সকাল
সকাল তুলকালাম ঝগড়া করে আব্দুল কালামের এর মত নিরীহ শাবক হয়ে অফিসের বিজ্ঞানমনস্কতায় নিজ প্রাণ উৎসর্গ
করেছি ৷ কিন্তু সারাদিন কেমন যেন একটা আনচান ভাব ৷ সারাদিন কাজে মন বসলো না ৷ টুক
টাক কাজ করতে করতে সব সময় মনে হচ্ছে কি যেন একটা পাচ্ছে ৷ বমি , বিষ্ঠা , মুত্র
কোনো টাই নয় …৷ তবে মনের এই আচরণটা ঠিক কেন তা
বুঝলাম না ৷ ঝগড়ার মহাভারতের ব্যাখা ছেড়ে চোখ বুজে মনে মনে অনেক কিছু সুন্দের
জিনিসের চিন্তা করতে লাগলাম ৷ ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা পারফিউমটা একটা হাতে মারতেই
চারপাশে গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ৷ আমার উল্টো দিকের কিউবিকাল থেকে সুন্দরী কলিগ একটু উফ
আফ করে উঠলো বটে কিন্তু রোমন্থন হলো না ৷ প্রচন্ড বিরক্তি ভরে ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজেকেই দেখতে লাগলাম ৷ হঠাৎ সেই জিনিস টা
পেয়ে গেল খুব জোরে যা এতক্ষণ একটু একটু পাচ্ছিল কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না ৷
এমন
মুখের পানে চায় কোনো রূপসী,
গুগলি
মরা মাছ শুষ্ক সরসী ৷
মনের
মধ্যে দুটো লাইন কোথা থেকে চলে এলো ৷ আমি বুঝলাম কবিতা পেয়েছে ৷ এই কবিতা আমার
মাঝে মাঝে পায়। আর যখন পায়, তখন ব্লগ , ফেসবুক , লোকেদের কান আর আমার গিন্নির
মাথায় উকুনের মত ভরে যায় সেই বেমানান ছন্দের মাধুকরী ৷ কবিতার গুঁতোয় সবাই অক্কা
৷ কিন্তু কিছু করার নেই, মল , মুত্র , বমন , ক্ষুধার মতই আমার কবিতা পায় ৷ মনটা
খুশি হয়ে যায় ৷
গিন্নিকে
ফোনে লাগলাম ৷ গিন্নির ফোন ভয়েসমেলের দুয়ার খুলে চেচিয়ে উঠলো , " ঢোক
এখানে",
গিন্নি
ধর ফোন
লাইন এ
আপনজন ৷
এইটুকু
বলে ছেড়ে দিলাম। বিকেল
তখন চারটে, আরো একঘন্টা অফিসে বসে থাকতে হবে ৷ আমার এরকম অবস্থায় তখন আমি যাকে
পাই তাকে ধরে কবিতা শোনাই ৷ মুখ দিয়ে অনর্গল কবিতা বেরিয়ে চলে ৷ কিন্তু বিদেশী
অফিসে আমার বাংলা কবিতা শোনার জন্য কোনো সর্ষের তেল মারা কান নেই ৷ এক আছে আমার
বসের বস, যে বাঙালি ৷ কিন্তু বড় খ্যাটখ্যাটে ৷
আর্ট বলতে তার কাছে পাওয়ারপয়েন্ট এর ঘ্যানঘ্যানে এনিমেশান ৷ কিন্তু আমার সাথে ভালই
গল্প করে তাই অফিস চ্যাটে লিখলাম ৷
বারে
বারে নিম্নচাপ করছি নিবারণ,
বমন ,
বিষ্ঠা একই সাথে কর্মে নাহি মন ৷
রিপ্লাই এলো ,
“ ছন্দ
লেখা বড়ই সোজা শুধু মেলাও হেড আর টেল ৷
চার পাশে
না গন্ধ ছড়িয়ে যাও গো টু হেল। ”
ওরে শালা
!! ৷ মালটার তাহলে রস
বোধও আছে ৷ যদিও যা লিখেছে তার সত্তর ভাগই পচা জল ৷ কিন্তু আমার তখন দাড়িওলা কবির
মত অবস্থা ৷ পুরো ঝুলে গেছি ৷ অফিসের স্টিকি
নোটে লিখে ফেলেছি ৷
“আজকে
নাহি থামিবো আমি ,সৃষ্টি করিব ছন্দ ,
খুলিব
সেসব চক্ষু দুয়ার , গদ্য দ্বারা অন্ধ ৷”
“কালকে
আমার প্রচুর কর্ম ক্রিয়াপদ দিয়া মাপি,
অষ্টবক্র
শরীর
দুলায়ে প্রচন্ড জ্বরে কাঁপি ৷”
“কি
সব লিখছি নিজেও জানিনা কাব্য তবু হাতে,
বোঝা না
বোঝা পাঠকের কাজ , আমার কি এসে যায় তাতে। ”
কোনো
রকমে ব্যাগ টা গুছিয়ে সোজা বাড়িতে ৷ রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে উগলোলাম ,
“কেন রে
তোরা বাঁধছিস মোর পথ , সিগনাল করে লাল ,
শুধু
নিয়মের ঘেরাটোপ এ বেঁধে করেছিস এই হাল ৷
যদি হয়
মোর দেরী , যদি বাড়িতে দেখি যে তালা,
ওরে ইঞ্জিন শব্দ থামা, কান করে ঝালাপালা।
ওরে এ সি
, তোর বড্ড বেশি শীতল হাওয়া , বক্ষে মৃত্যু তোর,
অডিও
প্লেয়ার বাজরে জোরে , আজিকে যে দিন তোর ৷
এক্সিলেটর
বসে
পর তুই , স্টিয়ারিং থাক ঘুরতে,
ওয়াইপার তুই ঘষে যা কাচ তেল থাক তুই পুড়তে ৷
ব্রেক
তোকে আজ লাগছে না ভালো, শুধু লাল বাতিতে বাধ্য,
আজকে যেন
উইন্ডশীল্ডটাও টাও ,না থাকিলে পারত ৷”
তিন চার
বার ঘন্টা বাজানোর পর ঘুম ঘুম চোখে গিন্নি দরজা খুলে দিল ,
হে নারী
৷
আমি
এসেছি তাড়াতাড়ি।
সঙ্গে না
ছিল চাবিখানি মোর,
তাইত
তুমি খুলিয়াছ দোর.
নয়ন
সমুখে তোমা মুখখানি,
করপুট
ধরে করে আবাহনী।
চাহিতেছি
ওই ললাট স্পর্শ,
মনে
আজিকে আমার পরম চরম হর্ষ …৷৷
“কি হলো
গো তোমার ৷” বউ ভেবড়ে গিয়ে ঘুম চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো, “অফিস থেকে এত আগে চলে
এলে?”
“আর
না করিব অফিস, কর্মে নাহি মন,
তোমার
সাথে সোহাগ করিব গাইব সারাক্ষণ ৷”
“মরণ …
বলবে কি হয়েছে ? হঠাৎ কবিতা আউরাচ্ছ কেন ? ”
“ইহা
সৃষ্টি ৷ আউরানো নহে ৷ বুঝতে শেখো হে নারী,
গৃহ
কর্তা আসিলে ঘরে ,দাও শরবত তাড়াতড়ি ৷ ”
“অফিসে
নিশ্চয় প্রচুর গাঁতন খেয়েছ ৷ মাথা বিগড়ে
গেছে ৷”
“বিগড়ানো
মাথা আজকের নয় কাহিনী,
পেরিয়ে
গেছে সহস্র বিনিদ্র যামিনী ৷
বেচিয়াছি
আমি ফুটপাতে এই ঘর্ম ঝরা মস্তক,
সকল আনন্দ ছাড়িয়া আমি পড়িয়াছি শুধু পুস্তক ৷
তোমার
তনু গিলিয়াছে ক্রীম , আমি ফর্সা হয়েছি
ফেটে
তোমার
অঙ্গে ডাবর মধু , আমি ক্ষুদ খাচ্ছি চেটে। ”
গিন্নি
বলে উঠলো , “কি বলতে চাইছটা কি ?”
“কিছু
নহে আমি বলিতে চাই ,
এসো আজ
মোরা দুজনে মিলিয়া ,
ব্যালকনিতে
তে
সিঙ্গারা খাই … ”
“তুমি কি
এরকম করেই কথা বলবে আজকে ? ”
“কেন সখী
কর রাগ ৷
আগে খুলি
মোর জুতা,
হৃদয়ে আজিকে অনুপম খুশি,
পেটে তবু
বড় ক্ষুধা ৷”
“কি খাবে
? শরবত না হয় করে দিচ্ছি ৷ মুড়ি মেখে দেব ?”
“শত
সহস্র যোজন পেরিয়া , সাত মহাদেশ ঘুরি
সকলি
ছাড়িয়া আসিয়া হেথায় চিবাইব কি মুড়ি ? ”
“রাতে
লুচি বানাবো ৷ এখন কম করে মুড়ি মেখে দিচ্ছি, পিঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ৷ ভালো
লাগবে ৷ বাড়ির চানাচুর ও আছে ৷”
“তুমি
লোভ দেখাও মোরে৷
পিঁয়াজ
দিয়ে করবে নরম মুড়ির অন্তরে??
হায় রে
মুড়ি , কত অপমান লুচির জন্য সইবি ,
হালকা
শরীর পাপড়ি সম আর কত ভার বইবি ৷ ”
“এহ্হঃ …
তোমার এই ন্যাকামো আর ভালো লাগছে না ৷ মুড়ি খাবে তো খাও নাহলে আমি আর কিছু করতে
পারব না ৷ আমি ট্রেনিংয়ে যাচ্ছি ৷”
“আজকে
নাহি যাও হে সখী একলা করিয়া মোরে ,
কেমন করে
কাব্য করিব একলা রিক্ত ঘরে ৷”
“তোমার
কাব্যের কাঁথায় আগুন ৷ মা ঘুম থেকে উঠলে মা কে ফোনে শুনিও তোমার কবিতা ৷”
“ঠিক আছে
সখী,
দিবস
রাতি , যার তরে মোর ভিজছে আঁখি,
আজকে আমি
বিজনে বসিয়া
করব
তারেই ডাকা ডাকি ৷
গামছাটা
তো ভিজিয়ে দিলে,
শুকনো
সুতা খুঁজতে বাকি ৷
তোমায়
কি পৌঁছাতে হবে ? …
নইলে আমি
শুয়েই থাকি ৷”
“না
পৌঁছাতে হবে না ৷ আমি চলে যাব ৷ গাড়ির চাবিটা দাও ৷”
গিন্নি
কে গাড়ির চাবিটা দিয়ে স্নানে ঢুকলাম
৷ ফোয়ারার তলায় নাতিশীতোষ্ণ জল আমার টাক ছুতেই মুখ ছুটতে লাগল ,
“হে
বারিধারা , আধুনিকতা নষ্ট করে নি তোমার স্নেহময়ী মূর্তি,
সাবান
ঘেরা সফেন শরীরে জাগায়েছ তুমি ফুর্তি ,
ছলছল
শব্দে মম প্রাণবীণায় জাগে যে ছন্দ,
এত জল
কেন বাথটবে ??
ওহো !
গৃহিনী করেছে নিস্কাশ পথ বন্ধ।
তুমি
গঙ্গা যমুনা নও, তুমি সিন্ধু কাবেরী নও
তুমি
কর্পোরেশন পাইপ বেয়ে এসেছ মোরে স্নিগ্ধ করিতে,
তোমার
সঙ্গ পেয়ে , মন ওঠে মোর গেয়ে
চাহে এ
মন তোমার উৎসস্থল ধরিতে ৷ ”
“তুমি কি
আসবে৷ না আমি বেরিয়ে যাব ৷ মেয়েদের মত এক ঘন্টা ধরে স্নান করছ, আর বিড় বিড় করে
কি বকছ ? ”
চেঁচিয়ে
বললাম
“শোনো
রমনী , বন্ধ কর ও বিষকুম্ভম ওষ্ঠাধর ,
বন্ধ কর
লাভা উদ্গীরণ ,
কভু তো
বলিতে পারো , হে সখী,
এসো
দুজনে করি জলকেলি ,
লাজ
লজ্জা ভুলি,
খুলিয়া
বস্ত্র , দুলিয়ে শরীর ,
ভুলিয়া
সকল ঝামেলা আমাদের ৷ ”
ধুম করে
দরজা ভেজানোর শব্দে কবিতা আটকে গেলো ৷ বেরিয়ে দেখি গিন্নি গাড়ি তে স্টার্ট দিছে
৷ মন বলে উঠলো ,
“যেও না
আমাকে একা ফেলি ,
ক্ষুধা জলে পেটে , চুপসে গেছে নালিগুলি ৷”
দেখলাম
এক বাটি মুড়ি মেখে রেখে গেছে, সাথে এক গ্লাস লেবুর শরবত ৷ বেরিয়ে এলো ,
“হায় রে
লেবু , তোর চুপসানো দেহাবশেষ,
মিলিয়েছিস
তোর অস্থি ফিল্টার এর মুত্রধারায়,
সঙ্গ
দিয়েছে চিনি,
মিশিয়েছে
তোর দেহ ব্যাকুলতা ,
অন্তঃসত্তা
ছিলিস তুই ,
তোর বীজ
পরে আছে আজ নালায়।
জানিনা
কবে সে যাবে মৃত্তিকার কাছে
ফুটবে
ফুল, জন্মাবে তোর জাতক
আরেক
পাতিলেবু … আমার শরবতে মিশবে বলে ৷ ”
সেই
আনচান ভাবটা বর্তমান রইলো প্রায় বিকাল পর্যন্ত ৷ দেশে সকাল হতে ফোন করলাম মা কে ,
“জননী
আমার জন্ম দাত্রী সুপ্রভাত তোমায়,
ধন্য
করেছ আমার পিতা রে জন্ম দিয়েছ আমায় ৷”
“কি রে
বাপি ৷ এত সকালে ফোন করলি? শরীর
ঠিক আছে তো ? আর কি সব বলছিস ? ”
“তোমারে
প্রনমিছি সুপ্রভাতে,
কত
আঘাতের পরে দিয়েছ মোরে জন্ম,
আমারে
করিতে মানুষ তোমার,
ছুটিয়াছে
কত ঘর্ম ৷ ”
“আজ কি
তোর কবিতা পেয়েছে ৷ খুব খুশি মনে হছে ৷”
“খুশি
কারে বলে জানিনে, আমি শুধু জানি এই জীবন
ততদিন
আমি হাসিব হেথায় যতকাল না আসে মরণ ৷ ”
“অফিস
থেকে ফিরে এসব কি বলছিস ৷ বাবা কে দেব ? ”
“ছন্দ
নাহি মিলবে আমার পিতা কে বলিলে বাবা,
অন্য
কোনো শব্দ পড়িছে না মনে , শুধু কাবা আর দাবা ”
“চুপ কর
৷ অনেক বাজে বকেছিস। বৌমা
কোথায় ? কেমন আছে ? ”
“গিন্নি
আমার ভালই আছে ,
কাছে নাই
শুধু এই।
এখন ঘরে
একাকী বসে ,
কেউ
কোত্থাও নেই ৷”
“কেন
কোথায় গেল ?”
“শিক্ষা
গ্রহণে মগ্ন প্রাণ ,
করিবে সে
স্বামীর
কল্যাণ,
গৃহেতে
আনিবে অর্থ প্রচুর
হইবে
একদা দেবী মহান ৷ ”
“আমি তো
তোর কথা কিছুই বুঝছি না
৷ কইগো তুমি গেলে কোথায়? বাপি আজব আজব বকছে ৷” বাবা কে উদ্দেশ্য করে কথা গুলো
ছুঁড়ে দিল আর বাবা এসে ফোন ধরতেই ,
“পিতা
, আজকে নাহি বাক্য মম তোমার তরে
আজকে আমি
একলা বড় নিজের কেনা ঘরে ৷”
“বুঝলাম …
কিন্তু এরকম বকার কারণ কি ? ”
“কিছুই
নহে , আচমকা সব গদ্য গেছে উড়ে,
বাক্য
মাঝে কাব্য ওঠে ফুঁড়ে ৷
চাইছি
বলিতে যাহা কিছু সব ,সকলি মিলিছে ছন্দে
আজব
জালায় বক্ষ কাঁদিছে , মনটা বড়ই ধন্দে ৷ ”
“বেশী
বোকনা৷ কাজটি কর ৷ সকাল হলো হেথায়,
ভেজাল
বকে, ভেজাল ঢুকিও না ,আমার বউ এর মাথায় ৷
তোমার
ন্যাকামো অনেক দেখেছি, তিরিশ বছর ধরে
তাইতো তোমায় দিয়েছি বিয়ে ,বউ দিয়েছি ঘরে
৷
বউ কে
জ্বালাও , কবিতা শোনাও, যা খুশি তাই কর,
ভেজাল
বকা কাব্য নহে, কাজের কাজ কর ৷
পিতার
বদলে ,বললে বাবা ,মিলবে দেখো ছন্দ
অনেক
হয়েছে ঘুমোতে যাও ছড়িও না দুর্গন্ধ। ”
আমি
একেবারে থতমত খেয়ে চুপ হয়ে ফোন রেখে দিলাম ৷ আনচান ভাব কেটে গেল ৷ ঝাপসা ছবি
গুলো ফুটে উঠলো ৷ সোফায় বসে অফিস ল্যাপটপ খুলে কাজে বসে গেলাম ৷ কবিতার সাংঘাতিক
গুঁতো খেয়ে ৷
No comments:
Post a Comment