বই পড়া নিয়ে জীবনের সময়ে অসময়ে নানা লোকে
নানা জ্ঞান , অজ্ঞান আর বিশেষ জ্ঞান দিয়েছে। কেউ বলেছে কিপ ইট আপ, কেউ নাম দিয়েছে বই পোকা ( বুক ওয়ার্ম) , কেউ
বলেছে শালা পড়েই যায় করেনা কিছু। বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নামের সাথে অকালবৃদ্ধ ও
এঁচোড়ে পাকা নামটা জড়িয়েই যায়। কিন্তু যে বই পড়ে , সে জানে এর থেকে সাংঘাতিক নেশা আর পৃথিবীতে দুটো নেই।
প্রত্যেকের জীবনেই বই এর সূত্রপাত
অজ্ঞাত। কারণ সেসময় বই শুধু
ছেঁড়ার আর চেবানোর জিনিস। তাই প্রথম বই, যেটা চিবিয়েছিলাম, সেটা সত্যি মনে নেই।
মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে পিছনে ফিরতে ফিরতে দেখি শয়ে শয়ে বইয়ের সারি। সবথেকে পুরানো মনে
থাকার মতো বই ছিল সহজ পাঠ আর তার কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি। জানিনা তাতে এডভেঞ্চার
কি ছিল কারণ এই শব্দের মানে তখনও বুঝিনি। কিন্তু এখনো যখন মুখে লেগে আছে তার মানে রোমহর্ষকও ছিল।
আমরা যখন জয়েন্ট ফ্যামিলি থেকে
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে চলে আসি তখন সবথেকে বেশি যা ছেড়ে চলে আসার দুঃখ হয়েছিল সেটা
আমার জেঠুর বাড়িতে থাকা একটা বইয়ের আলমারি। কাঁচ দেওয়া সেই আলমারিতে হাত দেওয়া আমার স্বপ্ন ছিল। যখনি খোলার জন্য এগিয়ে
যেতাম কেউ না কেউ এসে বলতো , বড় হ , তার পর পড়বি। কিন্তু বড় হওয়ার আগেই আমাকে সেই তাক ছেড়ে দিয়ে চলে
আসতে হলো। আজ আমার অবাধ যাতায়াত সেই আলমারিতে।
এরপর শুরু হলো অর্থাভাব। না না , বাবার চাকরির সঙ্গে কোনো
সম্পর্ক নেই। বাবা এমনিতে পড়াশুনা নিয়ে কোনো কিছু বলতো না , কিন্তু বই কেনার ব্যাপারে
তখন বেশ ভালোরকম নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন বই মানে কমিক্স। স্কুলে বেশ কিছু বড়োলোকের ছেলেই তখন ভরসা। চাচা চৌধুরী আর অরণ্যদেব ছিল
আমার মস্তিষ্ক ও মাংসপেশি। কতবার ভেবেছি অরণ্যদেবের সেই আংটি বানাবো যার
ঘুঁষিতে খুলির ছাপ পরে যায়। এমনকি একটা কামারের কাছেও গেছিলাম। কিন্তু সে বাচ্চা বলে
উড়িয়ে দিয়েছিলো। ভাগ্যিস বানিয়ে দেয়নি নাহলে ভাই আমার এখনো খুলির ছাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াতো।
এরপর এলো টিনটিন আর এস্টেরিক্স। মনে নেই
কিভাবে এই দুই কমিকসের একটা বিশাল সেট আমার হাতে চলে আসে এক সাথে। চাঁদে টিনটিন আর
এস্টেরিক্স ও ক্লেওপেট্রা ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো নানা অসম্ভবকে সম্ভব করার মধ্যে।
সেইসময় বড়োলোক বন্ধুদের কাছে হেনস্থা হতে
হতে , বেশ দুঃখে থাকতাম। শুধু এটুকু জানতাম , লজ্জার মাথা কেটে হোক , বা যা করে হোক তাদের সাথে টিকে
থাকতে হবে। সেইসময় বাবাই দা বলে একজন আমাকে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরিতে ভর্তি করে দেয়।
ব্যাস আর যায় কোথায়। পাগলার হাতে লাঠি দেওয়ার মতো , শুরু হয়ে গেলাম গোগ্রাসে
গিলতে। সেই লাইব্রেরির কাকু আমার পড়ার ইচ্ছা বুঝতে পারে। আর তার পর থেকে আমাকে
আর বাছতে হতো না। কাকু আমার জন্য নেক্সট বইটা নিজের ড্রয়ারে রেখে দিতো। আমি গেলেই দিয়ে দিতো।
সেই প্রক্রিয়া অন্তত
দশ বছর চলে।
এই দশ বছরে ,কাকুর দৌলতে জুলে ভার্ন ,
পান্ডব গোয়েন্দা , ফেলুদা , কাকাবাবু , অর্জুন , কিরীটি সব পড়া হয়ে গেছিলো। কিন্ত সবথেকে যা মন
করেছিল সেটা অনিল ভৌমিকের ফ্রানসিস সমগ্র। মুক্তোর সমুদ্র , ভাঙা আয়নার রহস্য , চিকামার দেবরক্ষী , হিরের পাহাড় এই সব
নাম নিয়ে ফ্রান্সিস , হ্যারি , পেড্রো নামক ভাইকিংদের গল্প আমার চিন্তাকে
পাখনা দিতো। বাংলা এডভেঞ্চার সাহিত্যে হয়তো তারা নাম করতে পারেনি কিন্তু আমার কৈশোরের
মননে স্বপনে শয়নে তারা বিরাজ করতো।
লাইব্রেরিতে বই আসতো বেশ দেরিতে। তার ওপর আমার
লাইব্রেরি ছিল খুব ছোট লাইব্রেরি। বইয়ের অর্ডার করলে বাজেট এপ্প্রুভ হয়ে আসতে আসতে কেটে যেতে বছরেরও বেশি। অথচ আমার বড়োলোক
বন্ধুরা তখন একটার পর একটা বই কিনে চলেছে। ফ্রান্সিসের গল্প তখন বই আকারে
বেরোচ্ছে। শুকতারা পূজাবার্ষিকীতেও বেরোতো এই ফ্রান্সিসের গল্প। আমাদের স্কুলে
বন্ধুদের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তুর বেশ কিছুটা ছিল ফ্রান্সিসের নানা ক্রিয়াকলাপ।
ঠিক যেমন এখন হয় গেম্স্ ও থ্রোন নিয়ে। কিন্তু এখন যেমন গেম অফ থ্রোন্স দেখার মতো সময় নেই , তখন ফ্রান্সিসের গল্প
কেনার মতো পয়সা ছিল না। লাইব্রেরি কাকুকে অনেকবার করে বলার পরে কাকু খুঁজে খুঁজে পুরানো শুকতারার
পূজা বার্ষিকী বার করে দিতে লাগলো আর আমি পরে পরে বন্ধুদের ভিড়ে কিছু কিছু কথা বলতে
লাগলাম। কিন্তু তারা তখন নতুন
নতুন যে বই বেরোচ্ছে সেগুলো নিয়ে কথা বলছে। আমার কোনো কথা নতুন থাকে না। ওরা ওদের ডিস্কাশনে আমাকে সাইড করতে থাকলো। সেইসময় আমি প্রথম
শিখলাম কিকরে অর্ধেক কথা বলে অর্ধেক কথা বলিয়ে নেওয়া যায়। আমি গল্পের কিছুটা
কল্পনা করে টোপ দিতাম আর বাকি গল্প জেনে নিতাম। এতটাই আমি বা আমার স্কুলের গ্রূপ পাগল ছিল অনিল
ভৌমিকের ফ্রান্সিস নিয়ে।
সমস্ত বইয়ের সঙ্গেই জীবনের গল্প জড়িয়ে
আছে। কিন্তু আজকে সেটা
শেয়ার করলাম যা জীবনের প্রথম রূপকথা যা এখনো পড়তে ভালো লাগে।
সমস্ত ফ্রান্সিস সমগ্রই নেট এ আছে। তার লিংক নিচে দিলাম
Francis
Somogro 6
No comments:
Post a Comment