Saturday, November 18, 2017

বিদেশযাত্রার ঠিক আগে


ওরেসাল্লা কি বিশাল প্লেন।  আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ছাড়বে।  তার পর টাটা ইন্ডিয়া , টাটা ধুলো , টাটা ভিড় কিন্তু টাটা ফুচকা , টাটা ঝালমুড়ি , টাটা রসগোল্লা , টাটা মিষ্টি দই , টাটা ঠেক।  নাঃ নেমে যাই।  কি হবে বিদেশ গিয়ে।  বেশ ভালোই তো ছিলাম।  কি কমি আছে আমার।  বাড়ি ডান , বিয়ে ডান , বাচ্চা ডান।  ফালতু ঝামেলা মাথায় নিচ্ছি।  কিন্তু ডলার ইস ডলার বাবা।  এক ডলার চৌষট্টি টাকা।  কিন্তু খরচও তো ডলারে।  শুনেছি বিয়ে করে বিদেশে গেলে কোনো লাভ নেই।  আমি তো বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি। সব ফুঁকে দিয়ে চলে আসবো।  এখানে সেভিংস খারাপ কি হচ্ছিলো।  মাসে মাসে পি পি এফ আর মিউচুয়াল ফান্ডে তো দিব্যি টাকা জমে যাচ্ছিলো।  সপ্তাহে সপ্তাহে রেস্তোরাঁ, মাঝে মাঝে দী-পু-দা।  খারাপ কি ? শুনেছি ওখানে নাকি লোকে না খেয়ে পয়সা জমিয়ে আসে।  কিন্তু সবাই মোটা হয়ে আসে দেখেছি।  পলুশন ফ্রি।  আমার মফস্বলেই বা পল্যুশন কি আছে।  দিব্যি ছয় ঋতুর খেলা।  ওটা আবার ঠান্ডা জায়গা।  শুনেছি মাইনাস তিরিশ পর্যন্ত যায়। নানা এ কি করলাম।  লোকে ঘুরতে আসে ট্রপিকাল কান্ট্রি তে।  ফ্রেশ খাবার খেতে।  আমি কিনা ফ্রোজেন এর দেশে যাচ্ছি।  ছেলেটা কি শিখবে।  বাংলায় কথা বলবে তো। ওখানের বাঙালিগুলোর ছেলেপুলেরা তো বাংলায় কথা আর মাছের ঝোল ভাত সব অচ্ছুত মনে করে।  দেবো এক টেনে থাবড়া।  কিন্তু থাবড়া দিলে তো পুলিশে দেবে।  ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স।  বাচ্চাকে ফস্টার কেয়ারে নিয়ে চলে যাবে।  ওরে বাবা কিন্তু এই ভয়ানক ছেলেকে সামলাবো কি করে।  ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে রোজ।  গাড়িও তো চালাতে পারিনা।  সারাজীবন তো আটটা সাতের বান্ডেল লোকাল।  গাড়ি শিখতে বলেছিলো।  সময় হয়নি।  ও সব হয়ে যাবে। উচ্চশিক্ষিতর দেশ।  শেখাবেও ভালো।  ঠিক শিখে নেবো। আপাতত হোটেল বুক আছে, আর সাতদিনের খিচুড়ির ব্যবস্থা করে নিয়ে যাচ্ছি।  তাতেই হবে। কিছু না হলে বিয়ার দিয়ে চালিয়ে নেবো।  ওখানে তো জলের থেকেও সস্তা বিয়ার।  কিন্তু ছেলেটা খাবে কি ? বেবি ফুড খুব কস্টলি। ও ব্যাটা বড় ছেলে , সব খাবে।  এতো ঢঙের কিছু নেই।  ডিজনিল্যান্ড দেখতে হলে ওখানেই যেতে হবে. কিছু একটাতে তো কম্প্রোমাইজ করতেই হবে।  গাড়িটা শিখে রাখা উচিত ছিল।  শুনেছি নাকি এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি রেন্ট পাওয়া যায়।  গাড়ি চালিয়ে  চলে যেতাম।  যদি ট্যাক্সি  ডোবায়।  এখানে তো নতুন লোক দেখলেই ঠকানো চালু।  উবার তো চলে।  ও কিছু হবে না।  কিন্তু যদি হয় , বিদেশ বিভূঁইয়ে ঠ্যালা সামলাবো কি করে।  তার ওপর ইংলিশ।  এখানে তো অফিসেও বলতে  হয় না।   শুধু অনসাইটের সাথে কথা বলতে আর ক্লায়েন্ট মিটে  কিছুক্ষন  বলে দিলেই শেষ।  কিন্তু সারাদিন সবকিছুতে ইংলিশ বলতে তো হাঁফিয়ে পড়বো।  আমি তো কনভেন্ট থেকে পাস্ করা মড ছেলে নই , যারা এখানে থেকেও মন পরে থাকে বিদেশে।  সত্যি , কি যে ডিসিশন নিলাম।  বাবা মা কে একলা ছেড়ে যাচ্ছি।  যদি কিছু হয়ে যায়। ভাই যদিও আছে।  কিন্তু সেও তো কাছে নেই।  কিছু হলে কে দেখবে।  আর হতে তো দু মিনিট।  সারাজীবনের মতো দোষী হয়ে যাবো।  যারা অনসাইট পেয়েছে বলে হিংসা করছে তারা তো গলা টিপে ধরবে।  ধুর সবার কথা ভাবলে চলে।  মা বাবারও তো বিদেশ ঘোরার শখ। আগে আমি যাই তারপর তাদেরও ঘুরিয়ে দেব। কিন্তু বৌয়ের সাথে তো সবসময় থাকতে হবে।  ওখানে বন্ধু বানাতে তো সময় লাগবে।  সবাই তো আমি আমার তুমি তোমার। এখানে ওর কত কিছু করার ছিল ওখানে গেলে তো শুধু আমি আর আমার ছেলে।  সারাক্ষন মাথা খাবে।  উফ কি জ্বালা।  নেমেই যাই।  ওখানে এতো কম লোক কেন।  ওদের তো এক গাদা করে বাচ্চা হয়। ভিড় ভালো নয় কিন্তু ফাঁকা তো আরো খারাপ।  ডিপ্রেশন চালু হয়ে গেলে।  আমার তো লোকজনের সাথে কথা বলতে না পারলে বমি আসে।  ওখানে ইংলিশ এ ভেজাল বকবো কি করে।  ওখানকার কলিগরা আবার সাউথ ইন্ডিয়ান।  একটাও বাঙালি নেই।  ইন্টারনেট আর ভিডিও চ্যাট ছাড়া বাংলার কোনো মুখ নেই।  ইশ আমার অতো দিনের বইয়ের কালেকশান।  ইলেক্ট্রনিক বই পড়তে আর কত ভালো লাগে।  ধুর ধুর ধুর। বলে নাকি বাঙালি বাংলার বাইরে বেশি বাঙালি।  ধুর , কচি এঁচোড়ে ঘুঁষো চিংড়ি না পড়লে কি আর বাঙালি হওয়া যায়। যাক বাবা, শুনেছি ওখানে বাংলাদেশী প্রচুর।  তাহলে এটলিস্ট বাংলার মাছ পাওয়া যাবে।  হোক না ফ্রোজেন।  কিন্তু ধড়পড় করে নড়তে থাকা ছোট রুই কাতলার মতো কি আর স্বাদ পাওয়া যাবে।  ওসব বার্গার টার্গের আমার জন্য নয়।  দিনে একবার ভাত পাবো তো।  প্লেনটা  মনে হলো নড়ে উঠলো।  ছাড়ার সময় হয়ে গেছে তাহলে। এখনো গেট বন্ধ হয়নি।  সময় আছে। পৃথিবী ঘুরতে চেয়েছিলাম তো সারাজীবন ধরে।  এখন কেন এতো সমস্যা মাথায় আসছে।  কিছু পেতে গেলে তো কিছু দিতেই হবে।  কিন্তু পান তো পাওয়া যায় না।  রবিবারের কচি পাঁঠার ঝোল ভাত খাবার পর একটা মিষ্টি পান কি করে ছাড়া যায়।  অত্যাচার অত্যাচার।  কোনো পথ সোজা নয়।  ডলার আমাকে ডলে দেবে।  কি সব ভুলভাল ফেস্টিভ্যাল।  হ্যালোউইন , থ্যাংক্সগিভিং  আর ক্রিসমাস।  আমাদের তো সারা বছর ফেস্টিভ্যাল।  আমরা তো বুদ্ধপূর্ণিমা , হোলি দিওয়ালি , এক্স এক্স পুজো , মহরম , ক্রিস্টমাস সবই পালন করি।  ওদের কেন নেই এরকম।  সবাই যদিও নানা রকমের দুর্গাপূজার ছবি পাঠায় কিন্তু দুষের স্বাদ কি ঘোলে মেটে।  উফফ লস্যিও মিস করবো।  শুধু মিস আর মিস।  ছোটবেলা থেকে তো যা ধরতে চেয়েছিলাম সেগুলো তো অধরাই থেকে গেলো।  এখন অন্য দেশে গিয়ে আবার ছোট থেকে শুরু করতে হবে।  এখানে বেশ সিনিয়র ছিলাম সবার ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে ভালোই চলছিল।  কি মরতে দু পয়সার জন্য উজিয়ে সাগর পাড়ি।  আচ্ছা পয়সাটা কি আগে।  মানি তো শুধু পেট্রল অফ লাইফ।  কিন্তু বাকি গাড়িটা।  কিন্তু গাড়িতে পেট্রল না দিলে গাড়ি আর গার্বেজ তো একই।  তাহলে পেট্রোলের মতোই মানিই জীবন কে জীবন করে তোলে।  বেশি ইমোশন টিমোসন নিয়ে লাভ নেই।  পয়সা যার নেই সে ফালতু। তাহলে তো এতো কবি সাহিত্যিক সবাই কি ফালতু। আর  ধুর ধুর , কি সব ভাবছি।  আমাদের মতো ছা-পোষাদের ঝাঁকে কইদের মতো করে ভাব।  মাইনে যখন সামনে দিয়ে এসে টাটা করে চলে যায় তখন কেমন লাগে।  পয়সা ছাড়া আর কিছু ভেবে লাভ নেই।  কিন্তু দেশ জাতি এসবের কি হবে।  যে দেশ আমাকে এতো বড় করলো তাকে কিছু রিটার্ন না দিয়েই টাটা।  নানা , আমার ইনভেস্টমেন্ট তো সব এখানেই।  টাকা পাঠাবো তো।  শুধু টাকা পাঠালেই কি হবে ? টাকা দিলেই দায়িত্ব শেষ ?  আবার সেই একই চিন্তা করছি।  কাউকে না কাউকে তো রসদ যোগান দিতে হবে।  দেশ কে ভালোবাসলেই চলবে। আমি সুযোগ পেয়েছি , রসদ যোগান দিয়ে যাই।  যারা পরে থাকলো তারা আগে এগিয়ে নিয়ে যাক দেশটাকে।  
কিন্তু লোকে কি তা বুঝবে , যে হারে ন্যাশনালিজমের ঢং প্রচার করা হচ্ছে।  ওসব দেশটেশ ভেবে লাভ নেই।  শুধু একটাই ভাবার মতো জিনিস সেটা এই বয়সে বাবা মা একা থাকবে।  দ্যাটস অল।  চিমটি যারাই কাটবে তারা হিংসা থেকে কাটবে।  কে না চায় বিদেশ যেতে।  কিন্তু কেউ কি চায় কেনিয়া, ঘানা , জিম্বাবোয়ে তে যেতে।  যেখানে মাল্লু সেখানেই যেতে চায়।  সুযোগ পেলে কেউ ছাড়ে না।  তবে আমি কেন ছাড়বো।  ছাড়বো না।  যাবোই যাবো।  দেখি কে আটকায়।  নিজের বাবা মা আটকায়নি তো বাকিরা ফালতু।  যে যা বলে বলুক।  আমি চললাম।  আবার আসিব ফিরে গঙ্গা নদীর তীরে, আমার রেখে যাওয়া সেই বাংলায়।   


ঠিক আগে সিরিজ

No comments:

Post a Comment