Monday, February 12, 2018

প্রবন্ধ ২৬ - সব উঠোনের দোষ



ওই যে , ওই তো , হলের কোণের দিকে।  আরে ওই তো হাততালি দিচ্ছে , একবার ডান পায়ে , একবার বাঁ পায়ে ভর দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে , সবাই টানছে , সে না না করছে , একবার ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, আবার পরমুহূর্তে ব্যাকফুটে। দু বার হাত তুলল , আবার হাত নামিয়ে ফেলছে , হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ধরেছো ওটাই আমি - প্রত্যেক সেলিব্রেশান ভিডিও তে আমার একটাই পোজ।  নৃত্যচেষ্টারত।  

সেই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে এখনো পৌঁছাতে পারিনি। ভাইয়ের বিয়ে , কলেজ পার্টি , অফিস পার্টি , মদ খেয়ে , দুঃখে , সুখে , প্রথম বৃষ্টিতে , প্রপোসাল একসেপ্ট এ , প্রথম চাকরি তে কোনো কিছুতেই আমি নাচতে পারিনি।  এমন বিট দেব না, যে তোর পাও, হ্যাপি ফুটের মতো নেচে উঠবে।  আমি এরকম কত লোকের মহান মহান চ্যালেঞ্জ হারিয়ে দিয়েছি তা কেউ ভাবতেই পারবেন না।  কারো ক্ষমতা হয়নি এই দুই এলিফ্যান্ট ফুটকে তোলার।  হাতিও নাচে।  আমি হাতির মতো হলেও নাচতে পারিনা। লোকে কারণে অকারণে যেকোনো একটা ছুঁতোতে গান বাজিয়ে নাচতে পারে।  আমি ব্যতিক্রম।  

এমন কেও নেই যে ভাসানে নাচেনি।  আমার বন্ধরা তো আবার ভাষণেও নাচতে পারে।  আমি আলাদা।  ফ্যান্টাস্টিক ফোর সিনেমায় যখন অতিকায় বেন এর পাথুরে চোয়ালে হাত রেখে অন্ধ মহিলাটি  বললো বিইং ডিফারেন্ট ইস নট অলওয়েস এ ব্যাড থিং , আমার গেঞ্জি গামছা হয়ে গেছিলো।  কি চাপ , কি চাপ যে সহ্য করতে হয় ভাইটু সে তারাই বোঝে যারা গান চললেই দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।  এক কোণে , একা একা।  যেকোনো বয়সের এক একটা হাত এসে যখন হাত ধরে টানে আর বলে ‘ডান্স লাইক নোবডি ওয়াচিং ‘ তখন ওই ভুল সেন্টেন্স লেখার জন্য ইচ্ছা করে মার্ক টয়েন কে টেনে এক থাবড়া কসাই।    

এখন শুধু ওয়াচিং তো নয় , ভিডিও তুলিং ফেসবুকে আপলোড করে খিল্লি করিং। এখন তো লোকেদের অদ্ভুত নাচ নিয়ে ইউটিউবে প্লে লিস্ট পর্যন্ত আছে।  কেউ মুরগির মতো ডান্স করছে, তো কেউ সাপের মতো। কত ধরণের নাচ।  দেশি বিদেশী মিশে এখন ফিউসন।  আর আমাদের ভাসান ডান্স।  উদ্দাম সেই ডান্স সত্যি বার বার টেনে নিয়ে যায় কুড়কুড়ি আর ঢাকের সামনে।  এগিয়ে যাচ্ছি , যাচ্ছি , এবার করবোই , এবার প্রাণ খুলে নাচবোই , দৃহপ্রতিজ্ঞা , পা এগোচ্ছে , মন দৌড়োচ্ছে , হাত ওপরে , সামনে ক্যামেরা তাক করে সবাই, গেলাম নেতিয়ে।  দুটো হাত জুড়ে গেলো পা গেলো থেমে আবার হাততালি শুরু , ব্যাকফুটে আস্তে আস্তে পেছনের ভিড়ে গেলাম সেঁধিয়ে।  

সব পারি , এটা পারিনা।  মাঝে মাঝেই কোলবালিশে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি।  কিন্তু কিছু করার নেই।  লোকে কারণ বলেছে , “তোর জীবনে আনন্দ নেই”।  উদ্দাম আনন্দ থাকলে তবেই নাকি উদ্দাম নৃত্য সম্ভব। তান্ডব নৃত্য তো শিব খুশিতেই করেছিল , বৌ মরেছিল বলে। আমি তো শালা দুঃখেও নাচতে পারিনা।  বয়েস ডোন্ট ক্রাই , দে ডান্স উইথ ওল্ড মঙ্ক এন্ড ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।  আমি মাল খেয়ে টাল সামলাতেই পারিনা , তো নাচ।  কি জ্বালাতন।  

আয়নার সামনে নিজেকে খারাপ বলাটা খুব খারাপ।  তাই অনেক বার নিজেকে বলেছি হয় মাভৈ নয় ফাক অফ।  মেনে নিয়েছি , কি দরকার।  সবাই নাচলে দেখবে কে।  কিন্তু ওই , ডান্স লাইক নোওয়ান ওয়াচিং।  শালা আমি দেখছি কি না দেখছি কেউ পরোয়া করে না।  নাচের শেষে হ্যা হ্যা করে কুত্তার মতো হাঁফানো লোকেদের জল দিতে দিতেই আমার জীবন চলে গেছে।  একগাদা মাল খেয়ে চূড়ান্ত নেচে হাউ হাউ করে বমি করা পাবলিক গুলোকে জায়গায় আমিই পৌঁছে দিয়েছি।  কিন্তু কে তার দাম দেয়।  আমার তো জীবনে কোনো আনন্দই নেই।  

এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া , বৌ এর সাথে “শ্যাল উই ডান্স” . দিব্যি সোফায় বসে পপকর্ন খেতে খেতে মুভির রোমান্স পার্টটা উপভোগ করছিলাম।  কি করে জানবো বৌ ডান্স পার্টটা উপভোগ করছে।  মাথাতেই আসেনা কি করে ওই হাতটা উঁচু করে ধরে বৌকে গোল গোল ঘোরাবো।  পরে যখন জানলাম আমাকে কিছুই করতে হবে না , বৌই ঘুরবে আমার হাতে সুড়সুড়ি দিতে দিতে ততক্ষনে আমার হাত গেছে বেঁকে।  তার ওপর আছে ওই ধপাস করে বৌ যাবে পরে আর আমি খপ করে ধরবো।  বৌ গেলো পরে , আমার কোমরে লাগলো খিঁচ, সেই খিঁচ নিয়ে খেলাম গালাগালি, আর সাতদিন ধরে বৌ বিছানায় শুয়ে কাতরাতে লাগলো আর আমি কাতরে কাতরে ঝান্ডু বাম লাগাতে থাকলাম ।  

যেদিন ওজন দুশো পাউন্ড অতিক্রম করলো সকলে বললো জুম্বা করতে। নাচ মানেই এক্সারসাইজ।  দু মাস আগেই গরবা করতে গিয়ে দেখেছি আমি শুধু দৌড়েই গেলাম আর হ্যা হ্যা করে হাঁফালাম।  নাচ কোথায়।  আমার জিমের পাশেই জুম্বা ক্লাস দেখে আমার হয়ে গেলো। সেই লাম্বাডা গানের ডান্স দেখেছিলাম ছোটবেলায়।  কে বলে প্রেতাত্মা নেই।  এতোগুলো  মরছে, আর মরেই সবার ঘাড়ে চাপছে আর নাচিয়ে ছাড়ছে।  ওগুলো মানুষের কর্ম? কি ভয়ানক।  আমি ব্যাকফুটে।  ট্রেডমিলে হাঁটাই আমার কাছে অনেক।  

অফিসে এইচ আর রায় দিলো বেস্ট টিম বিল্ডিং এক্টিভিটি হলো ডান্স টুগেদার।  বেশ মিষ্টি পার্টি চলছিল, হাতে এক পেগ নিয়ে নতুন নতুন লোকের সাথে নেটওয়ার্কিং করছিলাম।  হঠাৎ লাইট বন্ধ হয়ে গেলো, পার্টি লাইট জলে গেলো আর কেউ একজন চিৎকার করে উঠলো , ‘হিট ইট’ আর তারপরেই একের পর এক লোক দিলো পা মাড়িয়ে।  শিঁটকে থেকে কোঁতকা সবাই ঝাঁপিয়ে পরে কাঁপিয়ে দিলো।  আমি দেয়ালে টাঙিয়ে দিলাম নিজেকে।  এক জুনিয়র দিব্যি এসে বলে দিলো , ‘কি স্যার প্রেগনেন্ড নাকি ? ‘ অন্ধকারে মুখটাও দেখতে পারলাম না।  দেখলে দিতাম অপ্রাইসলে ঠুকে।  কিন্তু তার বদলে বড় ডাউন হয়ে গেলাম।  

ধুর শালা , বেশ করেছি নাচিনি।  ভূতের রাজা কেন তিন বরে নাচার বর দেয়নি জানো , কারণ ওটা ভূতের কেত্তন বলে।  কেন নাচবো? নাচলে কি লাভ হয়।  নো ওয়ান ইস ওয়াচিং , ফরম্যাল পরে ঘামিং , কুত্তার মতো হাঁফাইং - তারওপর মদ খেয়ে নাচা , শরীরের দফা রফা।  নো , নট হেলদি।  বনধুদের পার্টিতে গল্প করবো না দুম দাম করে নাচবো।  বৌ এর সাথে প্রেম নিবেদন, না ঘামের গন্ধ শোকানো, কোনটা ইম্পরট্যান্ট।  হাতির নাচ দেখতে কিউট লাগে , কোন মোটার নাচ দেখতে ভালো লাগে কি ? ভাসানে সবাই নাচে , আর সেই জন্যই যত ঝামেলা হয়।  নাচতে গিয়ে খেয়াল থাকেনা বলেই তো যত সেক্সচুয়াল কেলোর কিত্তি হয়। ডলফিন স্পোর্টিং ড্যান্স করে , আমরা কি জলে থাকি। পাখিরা মেটিং ডান্স করে , আমরা বহু বছর আগে জন্তু থেকে মানুষ হয়েছি।  এই বিয়ের পর ফার্স্ট ডান্সের মতো ন্যাকামো আর কিছু হয় বলে আমার জানা নেই , যত্তসব কপিক্যাট ।  তারওপর জাতটাও বাঙালি।  হয় রবীন্দ্রনৃত্য নয় দয়াল বাবা কলা খাবা।  মাঝে ব্যালান্স করছে ভাসান ডান্স।  ভুঁড়ি দুলিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে নাই বা নাচলাম।  দৃষ্টিদূষণ বলেও তো একটা জিনিস আছে।  যারা তিন মিনিটের গানে এক লক্ষ স্টেপ মনে রাখতে পারে , তাদের প্রণাম।  আমি দশ হাজার শব্দ মনে রাখি এই যথেষ্ট।  ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি যে ছেলেরা নাচে তারা ন্যাকা হয়।  আজ দুনিয়া কাঁপানো ছেলেদের নাচ দেখে সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেলেও , সেই মধ্যবিত্ত খুঁতখুতানি ফেলি কোথায়? যদি নাচি , নো ওয়ান ইস ওয়াচিং আর না নাচলে এভরিওয়ান ইস  নোটিসিং, লাভটা কার ? আর আমি একা নই, আমার মতো অসংখ্য দেয়াল ঘেঁষা থলথলে , থপথপে , থসথসে মানুষ আছে যারা কোমড় দোলালে কুকুরের কামড়ের মতো যন্ত্রনা দেয়।  আমরা এই বেশ ভালো আছি , নাচ মেরি বুলবুল  তো প্যায়সা মিলেগা। যা পয়সা কুরোগে যা।  আমাকে ক্ষ্যামা দে।  সরি আমাদের ক্ষ্যামা দে।  আমরা দূরে দাঁড়িয়েই হাততালি দি আর উঠোনের দোষ দি।   

বাকি প্রবন্ধগুলো 


No comments:

Post a Comment