বাড়িতে বলতেই খিঁচিয়ে উঠলো , “বাজারে যাবার নাম করলেই রোজ জ্ঞান দিচ্ছিস, আর আজকে তুই কি করছিস?” একদম হক কথা। লকডাউনের পর থেকে খেঁচিয়ে চলেছি বাবা মার ওপর, কিন্তু আজ আমাকেই বেরোতে হলো দুধ নেওয়ার জন্য। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধ্বস্তাধ্বস্তি করে বেশ কিছু খাবার জোগাড় করে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছি। কিন্তু কিছু জিনিস আনতে যে যেতেই হচ্ছে।
কেন ? অনলাইন অর্ডার করলে হয় না। অবশ্যই হয়। পৃথিবীর বহু লোক তো তাই করছে। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক ততটা অনুকূল নয় আমার এই শহরে। সেই বলতেই এই লেখা।
আমি যে শহরে থাকি , সেটি একেবারেই রেসিডেন্সিয়াল। নাম করা দোকান বলতে কিছুই নেই। যা আছে, তা ঠিক পাশের শহরে। যা দূরে না হলেও সফটওয়্যারে কিন্তু জিপকোড যা সেট করা থাকে তাই দিয়েই ডেলিভারি বিচার হয়। তাই আমার বাড়িতে ডোমিনোসও আর ডেলিভারি করে না।
আমেরিকায় হোম ডেলিভারি কোনোদিনই দেশের মতো দারুন ভালো ছিল না। তার কারণ , আর কিছুই নয় , অতিরিক্ত লেবার চার্জ , যার জন্য আমরাও এদেশে পরে আছি। এখন এই কঠিন সময়ে সবাই আমরা উদার হয়ে হাতে পয়সা নিয়ে যদিও বসে আছি ডেলিভারির জন্য কিন্তু সময় বদলালে আমরাও হাত গুটিয়ে নেবো। এখন তাই আমাদের সার্ভ করতে ডেলিভারি বয় গার্ল দের নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে যাচ্ছে , এদের আবার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে সময় যখন বদলাবে।
এখন আছে প্রাণের ভয়। শুধু নিজের নয়, একবার ভাবুন তো এই মানুষ গুলোর কথা। তারা আজ পেটের দায়ে এই ভয়াবহ সময়ে রোজ কাজে বেরোচ্ছে। আর জানা না জানা দোকান থেকে জিনিস তুলে বাড়িতে বাড়িতে ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে। সবাই নিজের দরজায় এখানে “Thank You” লিখে রাখছে শুধু এই লোক গুলোর জন্য।
এখন সমস্যা হলো সাধারণ ভাবে অর্ডার ডেলিভারি করার জন্য যে পরিকাঠামো থাকে বা আছে , সেটা প্রচন্ড ডিমান্ডের চাপে প্রায় ভেঙে পড়েছে। এমনিতেই আমেরিকা ভিড় সামলাতে একেবারেই পটু নয়। তবু পিজা অন্তত আগে তাড়াতাড়ি ডেলিভারি হতো । কিন্তু এখন সেটাও প্রচুর সময় লাগাচ্ছে।
ওয়ালমার্টে খুব সুন্দর গ্রসারি পিকাপ এর ব্যবস্থা আছে। অ্যাপ থেকে অর্ডার করে দিন , কর্মচারীরা পিকআপ করে গাড়িতে এসে তুলে দিয়ে যাবে। কিন্তু এই পিকাপের জন্য সারাদিনের একটা নির্দিষ্ট শ্লট আছে। মানে নটা পাঁচ থেকে নটা পনেরো আপনার টাইম, যা আপনি বুক করেছেন। কিন্ত সারাদিনের সমস্ত স্লট প্রত্যেকদিন ভরে যাচ্ছে। আমি দিনের পর দি চেক করে করেও স্লট পাচ্ছি না।
ইন্সটাকার্ট বলে একটা ওয়েবসাইট আছে , যা সাতদিন পরে ডেলিভারি দিচ্ছে এবং ওয়ালমার্টের দুদিনের বদলে সাত দিনের শ্লট দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার জিনিসপত্র প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ইনস্টকার্ট এ।
আমরা তো যা কিছু খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবো কিন্তু ছেলেটা ছোট। তাই দুধ ডিম আর কিছু সবজি তো লাগবেই। দুধ ডিম নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে জানতে পারলাম মিল্কম্যান বলে একটা লোকাল ডেয়ারী দুধ, ডিম্, পাউরুটি , বাটার আর চিস ডেলিভারি করছে। অতি উত্তম , ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠে দাম দেখে বুঝতে পারলাম সবার জন্য সব কিছু না। আমি যেখানে থাকি সেখানে, এদিক ওদিক থেকে টেসলা টুকি টুকি খেলে। এ তাদের জন্য, আমার জন্য নয়।
পেলাম পি-পড বলে স্টপ এন্ড শপ বলে একটা গ্রোসারি স্টোরের ডেলিভারি সিস্টেমের খোঁজ। সেখানেও ডেলিভারির সেই লম্বা লাইন। এই এতো তুলকালাম , তার একটাই কারণ আমাজন ফ্রেশ বা আমাজন প্যান্ট্রি আমার শহরে ডেলিভারি করে না।
অগত্যা , মাথায় পালকের টুপি , হাতে বল্লম , চোখে ভয় , আর যুদ্ধের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে সেইটা হাতের মুঠোয় ধরে এক্সিলারেটরে চাপ দিলাম। মাস্ক তো এতদিন হলো কিনতে পারিনি। তাই দেশের স্টাইলে রুমাল মুখে বাঁধতে গিয়ে দেখি বড় রুমাল নেই। এখানে যেহেতু ধুলো নেই , তাই রুমাল রাখার অভ্যাস ও নেই। দেশে কিনেছিলাম দু চারটে রুমাল , সেটাই স্যুটকেস থেকে বার করে নিয়ে দেখি এই কেস। তারপর আর কি , “সেফটিপিন জিন্দাবাদ”। মুখই দেখা যাবে না তো মাথার পেছনে সেফটিপিন গোঁজা দেখে মুচকি মেরে হাসা লোকেদের কটাক্ষে লজ্জিত হওয়ার কিচ্ছু নেই।
গাড়িটা দাঁড় করিয়ে মুখোশটা ভালো ভাবে পড়লাম। তারপর হাতে বাসন ধোয়ার ভিনাইল গ্লাভস পড়লাম। সেখানেও চিত্তির , এই গোদা হাতে কি আর গিন্নির মিডিয়াম গ্লাভস ঢোকে, লার্জ পাইনি। স্পাইডারম্যানের কষ্ট সেদিন বুঝতে পারলাম। কানে ইয়ারফোন আগেই গুঁজে দিয়েছি যাতে যদি ফোন আসে তাহলে কষ্ট করে ফোন তুলতে হবে না।
সেই রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে যেই শপিং কার্টে হাত দিলাম , প্রচন্ড ভয় এসে চেপে ধরলো। নিঃস্বাশ- প্রস্বাস দ্রুত হতে লাগলো। এক অসহায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকানের ভেতরে ঢুকলাম। মনে হলো এই মাত্র পুলিশে ক্যাদানে গ্যাস ছেড়ে গেছে। সবাই আমার থেকেও অভিনব মাস্ক লাগিয়ে ঘুরছে। যারা লাগায়নি , তাদের হাতে অন্তত গ্লাভস, সেও নানা তার রূপ।
একটা জিনিস দেখে কষ্ট লাগলো , এই অসময়ে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ বাজার করতে এসেছেন। এই ভাইরাসের সবথেকে বড় টার্গেট এরাই। কিন্তু আজ তাদের বেরোতে হয়েছে যেহেতু কেউ নেই তাদের কাছে। কেউ নেই তাদের জন্য বাজার করে দেওয়ার। আমার বাবা মাও ঠিক এইরকম করে বাজার করছে।
সোশ্যাল ডিস্টেন্স বজায় রাখার জন্য খুব সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা এক মুখী তীর আঁকা আছে মেঝের ওপর। সেটা ফলো করে চললেই সমস্ত আইল ঘুরে ঠিক চলে আসবেন ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে। তাহলে সবাই সবার থেকে অন্তত বেশ কিছুটা ব্যবধান রাখতে পারেন। কিন্ত আমার মতো বেশ কিছু লোক সারা দোকানে ঘোরার মুড নিয়ে আসেনি। তারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। পকাপক জিনিস তুলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে তারা মুখিয়ে আছে।
কি মনে হলো আমি ওদের দল থেকে বেরিয়ে ওই লাইন ধরে পর পর আইলগুলো দিয়ে ঘুরতে লাগলাম। লোকে বেশ কিছুটা ব্যবধান রাখছে। স্যানিটাইজার নেই , হ্যান্ডওয়াশ খালি , ডিসিনফেক্টিভ ক্লিনার শেষ , ওয়াইপ শেষ , ফ্রোজেন ভেজিটেবল শেষ , চিকেন শেষ আর যা যা চাইছিলাম তার বেশির ভাগই শেষ। বেশিদিন চলে বলে টাটকা সবজির মধ্যে ফুলকপি , বাঁধাকপি , স্কোয়াশ , কুমড়ো , আলু , শালগম , গাজর , বিট সব শেষ। দুধ ডিম আর কিছু সবুজ ভেজিটেবল তুলে নিলাম। মনে পড়লো গিন্নি মেসেজ করেছে লিস্ট। কিন্ত এখন সেই মেসেজ খুলতে আমাকে খুলতে হবে গ্লাভস। যা কিছুতেই সম্ভব নয়।
দোকান থেকে বেরোতে চিন্তা এলো এবার গ্লাভস খুলে কি স্টিয়ারিংয়ে হাত দেব ? না গ্লাভস পরে। গ্লাভস খুলে গাড়িতে বসলে স্টিয়ারিংয়ে হয়তো করোনা লাগবে না। কিন্ত যখন জিনিসগুলো নামাবো তখন তো হাতে লেগে যাবে। আর যদি গ্লাভস পরি , তাহলে স্টিয়ারিংয়ে লেগে যাবে। তাহলে প্লাস্টিকের ওপর টিকে থাকা করোনা , তিন দিন পর্যন্ত গাড়ির মধ্যে ঘুরঘুর ঘুরঘুর করবে। আর আমার নাক থেকে এক হাতের মধ্যেই ঘুরে বেড়াবে। কিন্ত যদি খুলে রাখি তাহলে বাড়ি গিয়ে আবার পরে কিনেআনা জিনিস বাড়িতে রাখতে রাখতে ভুল করে একবার নাকে হাত দিলেই সব শেষ। অনেক কিছু চিন্তা করে , প্রায় দম বন্ধ করে দোকান থেকে বাড়ি ফিরলাম গ্লাভস পরেই।
যে জিনিস খারাপ হবে না , সেই জিনিস গুলো পরে থাকলো গ্যারেজে, পরের তিন দিনের জন্য। আর বাকি সমস্ত জিনিসকে ডিসিনফেক্টিভ দিয়ে পুঁছে এক এক করে তুলে রাখা হলো ঘরে। সে দুধ হোক কি সবজি এখন সব কিছুতেই ব্লিচিং এর গন্ধ। যখন বাইরের জামা কাপড় বাইরে ছেড়ে গরম জলের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে।
ওই তিন গ্যালন দুধ শেষ হতে আর ৯ দিন।
No comments:
Post a Comment