Thursday, November 30, 2017

পদ্মিনী ও বনলতা সেন



- এই, তোর নাম কি রে?
- বনলতা সেন।  আর তোর? 
- পদ্মিনী
- সারনেম ? 
- আমার নামই কাফি।
- কই, আমি তো এই প্রথম শুনলাম। 
- কেন জহর ব্রত শুনিসনি। 
- ও হ্যাঁ তাই তো , তুইই কি সেই? 
- হ্যাঁ আমিই সেই রানী। 
- বাব্বা তোর আত্মবলিদান তো বিশাল , তুই তো দেবী। 
- হ্যাঁ তা বটে। মাথা হেঁট করিনি মুসলমান শাসকের সামনে। 
- আত্মহত্যা করাটা কি খুব ভালো কাজ? 
- সম্মান খোয়ানোর থেকে তো ভালো। 
- মানে ভাঙবো তবু মচকাবো না তাই তো? 
- সে যা বলবি বল । আমরা রাজপুত । আমরা তোদের বাঙালীদের মতো মাথা ঝোঁকাইনা। 
- তুই রাজপুত কোথায় , শুনেছি তুই নাকি সিংহলের রাজকন্যা ? 
- নারীর কোনো জাত নেই। স্বামীর জাতই তার জাত। 
- ও আচ্ছা । তাহলে মুসলমান আক্রমণ না করলে সহমরণে যেতিস তাই তো, মানে সতী হতিস? 
- হতাম হয়তো। ইতিহাস তো আর পাল্টানো যায় না। 
- তুই কি ইতিহাস , না কল্পনা ?
- কল্পনা কেন হব ? 
- লোকে তো তাই বলছে।
- লোকে তো অনেক কিছুই বলে।
- তা বটে।
- আমি বাস্তব এবং এক ভিন্ন পথদ্রষ্টা।
- তোর পথে তোর পরে কেউ চলেছিল? 
- জানিনা। মর্যাদা তো সময়ের সাথে সাথে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে ।
- সত্যি কি মর্যাদার হানি হতো, যদি সেদিন দিল্লির সুলতান তোকে রাণী করে নিয়ে যেত? 
- হতো না কি?  
- এই তো বললি নারীর কোনো জাত নেই। স্বামী তো একটা জীবিকা মাত্র।  পাল্টে গেলেই তো তোর জাত পাল্টে যেত।  এতোগুলো প্রাণ শেষ হয়ে যেত না।  প্রাণ আগে না মান আগে ? 
- অবশ্যই মান।  মান গেলে , প্রাণ থেকে কি হবে।  
- আর প্রাণ গেলে কে তোকে মান দেবে শুনি? 
- দেখছিস না , এতো বছর পর একটা সিনেমা বানিয়ে কেউ আমাকে মান দেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজকে কত নারীর অনুপ্রেরনা।  
- সিনেমা তো রিলিস করতেই দিচ্ছে না।  
- সেটা ভালো নয়।  তোর কি মনে হয় , আমাকে নিচু করে দেখিয়েছে সিনেমাতে।  
- প্রশ্নটা অবান্তর নয় কি ? রতন সিং এর কাছে নিচু দেখালে তুই রানী , আর খিলজির কাছে নিচু দেখলে তুই ছিনাল!   অথচ দুজনেই পুরুষ।  
- কিন্তু উনি তো আমার স্বামী , তার জন্যে কিছু করা মানে তো সম্মান।  
- তার জন্য কি করলি ? 
- নিজের জীবন দিয়েছি, এর থেকে বেশি আর কি করবো।  
- তার থেকে অস্ত্র নিয়ে লড়তে পারতিস।  যেরকম করে বাকি দুর্গের সব সৈন্য লড়েছিল , মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। যুদ্ধ কি নারীর কাজ? 
- তাহলে বলছিস পুরুষরা আমাদের জন্য প্রাণ দেবে, আর প্রাণ দেওয়ার পর শত্রুর প্রাণনাশ করতে না পারলে ধরা পড়ার ভয়ে আত্মহত্যা করবো, এই আমাদের কাজ।  
- তুই যে এতো কথা বলছিস। তুই আসলে কি ? 
- আমি এক কবির কল্পনা।  
- তার মানে তুই নেই ? 
- তুইও কি আছিস।  থাকলে এরকম তুই তোকারি কি করতে পারতাম?  তুই না রানী।  
- তা বটে। 
- আমি তো এখন তোর মতোই কল্পনা।  আমার গায়ে জায়েসী যা রং চড়িয়েছিলো , বানসালি তাতে চমক মেরেছে।   আমায় বানিয়েছে জলজ্যান্ত ইতিহাস।  
- ইতিহাস জলজ্যান্ত হয় না।  সে মলিন এবং মৃত।  
- তুইও তো মৃত।  
- আমার তো জন্মই হয়নি তো মৃত্যু কোথায় হবে। আমি জীবনানন্দের আত্মার থেকে বেরিয়ে কখনো শ্রাবনী , কখনো প্রিয়া , কখনো তনিমা , কখনো চৈতি।  
- এরা কারা? 
- যারা জন্মেছে।  যাদের পাওয়ার আগে পুরুষরা কল্পনা করেছে আমার মতো করে।  ঠিক যেমন করে খিলজি তোকে কল্পনা করেছিল। 
- সে বিধর্মী । তার কল্পনাতেও থাকা পাপ। তোর ঘেন্না হয়না হাজার পুরুষের কল্পনায় ঘুরতে। যে তোকে রূপ দিয়েছে তার থেকে ভালো কে বুঝেছে তোকে । 
- হয়তো হয় , হয়তো নয়। সে শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো আমার মধ্যে । হয়তো বাকিরা শুধু কামনা করে।  
- আমি শুধু এই কামনাতেই বাঁচতে চাইনি।  তাই আত্মহত্যা।  
- আমার তো আত্মহত্যারও  উপায় নেই।  আমি অমর। 
- আচ্ছা তুই কি খুব সুন্দরী ছিলিস ? 
- লোকে তো তাই বলে।  সবাই তো সুন্দর।  কার চোখে সুন্দর হচ্ছিস সেটাই বড়।  তোর তো শরীরই নেই।  কিন্তু তুইও তো সুন্দর।  
- আমি সেই ধোয়াঁশা, যার পেছনে হাজার হাজার পুরুষ ছুটে চলেছে , একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য।  আর তোর সম্মান রক্ষার্থে আজ হাজার হাজার পুরুষ পথে নেমেছে।  তাদের কি তোর পছন্দ হয়।  
- জানিনা তারা কি করছে।  আমার বলিদান তর্কের বিষয় নয়।  সেই সমাজব্যবস্থায় আমি যা করেছি তার পরিস্থিতি এখন নেই।  এগুলো শুধু ক্ষমতাপ্রদর্শনের এক মহাযজ্ঞ।  
- আজ যদি সিনেমা রিলিস হওয়ার পর দেখিস যে বানসালি তোর সত্যে এমন রং চড়িয়েছে যে তুই নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিস না, তখন? 
- যে তার জীবন শুধু সম্মান রক্ষার্থে দিয়েছে , তোর কি মনে হয় , তার সম্মান এতটাই ঠুনকো।  আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী পূজিত।  এক বানসালি আমার কি করবে।  আজ যদি এক রাস্তার পাশে পরে থাকা নোংরা পাগলির নাম হয় বনলতা সেন তাহলে কি তুই নোংরা হয়ে যাবি? 
- আমি তো কল্পনা , সেই পাগলিকেও যদি কেউ ভালোবেসে ফেলে অন্তঃসত্বা করে দেয় তাহলে আমি আবার সুন্দর হয়ে যাবো।  
- তোর কাছে বলা অনেক সহজ, তোর দিকে তাকিয়ে আছে হাজার হাজার পুরুষ, আমার দিকে হাজার হাজার নারী। তুই শান্তি দিয়েছিস , আমি শান্তির খোঁজ দিয়েছি। তুই জীবনের জয়গান গাস, আর আমি অমোঘ সত্যের সাথে পাঞ্জা লড়ি।  
- কিন্তু পদ্মিনী , আমরা দুজনেই পুরুষের আকুতি , তাদের সম্মান , তাদের স্বপ্ন। 
- তা বটে , কিন্ত আমরাও তো মানুষ।  যে পুরুষরা আমার সম্মান রক্ষার্থে আলোড়ন তুলছে তারাই নারী নির্যাতনে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে।  আমার আগে , আমার পরে অনেক রাজপুত রমণীকে তুলে দিয়েছে সুলতানদের হাতে।  সেদিন আমি নিজে চাইনি , আমি চাইনি তাদের মধ্যে একজন হতে।  আমি পালাতেও চাইনি।  পালালে সেদিন খিলজি জিতে যেত।  সে হেরেছে আমার হাতে। আমার প্রেত , তার চোখে দেখেছে পরাজয়ের দুঃখ।  আমি হারিয়ে দিয়েছিলাম তার লাম্পট্যের ঔদ্ধত্য।  আর সে যদি মুসলিম না হতো।  জানিনা তখন কি করতাম। রাজার মৃত্যুতে রানীর হাতবদল খুবই সাধারন ছিল।  সম্মান তখনও খোয়া যেত।  বনলতা , তোর জীবন আমায় দিবি ? তোর তো ধর্ম নেই।  প্রেমই ধর্ম।  এই সম্মানের ওজন আর বইতে পারছি না রে ।  আমিও চাই আমায় তোর মতো শুধু ভালোবেসে লোকে মনে রাখবে।  আমার ভয়াবহ পরিণতির জন্য নয়। আমি তোর মতো এক মন থেকে আরেক মনে ঘুরে বেড়াবো , দুই পুরুষের লড়াইয়ের কারণ না হয়ে।  
- আমি কিন্তু তোর জীবন চাই পদ্মিনী।  যেখানে কাতারে কাতারে মানুষ এসে মাথা ঝুঁকিয়ে থাকবে। 
- তুই ভুল বনলতা, তারা শুধু চায় তাদের গৃহিনী তাদের জন্য প্রাণ ত্যাগ করুক। আর কিচ্ছু না।  প্রেম নেই , ভালোবাসা নেই , আছে  শুধু এক উগ্র কর্তব্যের শেকল। আমি চাই না , নারী ফিরে যাক সেই ওজন দাঁড়ির দিন গুলোতে।  আমি চাই তারা আবার নারী হোক, কোনো মেকি সম্মান, কোনো পরিচিতি ছাড়া। তারা আত্মরক্ষায় আত্মহত্যা না করে রুখে দাঁড়াক শক্তির সাথে শক্তি হয়ে।  কিন্তু হায় , সেও কি সম্ভব। ……..  


আগের প্রবন্ধগুলো 

No comments:

Post a Comment