Saturday, June 2, 2018

গিন্নী ও প্রবাস - কবিতার গুঁতো



সকাল সকাল তুলকালাম ঝগড়া করে আব্দুল কালামের এর মত নিরীহ শাবক হয়ে অফিসের  বিজ্ঞানমনস্কতায় নিজ প্রাণ উৎসর্গ করেছি ৷ কিন্তু সারাদিন কেমন যেন একটা আনচান ভাব ৷ সারাদিন কাজে মন বসলো না ৷ টুক টাক কাজ করতে করতে সব সময় মনে হচ্ছে কি যেন একটা পাচ্ছে ৷ বমি , বিষ্ঠা , মুত্র কোনো টাই নয় ৷ তবে মনের এই আচরণটা ঠিক কেন তা বুঝলাম না ৷ ঝগড়ার মহাভারতের ব্যাখা ছেড়ে চোখ বুজে মনে মনে অনেক কিছু সুন্দের জিনিসের চিন্তা করতে লাগলাম ৷ ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা পারফিউমটা একটা হাতে মারতেই চারপাশে গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ৷ আমার উল্টো দিকের কিউবিকাল থেকে সুন্দরী কলিগ একটু উফ আফ করে উঠলো বটে কিন্তু রোমন্থন হলো না ৷ প্রচন্ড বিরক্তি ভরে ফ্রন্ট ক্যামেরায়  নিজেকেই  দেখতে লাগলাম ৷ হঠাৎ সেই জিনিস টা পেয়ে গেল খুব জোরে যা এতক্ষণ একটু একটু পাচ্ছিল কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না ৷

এমন মুখের পানে চায় কোনো রূপসী,
গুগলি মরা মাছ শুষ্ক সরসী ৷

মনের মধ্যে দুটো লাইন কোথা থেকে চলে এলো ৷ আমি বুঝলাম কবিতা পেয়েছে ৷ এই কবিতা আমার মাঝে মাঝে পায়। আর যখন পায়, তখন ব্লগ , ফেসবুক , লোকেদের কান আর আমার গিন্নির মাথায় উকুনের মত ভরে যায় সেই বেমানান ছন্দের মাধুকরী ৷ কবিতার গুঁতোয় সবাই অক্কা ৷ কিন্তু কিছু করার নেই, মল , মুত্র , বমন , ক্ষুধার মতই আমার কবিতা পায় ৷ মনটা খুশি হয়ে যায় ৷

 গিন্নিকে ফোনে লাগলাম ৷ গিন্নির ফোন ভয়েসমেলের দুয়ার খুলে চেচিয়ে উঠলো , " ঢোক এখানে",

গিন্নি ধর ফোন 
লাইন এ আপনজন ৷

এইটুকু বলে ছেড়ে দিলাম।  বিকেল তখন চারটে, আরো একঘন্টা অফিসে বসে থাকতে হবে ৷ আমার এরকম অবস্থায় তখন আমি যাকে পাই তাকে ধরে কবিতা শোনাই ৷ মুখ দিয়ে অনর্গল কবিতা বেরিয়ে চলে ৷ কিন্তু বিদেশী অফিসে আমার বাংলা কবিতা শোনার জন্য কোনো সর্ষের তেল মারা কান নেই ৷ এক আছে আমার বসের বস, যে বাঙালি ৷ কিন্তু বড় খ্যাটখ্যাটে  ৷ আর্ট বলতে তার কাছে পাওয়ারপয়েন্ট এর ঘ্যানঘ্যানে এনিমেশান ৷ কিন্তু আমার সাথে ভালই গল্প করে তাই অফিস চ্যাটে লিখলাম ৷

বারে বারে নিম্নচাপ করছি নিবারণ,
বমন , বিষ্ঠা একই সাথে কর্মে নাহি মন ৷

রিপ্লাই  এলো ,

“ ছন্দ লেখা বড়ই  সোজা শুধু  মেলাও হেড  আর  টেল  
চার পাশে না গন্ধ ছড়িয়ে যাও গো টু হেল।  

ওরে শালা !! ৷ মালটার  তাহলে রস বোধও আছে ৷ যদিও যা লিখেছে তার সত্তর ভাগই পচা জল ৷ কিন্তু আমার তখন দাড়িওলা কবির মত অবস্থা ৷ পুরো ঝুলে গেছি ৷ অফিসের  স্টিকি নোটে লিখে ফেলেছি ৷

আজকে নাহি থামিবো আমি ,সৃষ্টি করিব ছন্দ ,
খুলিব সেসব  চক্ষু দুয়ার , গদ্য দ্বারা অন্ধ ৷”
“কালকে আমার প্রচুর কর্ম ক্রিয়াপদ  দিয়া  মাপি,
অষ্টবক্র  শরীর দুলায়ে  প্রচন্ড জ্বরে কাঁপি ৷”
কি সব লিখছি নিজেও জানিনা কাব্য তবু  হাতে, 
বোঝা না বোঝা পাঠকের কাজ , আমার কি এসে যায়  তাতে। ”

কোনো রকমে ব্যাগ টা গুছিয়ে সোজা বাড়িতে ৷ রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে উগলোলাম ,

“কেন রে তোরা বাঁধছিস মোর পথ , সিগনাল করে লাল ,
শুধু নিয়মের ঘেরাটোপ এ বেঁধে করেছিস এই হাল ৷
যদি হয় মোর দেরী , যদি বাড়িতে দেখি যে তালা,
ওরে  ইঞ্জিন শব্দ থামা, কান করে ঝালাপালা।
ওরে এ সি , তোর বড্ড বেশি শীতল হাওয়া , বক্ষে মৃত্যু তোর, 
অডিও প্লেয়ার বাজরে জোরে , আজিকে যে দিন তোর ৷
এক্সিলেটর  বসে পর তুই , স্টিয়ারিং  থাক ঘুরতে,
ওয়াইপার  তুই ঘষে  যা কাচ তেল থাক তুই পুড়তে  
ব্রেক তোকে আজ লাগছে না ভালো, শুধু লাল বাতিতে বাধ্য,
আজকে যেন উইন্ডশীল্ডটাও টাও ,না থাকিলে পারত ৷”

তিন চার বার ঘন্টা বাজানোর পর ঘুম ঘুম চোখে গিন্নি দরজা খুলে দিল ,

হে নারী ৷
আমি এসেছি তাড়াতাড়ি। 
সঙ্গে না ছিল চাবিখানি মোর, 
তাইত তুমি খুলিয়াছ দোর.
নয়ন সমুখে তোমা মুখখানি,
করপুট ধরে করে আবাহনী।
চাহিতেছি ওই ললাট স্পর্শ,
মনে আজিকে আমার পরম চরম হর্ষ ৷৷

“কি হলো গো তোমার ৷” বউ ভেবড়ে গিয়ে ঘুম চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো, “অফিস থেকে এত আগে চলে এলে?”
আর না করিব অফিস, কর্মে নাহি মন,
তোমার সাথে সোহাগ করিব গাইব সারাক্ষণ ৷

“মরণ বলবে কি হয়েছে ? হঠাৎ কবিতা আউরাচ্ছ কেন ? ”

ইহা সৃষ্টি ৷ আউরানো নহে ৷ বুঝতে শেখো হে নারী,
গৃহ কর্তা আসিলে ঘরে ,দাও শরবত  তাড়াতড়ি ৷ ”

“অফিসে নিশ্চয়  প্রচুর গাঁতন খেয়েছ ৷ মাথা বিগড়ে গেছে ৷”

বিগড়ানো মাথা আজকের নয় কাহিনী,
পেরিয়ে গেছে সহস্র বিনিদ্র যামিনী ৷
বেচিয়াছি আমি ফুটপাতে এই ঘর্ম ঝরা মস্তক,
সকল  আনন্দ ছাড়িয়া  আমি পড়িয়াছি শুধু পুস্তক ৷
তোমার তনু  গিলিয়াছে ক্রীম , আমি ফর্সা হয়েছি ফেটে
তোমার অঙ্গে ডাবর  মধু , আমি ক্ষুদ  খাচ্ছি চেটে।    

গিন্নি বলে উঠলো , “কি বলতে চাইছটা কি ?”

কিছু নহে আমি বলিতে চাই ,
এসো আজ মোরা দুজনে মিলিয়া ,
ব্যালকনিতে  তে সিঙ্গারা খাই

“তুমি কি এরকম করেই কথা বলবে আজকে ? ”

“কেন সখী কর রাগ ৷
আগে খুলি মোর জুতা, 
হৃদয়ে  আজিকে অনুপম খুশি,  
পেটে তবু বড় ক্ষুধা ৷”

“কি খাবে ? শরবত না হয় করে দিচ্ছি ৷ মুড়ি মেখে দেব ?”

শত সহস্র যোজন পেরিয়া  , সাত মহাদেশ ঘুরি
সকলি ছাড়িয়া আসিয়া হেথায় চিবাইব কি মুড়ি ? ”

“রাতে লুচি বানাবো ৷ এখন কম করে মুড়ি মেখে দিচ্ছি, পিঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ৷ ভালো লাগবে ৷ বাড়ির চানাচুর ও আছে ৷”

তুমি লোভ দেখাও মোরে৷
পিঁয়াজ দিয়ে করবে নরম মুড়ির অন্তরে??
হায় রে মুড়ি , কত অপমান লুচির জন্য সইবি ,
হালকা শরীর পাপড়ি সম আর কত ভার বইবি ৷ ”

“এহ্হঃ তোমার এই ন্যাকামো আর ভালো লাগছে না ৷ মুড়ি খাবে তো খাও নাহলে আমি আর কিছু করতে পারব না ৷ আমি ট্রেনিংয়ে যাচ্ছি ৷”

“আজকে নাহি যাও হে সখী একলা করিয়া মোরে ,
কেমন করে কাব্য করিব একলা রিক্ত ঘরে ৷”

“তোমার কাব্যের কাঁথায় আগুন ৷ মা ঘুম থেকে উঠলে মা কে ফোনে শুনিও তোমার কবিতা ৷”

“ঠিক আছে সখী,
দিবস রাতি , যার তরে মোর ভিজছে আঁখি,
আজকে আমি বিজনে বসিয়া
করব তারেই ডাকা ডাকি ৷
গামছাটা তো ভিজিয়ে দিলে,
শুকনো সুতা  খুঁজতে বাকি ৷
তোমায় কি পৌঁছাতে  হবে ?
নইলে আমি শুয়েই  থাকি ৷”

“না পৌঁছাতে হবে না ৷ আমি চলে যাব ৷ গাড়ির চাবিটা দাও ৷”
গিন্নি কে গাড়ির চাবিটা দিয়ে স্নানে  ঢুকলাম ৷ ফোয়ারার তলায় নাতিশীতোষ্ণ জল আমার টাক ছুতেই মুখ ছুটতে লাগল ,

“হে বারিধারা , আধুনিকতা নষ্ট করে নি তোমার স্নেহময়ী মূর্তি,
সাবান ঘেরা সফেন শরীরে জাগায়েছ তুমি ফুর্তি ,
ছলছল শব্দে মম প্রাণবীণায় জাগে যে ছন্দ, 
এত জল কেন বাথটবে ??
ওহো ! গৃহিনী করেছে নিস্কাশ পথ বন্ধ।
তুমি গঙ্গা যমুনা নও, তুমি সিন্ধু কাবেরী নও
তুমি কর্পোরেশন পাইপ বেয়ে এসেছ মোরে স্নিগ্ধ করিতে,
তোমার সঙ্গ পেয়ে , মন ওঠে মোর গেয়ে
চাহে এ মন তোমার উৎসস্থল ধরিতে ৷ ”

“তুমি কি আসবে৷ না আমি বেরিয়ে যাব ৷ মেয়েদের মত এক ঘন্টা ধরে স্নান করছ, আর বিড় বিড় করে কি বকছ ? ”
চেঁচিয়ে বললাম 

“শোনো রমনী , বন্ধ কর ও বিষকুম্ভম ওষ্ঠাধর ,
বন্ধ কর লাভা উদ্গীরণ ,
কভু তো বলিতে পারো , হে সখী, 
এসো দুজনে করি জলকেলি ,
লাজ লজ্জা ভুলি,
খুলিয়া বস্ত্র , দুলিয়ে শরীর , 
ভুলিয়া সকল ঝামেলা আমাদের ৷ ”


ধুম করে দরজা ভেজানোর শব্দে কবিতা আটকে গেলো ৷ বেরিয়ে দেখি গিন্নি গাড়ি তে স্টার্ট দিছে ৷ মন বলে উঠলো ,

“যেও না আমাকে একা ফেলি ,
ক্ষুধা  জলে পেটে  , চুপসে গেছে নালিগুলি ৷”

দেখলাম এক বাটি মুড়ি মেখে রেখে গেছে, সাথে এক গ্লাস লেবুর শরবত  ৷ বেরিয়ে এলো ,

“হায় রে লেবু , তোর চুপসানো দেহাবশেষ,
মিলিয়েছিস তোর অস্থি ফিল্টার এর মুত্রধারায়, 
সঙ্গ দিয়েছে চিনি,
মিশিয়েছে তোর দেহ ব্যাকুলতা ,
অন্তঃসত্তা ছিলিস তুই ,
তোর বীজ পরে আছে আজ নালায়।
জানিনা কবে সে যাবে মৃত্তিকার কাছে
ফুটবে ফুল, জন্মাবে তোর জাতক
আরেক পাতিলেবু আমার শরবতে  মিশবে বলে ৷ ”

সেই আনচান ভাবটা বর্তমান রইলো প্রায় বিকাল পর্যন্ত ৷ দেশে সকাল হতে ফোন করলাম মা কে ,
“জননী আমার জন্ম দাত্রী সুপ্রভাত তোমায়, 
ধন্য করেছ আমার পিতা রে জন্ম দিয়েছ আমায় ৷”

“কি রে বাপি ৷ এত সকালে ফোন করলি?  শরীর ঠিক আছে তো ? আর কি সব বলছিস ? ”

“তোমারে প্রনমিছি সুপ্রভাতে,
কত আঘাতের পরে দিয়েছ মোরে জন্ম,
আমারে করিতে মানুষ তোমার, 
ছুটিয়াছে কত ঘর্ম ৷ ”

“আজ কি তোর কবিতা পেয়েছে ৷ খুব খুশি মনে হছে ৷”

খুশি কারে বলে জানিনে, আমি শুধু জানি এই জীবন
ততদিন আমি হাসিব হেথায় যতকাল না আসে মরণ ৷ ”

“অফিস থেকে ফিরে এসব কি বলছিস ৷ বাবা কে দেব ? ”

ছন্দ নাহি মিলবে আমার পিতা কে বলিলে বাবা,
অন্য কোনো শব্দ পড়িছে না মনে , শুধু কাবা আর দাবা ”

“চুপ কর ৷ অনেক বাজে বকেছিস।  বৌমা কোথায় ? কেমন আছে ? ”

“গিন্নি আমার ভালই আছে ,
কাছে নাই শুধু এই।  
এখন ঘরে একাকী বসে ,
কেউ কোত্থাও নেই ৷”

“কেন কোথায় গেল ?”

শিক্ষা গ্রহণে মগ্ন প্রাণ ,
করিবে সে  স্বামীর কল্যাণ,
গৃহেতে আনিবে অর্থ প্রচুর 
হইবে একদা দেবী মহান ৷ ”

“আমি তো তোর কথা কিছুই  বুঝছি না ৷ কইগো তুমি গেলে কোথায়? বাপি আজব আজব বকছে ৷” বাবা কে উদ্দেশ্য করে কথা গুলো ছুঁড়ে  দিল আর বাবা এসে ফোন ধরতেই ,

পিতা , আজকে নাহি বাক্য মম তোমার তরে 
আজকে আমি একলা বড় নিজের কেনা ঘরে ৷

“বুঝলাম কিন্তু এরকম বকার কারণ কি ? ”

“কিছুই নহে , আচমকা সব গদ্য গেছে উড়ে,
বাক্য মাঝে কাব্য ওঠে ফুঁড়ে ৷
চাইছি বলিতে যাহা কিছু  সব ,সকলি মিলিছে ছন্দে
আজব জালায় বক্ষ কাঁদিছে  , মনটা বড়ই ধন্দে ৷ ”

“বেশী বোকনা৷ কাজটি কর ৷ সকাল হলো হেথায়, 
ভেজাল বকে, ভেজাল ঢুকিও না ,আমার বউ এর মাথায় ৷
তোমার ন্যাকামো অনেক দেখেছি, তিরিশ বছর ধরে 
তাইতো  তোমায় দিয়েছি বিয়ে ,বউ দিয়েছি ঘরে ৷
বউ কে জ্বালাও  , কবিতা শোনাও, যা খুশি তাই কর,
ভেজাল বকা কাব্য নহে, কাজের কাজ কর ৷
পিতার বদলে ,বললে বাবা ,মিলবে দেখো ছন্দ 
অনেক হয়েছে ঘুমোতে যাও ছড়িও  না দুর্গন্ধ। ”

আমি একেবারে থতমত খেয়ে চুপ হয়ে ফোন রেখে দিলাম ৷ আনচান ভাব কেটে গেল ৷ ঝাপসা ছবি গুলো ফুটে উঠলো ৷ সোফায় বসে অফিস ল্যাপটপ খুলে কাজে বসে গেলাম ৷ কবিতার সাংঘাতিক গুঁতো  খেয়ে ৷ 



No comments:

Post a Comment