“স্যার
আপনি জাপানে নেই মনে রাখবেন। আমরা ছাত্র পরিষদ । আমাদের কথাই শেষ কথা। ”
সেমিস্টারের অঙ্ক খাতা চেক করতে করতে অনির্বানের দেওয়া ডায়ালগটা মাথায় বেজে উঠলো সৌমেনের। সৌমেন এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং
কলেজের অংকের প্রফেসার। আগে
প্রফেসর নাম অর্জন করতে অনেক কাঠ খড় পোয়াতে হতো। হাজার হাজার পরীক্ষা দিয়ে প্রচুর
তেল কিনে উর্দ্ধে থাকা নাসিকা বাগিয়ে ঘোড়া একরাশ লোকের পায়ুছিদ্রে সেই তেল লেপন
করে তবেই পাওয়া যেত প্রফেসার আখ্যা। এখন
সে যুগ নেই। বেসরকারি
কলেজে প্রথম পসিশন এসিস্টেন্ট প্রফেসর। আর বছর গড়াতে না গড়াতে প্রফেসর। তাই
সম্মানও তলানিতে।
সৌমেন
যখন এই কলেজে ঢোকে তখন কলেজের সবে তিন বছর হয়েছে। পরের বছর প্রথম গ্রাজুয়েট ব্যাচ
বেরোবে। অন্যান্য বড় বেসরকারি কলেজে তখন
ক্যাম্পাসিং চালু। বন্ধুরা
চাকরি পেয়ে যাচ্ছে দেখে কলেজের ছেলেদের মাথা খারাপ। দিন রাত চিৎকার চ্যাঁচামেচি। ছেলেরা মাঝে মাঝেই কলেজের টিচার মেসে এসে চড়াও হচ্ছে।
সৌমেন
তখন বেশ কিছু বছর নানা কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে এসে এই কলেজে আস্তানা
গড়েছে। সরকারি চাকরির জন্যে ফ্যা ফ্যা করে
ঘুরে বেড়ানো ছেলেদের মধ্যে তার লাক ক্লিক করেনি। শেষে নামমাত্র মাইনে নিয়ে এই কলেজে
অংকের শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছিলো সে। অন্তত
এক্সপেরিয়েন্স তো বাড়ুক। কিছুদিনের
মধ্যেই ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে যায় সে। কারণ
সে ভালো ছাত্র ছিল না , কিন্তু সে অত্যন্ত ভালো শিক্ষক। সে তার ছাত্রদের প্রথমে নিজের দলে
টেনে প্রথমে ছাত্রদের তাদের শিক্ষকের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। স্বভাববশতঃ ছাত্ররা তার
ক্লাস এটেন্ড করতে থাকে। আর
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসে সে দেড় ঘন্টার পড়া আধঘন্টায় পড়িয়ে দেয়। বাকিটা সোশ্যাল স্টাডি।
অংক এমন
একটা রসকষহীন বিষয় যার পরিবেশনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিবড়ে পরে পাতে , তাই ছাত্ররাও
যখন ক্লাসের প্রথম পনেরো মিনিটে ডিপিং সস পায় , তারাও শেষ আধ ঘন্টায় ছিবড়েই উপভোগ
করে। সেই প্রথম পনেরো মিনিটে দারু ,
দারুচিনি থেকে দারুব্রম্ভ সবই আলোচনা হতো। যখন
সেমিস্টার শেষে ক্যাম্পাসিং না হওয়ার জন্য পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন সৌমেন ছিল
একমাত্র যে , ছাত্র প্রকোপ থেকে ছাড় পায়। তার
নিজস্ব কলেজ রাজনীতির গ্রূমিং তাকে ছাত্রের অনেক কাছের মানুষ করে তোলে।
এক বছরের
মধ্যে অঙ্কের ছজন সিনিয়র প্রফেসর রিসাইন করায় সে হয়ে ওঠে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স
এর হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট।
নামটা বেশ ভারী শোনালেও যেহেতু এটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তাই কখনো তার নাম প্রথম
সারিতে নেওয়া হতো না। কিন্তু
বিকাল বেলা চায়ের ঠেকে সৌমেন সবসময় মজুদ থাকতো ছাত্রদের সাথে। হাসি ঠাট্টা , মজা
সিগারেট খাওয়া সব মিলিয়ে সৌমেন হয়ে উঠেছিল ছাত্র বন্ধু। প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে কলেজের
ডাইরেক্টর পর্যন্ত আপত্তি করেছিল সৌমেনের এই খোলামেলা স্বভাবের জন্য। কিন্ত যখন গোপনে তারা খবর পায় গোপালের
চায়ের দোকানে অঙ্কের
খাতা নিয়ে ছেলেরা বসে থাকে, তখন তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
সৌমেন
ভেবেছিলো এই ভাবেই চলবে। কিন্তু
উঠলে নামতে হবে। দু
চারটে ব্যাচ বেরিয়ে চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি এসে ঢুকলো
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ক্যাম্পাসে। এতদিন গভর্মেন্ট কলেজেই ছিল এদের দৌরাত্ম। কিন্তু এখন এখানেও থাবা বসাতে শুরু
করলো মেনস্ট্রিম পলিটিক্স এর ছাত্র সংগঠন গুলো।
সৌমেনের
নিজস্ব মতে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুতর। সমস্ত প্রকৃত রাজনীতিবিদ ছাত্র
রাজনীতি থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু
সবার জন্য এ প্রযোজ্য নয়। রাজার
রাজ্যে হাজার জনের ওপর রাজত্ব করে দশজন। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতে সবাই রাজা হতে
চায়। তার ফলে লক্ষ্য ও উদ্যেশ্যের দফা রফা
হয়ে যায়। সৌমেন
তারই শিকার। তাই যখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে রাজনীতি এসে থাবা মারে, সে বুঝতে পারে
প্রলয় ডঙ্কা বেজে উঠেছে। যে
গোষ্ঠীর উদ্যেশ্য বেসরকারি চাকরি নিয়ে দেশত্যাগ করার, তাদের কি করে দেশি রাজনীতির
কাঠামোতে ফেলা যায়। সে
জানতো যে ভুলভাল কিছু স্বার্থপর লোকের হাতে চলে যাবে এই কচি কচি মাথা গুলো।
হলোও
তাই। ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য ভবিষ্যৎ
রাজনীতিবিদ তৈরী করা। তথাকথিত
রাজনৈতিক দলগুলির উদ্যেশ্যও সাধারণভাবে তাই হওয়া উচিত। কিন্তু ধীরে ধীরে কিছু অসামাজিক
লোকেদের আগমন হলো চায়ের ঠেকে। তারা
এমন কিছু জিনিস পাইয়ে দিতে লাগলো ছাত্রদের যা তারা ভাবতেই পারেনা। সুসংগঠিত ভাবে তারা ছাত্রদের মাঝ থেকে
বেছে নিলো তিন ধরণের ছাত্রদের - এন্টারটেইনার, জমাটি বক্তা আর বোকা স্বার্থপর। এই
তিন ধরণের ছাত্রদের তারা বুঝিয়ে দিলো তোমরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। হনুমান এখন উড়তে শিখলো আর লক্ষ্য
তাদের সূর্য।
অনির্বান
ছেলেটি প্রথম থেকেই নজর কেড়েছিল সৌমেনের। ধারালো
যুক্তিবাদী , তীব্র প্রতিবাদী আর লজিকাল। অংকের
মাথা ছিল। অংকে
মাথা যাদের ভালো ,তারা সব কাজকে প্রথমে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলে। তারপর এক একটা ছোট ছোট কাজে ফোকাস করে
পুরো কাজটা শেষ করে। এই
তাদের ক্ষমতা। অনির্বাণও
তাই। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ক্লাসে এক
বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রত্যেক শিক্ষকের। যে প্রশ্নের জবাব শিক্ষকদের কাছে
থাকতো না , ঠিক সেই প্রশ্নগুলোই সে করে বসত ক্লাসে। সৌমেনের প্রথম পনেরো মিনিট সে ধীরে
ধীরে কুড়ি , পঁচিশ থেকে তিরিশে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করলো। সৌমেন হার স্বীকার করতো তার সামনে। আর তাতেই শিক্ষক হিসেবে তার জয়। কিন্তু সে বুঝতে পারছিলো এক
ছাত্রনেতার উত্থান যা সঠিক লক্ষ্য না পেলে উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে।
বছর দুই
এর মধ্যে সে নজরে পড়লো নেতাদের, যখন ফ্রেশারস থেকে অ্যালুমনি ওয়েলকাম সব কাজে সে
একের পর এক ভিড় জমিয়ে দিতে লাগলো। কম্পিউটার
ল্যাব ঠিক করা থেকে শুরু করে লাইব্রেরির বই এনে দেওয়া, কলেজে প্রথম ডিবেট
কম্পিটিশন করানো , স্বচ্ছ ভারত অভিযানের অংশ হিসেবে নিজেই কলেজের চারপাশ পরিষ্কার
করানো। এক এক করে সব কিছুতেই তাকে ডাকতে লাগলো
কলেজ এবং ছাত্র কর্ত্রীপক্ষ। সৌমেন
ফলো করতে লাগলো তার উত্থান। আর
সাথে এও দেখতে লাগলো, চারমিনার ছেড়ে প্যাকেট প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক কিংস এসে তার
আঙুলে শোভা পেয়েছে। রাম
ছেড়ে স্কচের কথা বলতে আরম্ভ করেছে। ফোন পাল্টে যাচ্ছে মাসে মাসে। মেয়েদের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই। কিন্ত কানাঘুষোতে শুনলো মেস ছেড়ে সে
এখন একা থাকে ,আর সেই ঘরে প্রচুর মেয়েদের অবাধ যাতায়াত।
যেদিন
গঙ্গার ধারের ইঁটভাঁটার ওপর হেলান দিয়ে ছিলিমে করে গাঁজা টানছিলো সেদিন সৌমেন
এগিয়ে গিয়ে বলেছিলো , “যা করছিস ঠিক করছিস তো ?” চোখটা লাল ছিল। ভয় পেয়ে উঠেও দাঁড়ালো না। যেমন বসেছিল সেরকম বসেই সেদিন বলেছিল
, “নিজের চরকায় তেল দিন স্যার” সৌমেন কথাটা গায়ে মাখেনি ,উত্তরে বলেছিলো , “
সামনের বছর ক্যাম্পাসিং। মনে আছে তো ? ” “সব মনে আছে স্যার। আপনার শুধু মনে নেই আপনি কার সঙ্গে
কথা বলছেন। ” হজম হয়নি সৌমেনের , “নেশায় বলছিস না ভেবে বলছিস ?” “এইটুকুও জানেন না
স্যার নেশায় মানুষ সত্যি কথা বলে ” “যদি
ফেল করে যাস তাহলে সামনে কি আছে জানিস ? তোর তো বাবার অতো পয়সাও নেই যে আরেক বছর
ফি দিতে পারবে।” “ফেল ???” টলমল করে উঠে দাঁড়ালো অনির্বান। “আমাকে ফেল করবে কার সাধ্য। গাঁজা টেনেও টপ টেনে থাকা যায় দেখোনি
বাবা ” “অনির্বান তুই ভালো ছেলে কিন্তু মুতের ছিটে গায়ে লেগেছে তোর। মুছে না ফেললে
গন্ধ বেরোবে। আগে
প্রকৃতিস্থ হ। কাল
বিকেলে আসিস, কথা হবে।” “শুনুন স্যার। ওসব কাব্যি নিজের কাছে রাখুন। যা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। স্যার আপনি জাপানে নেই
মনে রাখবেন। আমরা
ছাত্র পরিষদ। আমাদের
কথাই শেষ কথা ”
গাঁজার
নেশায় সেদিন ও বুঝিয়ে দিয়েছিলো সে যা ইচ্ছা করুক না কেন সে বৈতরণী পার হয়ে যাবে
রাজনীতি করে। অনির্বানের ইন্টারনাল পরীক্ষার খাতায় কখনো তার নেশা বা নৈতিক অবনতি ফুটে ওঠেনি। তাই লাল দাগে ক্ষতবিক্ষত করার প্রশ্নই
থাকতো না সৌমেনের। ইন্টারনাল
পরীক্ষায় সবসময় সে কুড়িতে কুড়ি দিয়ে এসেছে অনির্বাণকে। আর সত্যি সে টপ টেনে থাকতো, দু
সেমিস্টার আগে পর্যন্ত। আজ
ইউনিভার্সিটির খাতা চেক করতে এসে লাল দাগে ভরে উঠেছে সামনে থাকা খাতাটা । এরও নাম অনির্বান। পাতায় পাতায় ভুল। শুধু খাতার মাঝে একটা দুহাজার টাকার
নোট স্টিকি স্টিকি নোট দিয়ে আটকানো, তাতে
লেখা , ‘ পাশ করলে আরো পাবেন। ফেল করলে খুঁজে নেবো। - ছাত্র পরিষদ। ’
No comments:
Post a Comment