আমার অফিস ম্যাসাচুসেটসে। অফিসে পৌঁছানোর আগে হঠাৎ করে সেদিন হোয়াটস্যাপ এ খবর এলো বায়োজেন কোম্পানিতে কাজ করে আমার এক পুরানো কলিগ খুব চাপে আছে। বায়োজেন কনফারেন্স এ থাকা লোকজনের পর পর করোনা ভাইরাস ধরা পড়ছে। কি চাপের ব্যাপার। যদিও আমার অফিস বেশ কিছুটা দূরে বস্টন থেকে। কিন্ত চায়না থেকে যখন এখানে পর্যন্ত আসতে পেরেছে তাহলে গ্রেহাউন্ড ধরে অফিসে চলে আসতে বেশিক্ষন লাগবে না।
সেদিন অফিসে প্রচন্ড চাপ ছিল বলে বিশেষ কিছু আলোচনা হয়নি। কিন্তু পরের দিন লাঞ্চটাইমে ম্যাসাচুসেট একশো ছুঁয়ে গেলো। আর আমাদের ফেটে চৌচির। হঠাৎ করে দেখলাম অফিসে নানা জায়গায় ছোট ছোট জটলা। কান পেতে শুনতে পেলাম লোকজন বেশ ভয় পেয়ে আছে। কি হবে কি হবে। সবাই সবাই কে বলছে বাড়ি চলে যেতে আর গৃহবন্দী হয়ে থাকতে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত ওপরওয়ালা বলছে ততক্ষন কিছুই হবে না।
পরের দিন অফিসে এই ঘুসঘুসানি ফিসফিসানি বাড়তেই থাকলো। দুপুরে লাঞ্চ ব্যাগটা তুলে ক্যান্টিনের দিকে এগোচ্ছি একজন কলিগ বললো , “ভাই আজ থেকে ডেস্কেই খাও। ” আমি বললাম, “কেন “ সে একটা রীতিমতো মনোগ্রাহী পয়েন্ট বললো , “দ্যাখ মানছি বড় কোম্পানি সমস্ত পরিচ্ছন্নর দায়িত্ব নিচ্ছে। কিন্তু ক্যান্টিন সব সময়ই এই ছোঁয়াচে রোগের ডিপো।”
ভাবলাম তাই তো। জানিনা করোনা কতক্ষন বেঁচে থাকে কঠিন পদার্থের ওপর। আর ক্যান্টিনে তো সবাই আসছে খাচ্ছে চলে যাচ্ছে। আর পুছে দিয়ে যাচ্ছে নিজের খাবারের ন্যাপকিন দিয়ে। কে কোথা থেকে আসছে। কি ভাবে আসছে কেউ জানে না। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে লিখে যেত , “ অজানাকে খুব ভয় আমার এখন ওরে । ”
ধীরে ধীরে জটলাগুলোতে লোকজন উত্তেজিত হতে দেখা গেলো। কানাঘুঁষোয় শুনতে পেলাম যে হেলথ কোম্পানি হয়েও কেন ওয়ার্ক ফ্রম হোম দেওয়া হচ্ছে না বলে অনেকেই উত্তেজিত। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম জটলা গুলো হালকা হতে আরম্ভ করলো। আমার ম্যানেজার দেখি ব্যাগ গোচ্ছাচ্ছে। আমার দিকে ফিরে বললো , “ লাইফ ইস মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান এসক্যালেশান। ডু হোয়াটেভার ইওর হার্ট ওয়ান্টস।” আমার একটা মিটিং ছিল চারটে থেকে পাঁচটা। সেটা না করে বেরোতে পারবো না।
মিটিং রুমে আমি একা বসে থাকলাম। সবাই কল এ জয়েন করলো। মিটিং রুম থেকে দেখা যাচ্ছিলো , সবাই নিজের নিজের ডেস্ক এ বসে আছে। আমি একবার বললামও যে আমি মিটিং রুমে বসে আছি। কিন্তু কেউ শুনলেই না। মিটিং যখন শেষের মুখে তখন হঠাৎ করে আরেকটা মিটিং নোটিশ এলো যে অন্য একটা কলে জয়েন করতে।
কলে প্রায় দুশো লোক ছিল। আমাদের ডাইরেক্টর ঘোষণা করলেন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। যতদিন না অবস্থার পরিবর্তন হয় সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হলো যেন সবাই ঘর থেকে কাজ করে। যেহেতু আমাদের হোয়াইট কলার জব। তাই আমাদের সত্যি কোনো সমস্যা ছিল না। আই টি তে যারা সার্ভার নিয়ে কাজ করে তারা ছাড়া বাকি সবাই বাড়ি থেকে কাজ করতে পারে যদি ইন্টারনেট থাকে।
অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় প্রত্যেক দিন একটা বুড়ি স্প্যানিশ মহিলা যে কফি কমন এরিয়া পরিষ্কার করে , সে আমাকে হাসি দিয়ে “হোলা” বলে। সেদিন , কেমন একটা অস্বস্তি লাগলো। এই হিস্পানিকরা দিন আনা দিন খাওয়া লোকজন। আমরা তো না হয় ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবো। কিন্তু এদের কি হবে। অতো বড় ক্যান্টিনের অতো ইনভেন্টরির কি হবে ? জানিনা।
এরকম হাজার অজানা নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রেডিও তে জানতে পারলাম আমেরিকার করোনা কেস ১৬০০ ছাড়িয়েছে। ট্রাম্প ট্রাভেল ব্যান করেছে। কুড়িহাজার ডলার দিয়ে টিকিট কেটে বিদেশে থাকা আমেরিকানরা ফিরে আসছে। নিউ ইয়র্ক , ম্যাসাচুসেট , নিউ জার্সি , রোড আইল্যান্ড মানে কানেটিকাট ছাড়া সমস্ত নিউ ইংল্যান্ডে তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা।
বাড়িতে এসে প্রথমেই গিন্নি খবর দিলো স্কুল বন্ধ হওয়ার মেল্ চলে এসেছে। ছেলেকে কি ডে কেয়ারে পাঠানো ঠিক হবে ? সপ্তাহের আর দু দিন বাকি। ঠিক হলো এই দুদিন পাঠানো হোক, কারণ ডে কেয়ার তখনও বন্ধ হয়নি। আর সাড়ে তিন বছরের শিশুকে ঘরে আটকে রাখা একটা বিষম ব্যাপার। আর গিন্নির অফিস তখনও অফিসিয়ালি ডিক্লেয়ার করেনি ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তাই যেমন চলছে চলুক।
No comments:
Post a Comment