সকাল তখন হবে হবে করছে। ডাইপার প্রায় উপচে উপচে পড়ছে। জানলার বাইরের আলো, ঘরে
ঢুকবে ঢুকবে করছে। ঠিক তখনি
বেজে উঠলো মায়ের ফোন। না না ,
কেউ ফোন করেনি। কিন্তু
বেজে উঠলো। আমি অনেক্ষন ধরে মা কে লাথি মারছি। ইশ , কি বাজেইটাই না শোনালো কথাটা। না-না, আমি লাথি মারিনা। ওই খেলছিলাম আর কি।
আমার সকাল সকাল ঘুম ভেঙে
যায়, কিন্তু মা নড়ে না , চড়ে না , ঘুমাতে থাকে। বাবা সেই
কখন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চলে গেছে। একটু পরে
ফিরবে ঘেমে নেয়ে স্নান করে। আমি
ততক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি , দু চারবার ওয়ান টু থ্রি করি। আর যা যা জানি , সে সব আরেকবার আউড়ে নি, তারপর মায়ের
গায়ে গা ঘষতে থাকি। মা ঘুমিয়ে
থাকে। কিন্ত কতক্ষন আর ঘুমন্ত মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে বোর
হওয়া যায়। তাই কখনোও কখনো মায়ের মুখে থাবা মারি। খুঁচিয়ে দি আইটাকে। মা কিন্তু
এখনো জানে না যে আমি জানি কোনটা আই, কোনটা নোস। আর
কয়েকদিন যাক। তারপর একেবারে খুলবো। চোখের
মধ্যে খুঁচিয়ে দিলেই মা চিৎকার করে উঠে চেপে চুপে ধরে আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা
করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, কিছুক্ষনের জন্য। কিন্তু
সেদিন আর ঘুম হলো না। ফোনটা
নিয়ে টাইম দেখতে গিয়ে দেখে আবার সেই উইচটা কিছু বলেছে।
ওহ তোমাদের তো বলাই হয়নি। আমার বাড়ির নিচের তলায় একটা উইচ থাকে। আমি যখনি দুম দুম করে লাফাই। তখন সে রেগে যায়। ও যদি খুব
রেগে যায় , তাহলে মায়ের ফোনে কিছু একটা পাঠিয়ে দেয় আর মা আমাকে চুপ করানোর জন্য
বলে , "কিপ কোয়াইট।" আমিও তখন মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলি , "শ শ শ শ -
কিপ কোয়ায়েট " সবাই চুপ করে যায়। কিন্তু
আবার সব কিছু শান্ত হয়ে গেলে আবার আমার জাম্প জাম্প শুরু হয়ে যায়। আর হবে নাই বা কেন , উইচটাকে তো মা বাবা গিয়ে চকোলেট
দিয়ে এসে বলেছিলো যে আমি জাম্প করলেই একটা চকো খেয়ে নিতে , তাহলে আমার মতো খুশি
হয়ে যাবে। কিন্তু সে কি আর শোনে। মাঝে মাঝেই নিচ থেকে খোঁচা মারে বা মায়ের ফোনে কথা
পাঠায়। আমি বিশেষ কোনকিছু চাপ নিই না , আমার কাছে উইচ এর
থেকে বিংগো বেশি ইম্পরট্যান্ট। আর বিংগো যখন জাম্প করছে, তখন আমায় তো সঙ্গ দিতেই হবে।
বাবা ফিরে আসতে মা বাবাকে ফোনটা দেখালো। বাবা আমাকে
ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো, "কি রে , তোর জন্য এবার পাড়া প্রতিবেশীদের
কাছ থেকে কথা শুনতে হবে? " বাবা কি আর জানে , যে আমি বুঝে গেছি , যে কি বলতে
চাইছে। কিন্ত এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি করলাম? জন্মদিনের পার্টি হয়ে যাওয়ার পর থেকে তো আমি প্রায়
শান্ত হয়েই আছি। একটু আধটু
গাড়ি নিয়ে খেলছি। ক্রেয়ন
পেয়েছি , তাই নানা দেওয়ালে দাগ দিয়ে বেড়িয়েছি , জিনিস পত্র একটু ফেলে টেলে দিচ্ছি
, কিন্তু আওয়াজ তো করছি না। তাহলে কে
আমার নামে বাবাকে এসে বললো। এটা
নিশ্চই সেই নিচের তলার উইচ।
মা কে ডেকে বাবা বললো , " নাঃ এবার মোকাবেলা
করতে হবে। আধ্যান এইটুকু করবে না ? বাচ্চারা এইটুক না করলে তো
আর বাচ্চা থাকে না। " আমি হাঁ করে শুনে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম। আরে না না , দুঃখে না , আনন্দে। বাবা আমার হয়ে কিছু বলতে চলেছে। কারো সাথে মোকাবেলা করতে চলেছে, আর কি চাই। আমি যে দোষী নই এবং বাবা সেটা একনলেজ করেছে , সেই
আনন্দের অনুভূতি আমি কিছুতেই লিখে বোঝাতে পারবো না।
সেদিন কিছু হলো না। কিন্ত
পরের দিন সকালে ডে কেয়ারে যাওয়ার জন্য বেরোবো , দেখি দরজার সামনে চিঠি পরে আছে। বাবা মা কে বললো যে , "এসে গেছে। তুমি যাও অফিসে
আমায় কথা বলতে যেতে হবে দুপুরে।"
আমি সারাটা দিন ডে কেয়ারে একটা আতঙ্কে থাকলাম। এই নিয়ে চারবার। ওয়ান টু
থি ফোর। নিচের তলা থেকে কমপ্লেন এলো। আসলে পাঁচবার। একটা আমার
কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে বাবার ঘাড়ে চেপেছিল। কিন্তু এই
চারটে একেবারেই আমার নিজস্ব। আমি নাকি প্রচন্ড আওয়াজ করি। আর তাতে নাকি নিচের তলার প্রচন্ড কষ্ট হয়। ব্যাপারটা তাহলে আমি গুছিয়েই বলি।
বিংগোর
কথা তো আগেই বলেছি। টিভিতে
যখন বিংগো চলে তখন আমার ইচ্ছা করে বিংগোর মতো খেলা করতে। যত দিন বাড়তে লাগলো, বিংগোর জায়গায় তত অন্য অন্য অন্য
এনিম্যাল আসতে লাগলে। সবাই
কিন্তু লাফায়। এমনকি আপ্পু গুলোও। আমি
প্রথমে জাম্প করতে পারতাম না। অনেক
কষ্টে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করতাম, যদি একটু লাফানো যায়। কিন্তু ভয় লাগতো। মাঝে বেশ
কয়েকবার চেষ্টা করতে করতে পরেও গেছি। কিন্তু
চেষ্টা থামাইনি।
একে বাবা মা আমার ভোকাবুলারি বুঝতে পারে না। তার ওপর ,লাফাতে চাইছি , আর পারছি না। ভারী বিরক্ত হয়ে যেতাম। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতাম ভারী কিছু জিনিস তোলার
জন্য। বেশ কিছু ভারী ভারী গাড়ি
দিয়েছিল সবাই আমার জন্মদিনে। সেগুলো
তুলে ফেলার চেষ্টা করতাম। যদি উঠতো,
তাহলে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম। এটা আমার
খেলা ছিল না। রাগ কমানোর একটা উপায় ছিল মাত্র। ওদিকে তখন আমার রাগের আগুনে ঘি দিলো , "ইফ ইউ
হ্যাপি এন্ড ইউ নো ইট স্টম্প ইওর ফিট।" আমি তো সবসময় হ্যাপি। তাহলে আমি স্টম্প করবো না কেন ? কেন - কেন - কেন - কেন ?
ঘরে স্টম্প করতে গেলে মা বাবা দুজনেই ঝাঁপিয়ে পরে তুলে
নিয়ে চলে যেত। তাই ঘরের বাইরে যেখানে পারতাম সেখানেই স্টম্প করা
আরম্ভ করলাম। কিছু জায়গা আছে , সেখানে স্টম্প করলে বেশ সুন্দর
আওয়াজ হয়। গমগম করতে থাকে। যেমন ধরো
সিঁড়ির জায়গাটা। স্পেশালি
সিঁড়ির ওপর স্টম্প করলে যতটা আওয়াজ হয় ততটা কিন্তু হয়না যখন ঘরের কার্পেটের ওপর
করি। তাই যখনি বাড়ির বাইরে বেরোতে লাগলাম তখনই আমি আটকে যেতাম সিঁড়িতে। শুধু বাড়ির সিঁড়ি নয়, যেকোনো জায়গায়। আমি দেখেছি , যে জিনিস
চকচক করে , সে জিনিসের ওপর স্টম্প করলে অন্য ধরণের আওয়াজ হয়। তাই যা দেখছি তাতেই পা ঠুকে চলেছি। এমনকি জলের ওপর স্টম্প করলে একটা অন্য ধরণের আওয়াজ
হয়। আর সাথে জল ছিটকে পরে। সে যাইহোক। মোদ্দা
কথা আই ওয়াজ এনজয়িং স্টমপিং।
স্টম্প রুখতে শেষমেশ মা একটা বিচ্ছিরি উপায় বার করলো। টিভির সামনের একটা মোটা লেপ রেখে দিলো। এবং সেই একই
দিনে, তালে-গোলে, আমি সোফা
থেকে মারলাম এক লাফ। আর সুন্দর
ভাবে ল্যান্ড করলাম ওই লেপের ওপর। আরিব্বাস।
বার করে ফেলেছি ছকটা। মেন্
খেলাটা "নি" এর। ফোল্ড ইট
, হোল্ড ইট এন্ড থ্রো ইট। টুক টুক
করে লাফাতে আরম্ভ করলাম। শুরু হলো
আমার লাফানোর জীবন। সে যে কি
আনন্দ তা আর বোঝাই কি করে। একটু
লাফিয়ে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে। হঠাৎ করে
কিছুক্ষনের জন্য অনেকটা বেশি দেখতে পাবে। হঠাৎ করে
এমন কিছু দেখতে পাবে, যেটা অনেকদিন ধরে দেখার চেষ্টা করছো। অনেক কিছু দেখতে পাবে, যা মা সরিয়ে রেখেছিলো তোমার থেকে। সব মিলিয়ে, আমি যেন স্বর্গ পেলাম হাতে। যদিও ব্যাপারটা পায়ে পেলাম। কিন্তু সেই স্বর্গের দ্বারে দাঁড়িয়েছিল দুই মহিলা, এক আমার মা আর নিচের তলার উইচ।
মা যে কোনো ভাবে আমাকে জাম্প করা থেকে আটকাবে আর যদি
ফেল করে তাহলে নিচের উইচ মা কে মনে করিয়ে দেবে যে মা ভুলে গেছে আমাকে আটকাতে। সেদিন সকালবেলায় সেটাই হলো। আমি নাকি তার আগেরদিন এতো লাফিয়েছি যে ওরা ঘুমোতে
পারেনি। বাবা যখন কথা বলতে গেলো তখন ওখানে নাকি রেকর্ডিং দেখিয়েছিলো। বাবা উল্টো
আওয়াজ দিয়ে এসেছে। বলেছে
ফ্লোর ঠিক নেই। সত্যিই তো
নেই। আমি যদি এইটুকু জাম্প করতে নিচের হুইচের ঘুম ভেঙে যায়
তাহলে সেদিন যখন আমার বিশাল বাবা খাট থেকে পরে গেছিলো সেদিন তো বাবার ফ্লোর ফুঁড়ে
নিচে ঢুকে যাওয়ার কথা। কিন্তু
যায়নি তো।
পরের দিন বেশ কিছু বিশাল বিশাল লোকজন এলো বিশাল বিশাল
মেশিন নিয়ে। তারা অনেকবার মেঝের ওপর লাফালো টাফালো, মেশিনগুলো নিয়ে কি কি সব করলো। আর তারপর বলে চলে গেলো যে কিছু হবে না। মেঝে একেবারে গেছে। এইবার
আমার হোয়াইট বল, ওদের
কোর্টে। কিন্তু বাবা বললো সমস্যা দুপক্ষেরই , তাই নিজের
সমস্যা আগে সমাধান করতে হবে। রেজাল্ট ,
আবার সেই নো আধ্যান , নো - নো - নো আধ্যান, নো নো নো নো নো নো আধ্যান । এদিকে আমার ফাইভ
লিটিল মানকি জাম্পিং করে যাচ্ছে আর আমি জুল জুল করে তাকিয়ে আছি।
আচ্ছা তোমরাই বলো , জাম্পিং তো একটা ডেভেলপমেন্টাল
মাইলস্টোন নাকি। যদি ঠিক
টাইমে না জাম্প করতাম তাহলে তো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে
হতো । এই উইচ গুলো কোথা থেকে আসে জানিনা বাপু। আর উইচ
তাড়ানো তো বাবা মার কাজ , তাহলে কেন আমাকে আটকানো হচ্ছে। আমার খুব দুঃখ হলো। কিন্তু কি
করা যাবে , নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে হবে। আমি এখন
শুধু সোফা থেকে তোষকে জাম্প করি , আর মা বিছানা পাততে গেলে খাটে জাম্প করি , ডে
কেয়ারে জাম্প করি , রাস্তাঘাটে জাম্প করি , কিন্ত কার্পেটে জাম্প করিনা। আর সাথে বাবা মা কে দেখাতে থাকি যে আমি খুব দুঃখে
আছি। কিন্তু বাবা মা অনড়, কারণ
পাঁচবার কমপ্লেন আসলে নাকি কি সব লিগ্যাল , টিগ্যাল নোটিস আসবে। আর সেটা নাকি খুব খারাপ হবে। দেখা যাক কত দিন টানা যায়।
No comments:
Post a Comment