Friday, May 4, 2018

প্রবন্ধ ৩০ - পেট চায় ধর্ম বদলায়


কেরালার একটি জেলার নাম ওয়েনাড়। ভায়াল আর নাড়ু মানে পাট আর মাঠ।  অর্থাৎ পাটের খেত এই নাম নিয়ে এই জেলার নামাঙ্কন হয় উনিশশো আশিতে।  এখানে এডাক্কাল গুহার থেকে জানতে পারা যায় এখানে মানুষের বসবাস খ্রিস্টের জন্মের অন্তত হাজার বছর আগে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে যখন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য রাজ্য বিস্তার করেন তখন এখানে থাকতো একদল আদিবাসী। মূলতঃ তিন আদিবাসীর নাম পাওয়া যায় -  কুরুমা , কুরিচিয়া আর পানিয়া।   চাষবাস ছিল তাদের জীবিকা।  সেই সময় ভদ্রবাহু বলে এক জৈন সাধুর কিছু শিষ্য তপস্যার জন্য জায়গা খুঁজতে খুঁজতে কর্ণাটকের শ্রাবনবেলগোলা থেকে এসে হাজির হয় এই জেলায়। আদিবাসীরা ধীরে ধীরে জৈন ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে।  খ্রিস্ট ধর্ম শুরু হতে হতে আদিবাসীদের অধিকাংশ জৈন ধর্ম গ্রহণ করে।  অষ্টম শতাব্দীতে শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তি আন্দোলনে জৈন ধর্মের পতন শুরু হয়।  এই সময় জৈনরা শৈব বা বৈষ্ণব ধর্মে পরিবর্তিত হতে থাকে।  ষোলো শতাব্দীর মধ্যে জৈন ধর্ম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।  কিন্তু পরে থাকে কিছু জৈন মন্দির।  যেহেতু জৈন দেবদেবী হিন্দু দেবদেবীর সাথে মিলে যায় তাই সেগুলোর বেশ কিছু হিন্দু মন্দিরে পরিবর্তিত হয়।  আর প্রচুর নতুন হিন্দু মন্দিরের উপস্থাপনা হয়।  এরপর আসেন টিপু সুলতান, সতেরোশো সত্তর নাগাদ।  তাঁর বার বার আক্রমণে প্রচুর মন্দির বিনষ্ট হয় এবং অধিকাংশ হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। যেহেতু সেই যুগে রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম আর ধর্ম পরিবর্তনে লাভই লাভ তাই সেই হিন্দুরা ধর্ম পরিবর্তনে বিশেষ পিছপা হয় না। ততদিনে বাকি কেরালায় জাঁকিয়ে বসেছে সিরিয়ান সেন্ট টমাস খৃস্টান মালঙ্কারা নাসারানি।  তাদের সাথে তীব্র বিরোধ তথাকথিত ব্রাহ্মণদের।   যেহেতু ওয়েনাড় আদিবাসী অধ্যুষিত অল্পশিক্ষিত চাষী সম্প্রদায়ের থাকার জায়গা, তাই এই লড়াই খুব একটা এসে পৌঁছায়নি।  কিন্তু ব্রিটিশরা এসে হাজির হয় তাদের ক্যাথলিক ধর্ম নিয়ে। ব্রিটিশরা টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর উত্তর ওয়েনাড় নিজেদের দখলে রাখে এবং দক্ষিণ ওয়েনাড় দিয়ে দেয় কেরালার সিংহ পাঝাসি রাজাকে।  এই রাজা আত্মহত্যা করলে লর্ড ওয়েলেসলির অধিকারে আসে পুরো ওয়েনাড়। সেই সময় ক্যাথলিক সাধুরা এবং সরকার নানা লাভ ক্ষতি দেখিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করে কাতারে কাতারে মুসলমান কে।  উনিশশো শতাব্দীর শুরুতে বাকি কেরালা ও কর্ণাটকের নানা জায়গা থেকে উচ্চবিত্ত মানুষজন ওয়েনাড়ে আসে ও গোল্ড কর্পস বা পাট চাষের আদর্শ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে। শুরু হয় ভিন্ন ধর্মের টাগ অফ ওয়াড়।  একই জীবনে অন্তত তিন চার বার এক এক চাষী তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে।  স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে উনিশশো সাতান্ন সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া ক্ষমতায় এলে কৃষিজীবী এই জেলার পর্যাপ্ত উন্নতি হতে থাকে।  ধর্ম শুধু নাম মাত্র অবস্থান করে।  কিন্তু আবার পরিবর্তন শুরু হয় উনিশশো বাহাত্তর থেকে উনিশশো তিরাশির মধ্যে যখন কাতারে কাতারে কেরেলিয়ান গিয়ে হাজির হয় গাল্ফে।  প্রচুর মাত্রায় ধর্মের নম্বরে ওঠানামা চলতে থাকে।  আজ দু হাজার এগারোর সেন্সাসে পঞ্চাশ শতাংশ হিন্দু , আঠাশ শতাংশ মুসলিম , আর একুশ শতাংশ ক্রিস্টেন বাস করে এই জেলায়।  

কি অদ্ভুত এই যাত্রা।  একই জায়গায় শতাব্দীর পর শতাব্দী দারিদ্রের সাথে ধর্মের কি লুকোচুরি খেলা।  যখন যে রাজা সে মুখে তুলে দিয়েছে চরণামৃত , শূকর বা গরুর মাংস।  খিদে পেলে মানুষ যা পেয়েছে তাই খেয়েছে।  এই সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের হানাহানি কি আদৌ দরকার।  ওই মানুষগুলো তো বেঁচে আছে।  কোনো দেব দেবী এসে তো শাপ দিয়ে ভস্ম করে দেয়নি , পাঠায়নি জাহান্নমে।  কখনও জৈন , কখনো আল্লা , কখনো রাম কখনো খ্রিস্ট এসে তাদের বামাদু , নিজহাল , মালাক্কারি , কারিম্পিলি দের পোঁদে লাথি মেরে তাড়িয়েছে। আজ কুরুমারা যারা নিজেদের কুরুম্বা দের উত্তরাধিকার মনে করতো তাদের গর্ব ধরে রাখতে নিজেদের বলে উড়ালি কুরুমা , জৈন কুরুমা , বা মুল্লা কুরুমা।  তাদের দরকার নেই ধর্মের তাদের দরকার তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে।  কুরুমা হয়ে বাঁচতে।  
তাদের অস্তিত্ব তাদের জাতি, তাদের খাদ্য তাদের জীবন ধারা।  ভিন ধর্মের বাঙালিরা কি ভিন্ন ভাবে বাঁচে?  সকালের নামাজ পরে , দুপুরে চার্চে ঘুরে বিকেলে আহ্নিক করে সেই তো আমরা রসোগোল্লাই ভালোবাসি।  নেই নেই কোনো ভেদ নেই , আছে শুধু পয়সার ঘোরাফেরা , আছে  বোকা পেটের জন্য হাতের লড়াই। হয়তো কোনোদিন আমরা সবাই শিখবো কুরুমাদের মতো, সেদিন বাঙালি আবার বাঙালি হবে।             

সূত্র ---  


বাকি প্রবন্ধগুলি 


No comments:

Post a Comment