজব্দের সমাধান করতে।   

বেশ কিছু সমাধান করতে করতে হঠাৎ করে খিদে পেয়ে যায় । দুপুরের পুঁটলিও তার সাথে নেই।  রাগ করে বের হয়ে আসলেও, ক্ষিদে আর ঘুম কোনো আবেগের দ্বারা চালিত হয় না।  জোর করে গাছের ছায়ায় ঘুমোনোর চেষ্টা করতে গিয়ে খিদের তাড়নায় সে উঠে পরে।  এতো বছরেও কখনো দুপুরে সে বাড়ি ফেরেনি, কারণ এখানের ক্ষেতচোররা রাতে চুরি করে না।  দিনে করে।  দুপুরে চাষির ঘুমোনোর সুযোগে আল বদলে যায় , শস্য নুয়ে পরে , সেচ জল বন্ধ হয়ে যায় , আগুন লেগে যায়।  তাই দিনের বেলায় সে সর্বদা সজাগ।  কিন্তু আজ সে আর পারলো না।  দ্রুত পায়ে এসে রোজকারের মতো দালানে বসে হাঁক দেওয়ার বদলে আজ সোজা ঘরে ঢুকতে যেতে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।  সন্দেহ ও সংশয় নিয়ে দরজায় সজোরে কড়া নাড়লো।  কালকের ঘটনার পর রুপার আত্মহননের প্রবল সম্ভাবনা।  তার ভয়দ্বিহল উত্তেজনা নস্যাৎ করে শান্ত ভাবে দরজা খুলে দিলো রুপা।  ভেতরে ঢুকেই খাটের ওপর রজত পন্ডিতকে  বসে থাকতে দেখে আজকের শব্দজব্দের না মেলা চার অক্ষরের শব্দের ফাঁকা জায়গায় সে মননে বসিয়ে দিলো "বেদব্যাস" আর মুখ থেকে ঘৃণাসূচক বাক্য বেরিয়ে এলো , "তুই নরকে যাবি ছিনাল।" 


No comments:

Post a Comment