বাইরে জমে থাকা বরফ গলে গেছে অনেক দিন। সকালে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কোকিল তো এখানে ডাকে না। কিন্তু বসন্তের পাখি অনেক আছে। তারাই গাইছে। স্নো বুট ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। জ্যাকেটও এখন পাতলা। লনে গজিয়েছে ঘাস। এখন বাচ্চাদের বেরিয়ে আসার সময়। তারা বেরিয়ে আসবে দলে দলে। মাঠে ঘাটে পিল পিল করে ভিড় জমাবে। খেলবে , কাদা মাখবে , ঘামে চপচপে হয়ে বাড়ি ফিরবে লাল টমেটো হয়ে। প্রতি উইকেন্ড এ হবে নানা টুর। বাবা মা কে বগলে নিয়ে ঘুরতে যাবেন মহাশয়রা। চড়বেন পাহাড় , পুঁতবেন গাছ। আরো কত কি। কিন্তু এ বছর হয়তো আর কিচ্ছু হবে না।
আমার ছেলে এখন ফাঁকা কমিউনিটি তে ডেলিভারি গাড়ি থেকে বেরোনো লোকেদের দেখলেই ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করে , “হ্যালো - ও -ও ও। …….হ্যালো - ও -ও ও ” উত্তর আসেনা। সে সামনের মাসে চারে পড়বে। তার এখন সাংঘাতিক ছুটে বেড়ানোর সময়। আর সে মানুষ ভালোবাসে। দূর থেকে বাচাদের কলরব শুনে “চিলফ্রেন চিলফ্রেন ” ( ফ্রেন্ড আর চিলড্রেন একসাথে) বলে দৌড়ে যেতে চায়। কিন্তু সে পারেনা।
কি অসহায় অবস্থা। নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তার দুটো স্কুল ছিল। একটা ডে কেয়ার , একটা স্কুল। তার চারপাশে ছিল প্রচুর মানুষ। নানা রঙের , নানা বৈচিত্রের নানা কর্মকান্ডের মানুষ। এখন তার হাতে শুধু বাবা আর মা , আর দুজনেই কর্মরত। তাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোমে বাধা দিলেই জুটছে কপালে চিৎকার। বেরিয়ে আসছে কান্না। অপরাধবোধে জড়িয়ে থাকা আদরের কিছু মুহূর্ত বাদ দিয়ে কিই বা তারা দিতে পারে। এবার তার দাদু দিদা , ঠাম্মা -দাদুর কাছে যাওয়ার কথা ছিল , তারাও এখনো সেই ফোন বন্দী। রোজ যখন কথা হয় , তখন তাদের দুশ্চিন্তা ভরা মুখ দেয়না তাকে আনন্দ।
তার ছিল রাশি রাশি খেলনা। না বাড়িতে নয়। যেহেতু সেও বড়দের মতো অফিস করে। তার দুই স্কুলে ছিল ভর্তি ভর্তি খেলার সামগ্রী। আমাদের পক্ষে সেই খেলনার সমকক্ষ খেলনা কেনা অসম্ভব। তার ছিল বল পিট্। সেখানে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতো। তার ছিল বিশাল বড় বড় প্লে এরিয়া। যেখানে স্লাইড করতে পারতো , দোলনা চড়তে পারতো। আর পারতো ছুটে বেড়াতে। তার কাছে এখন একটা ছোট্ট স্লাইড। যেটাতে সে আঁটে না। কিন্তু তাই দিয়েই চলছে। একা একাই। লাইন নেই , দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার ব্যাপার নেই। নেই বন্ধুদের সাথে দৌড়ানোর ব্যবস্থা। আছে বাবা , ছুঁড়ে দিচ্ছে বল, আর ডুবে যাচ্ছে মোবাইল নয়তো ল্যাপটপে।
তার পছন্দ ছিল বই। একের পর এক বই নিয়ে আসতো বাবা। লাইব্রেরি থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত কুড়িটা করে নানা রঙের বই এসে হাজির হতো তার ঘরে। বাবা অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে একের পর এক বই পরে যেত তার কানের কাছে। কিন্তু এখন লাইব্রেরি বন্ধ , নতুন বই আর আসছে না। সেই পুরানো বই নিয়েই নাড়া ঘাঁটা। এই এক মাসে সব মুখস্ত হয়ে গেছে।
তার স্কুলে ছিল আর্ট টাইমের নোংরা করার আনন্দ। কৌটো কৌটো রং , মুঠো মুঠো রং পেন্সিল, হাজার হাজার ডু ইট ইওরসেল্ফ একটিভিটি। গায়ে এপ্রোন পরে দু হাত রঙে চুবিয়ে ছাপ দিতো সে সাদা কাগজের ওপর। আজ একটা রঙের ডিবি থেকে একটু রং বার করে একটু খেলার পরেই তাকে ক্লিন করতে হয়। কড়া নজর , কার্পেটে না পরে।
যেহেতু মাঠে খেলতে পারবে না তাই মাঝে মাঝে গাড়িতে চাপিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি ফাঁকা রাস্তায়। মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাসের পর বেরিয়ে আসে , “নো স্কুল , নো পিপল , নো ফ্রেন্ডস।” কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ির দুলুনি তে ঘুম এসে যায়। সিটবেল্ট বাঁধা শরীরটা গভীর ঘুমে ঢুলে পড়ে। চোখ খুলতে আবার সেই বন্ধ ঘর।
মাঝে মাঝে কমিউনিটিতে হাঁটতে নিয়ে গেলে , হঠাৎ করে চোখে পড়া মানুষের দিকে দৌড়ে যায়। “হাই” বলতে চায়। কিন্তু চেপে ধরে থাকি হাতটা , যদি ছুটে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়। বুকের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে ওঠে , কিন্ত কিছু করার নেই।
আগে ছিল বাবা মার্ সাথে সপ্তাহান্তে বাজার করতে যাওয়া। ওয়ালমার্টের আইলে আইলে বসে থাকা মেলার মধ্যে ছুটে বেড়ানো আর রেজিস্টার কাউন্টারের ওপরে লেখা নাম্বার গোনার খেলা। এখন তার দোকানে যাওয়া বারণ। এমনকি দোকান থেকে ফেরার পর বাবা মার কাছে যাওয়া বারণ। জিনিসপত্রে হাত দেওয়া বারণ। শুধু বারণ আর বারণ।
স্ক্রীনটাইম নিয়ে এতো তোলপাড়ের পর, এখন সবাই নীরবে বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের ট্যাবলেট বা ফোন। ঘাড় ঝুঁকে যাচ্ছে মিকি , মিনি , ডিজনি আর মোবাইল গেমের মধ্যে। স্কুল থেকে পাঠানো হচ্ছে নানা এক্টিভিটির খবর। কিন্তু বেশির ভাগ অনলাইন নয়তো বাবা মা কে সঙ্গে নিয়ে বসতে হচ্ছে। আর বাবা মা অফিসের সাথে তাল মেলাতে খিঁচিয়ে যাচ্ছে। আগে মাঝে মধ্যে ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে বসে থাকা মুভি নাইট এখন আর হচ্ছে না। কারণ খালি সময়ে সবাই চেষ্টা করছে যাতে টিভি ইন্টারনেট ছাড়া অন্য যদি কিছু করা যায়।
দরজার বাইরে ছুটে যাচ্ছে কাঠ্বেরালি , উড়ে যাচ্ছে পাখি , দৌড়ে বেড়াচ্ছে খরগোশের দল। কিন্ত তার পেছনে ছোটার জন্য দরজা আর খুলছে না। নরম ঘাস কচি পায়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার বদলে এক নিশিডাকা হাতছানির মতো দুলে যাচ্ছে। ফুটছে ড্যান্ডেলায়ন , সবুজ পাতা আসছে গাছে। চেরি ব্লসম , আপেল ব্লসমে সাদা , হয়ে যাচ্ছে গাছগাছালি কিন্তু ছোট্ট মানুষটা আর বিকশিত হচ্ছে না।
স্কুল বন্ধ থাকবে এই পুরো স্কুল ইয়ারটা , মানে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ডে কেয়ারও খুলবে না। খুললেও হয়তো আমরা পাঠাবো না। একাকিত্বে কেটে যাবে একটা বড় সময়। জীবন মানুষ একবারই পায়। শৈশব , কৈশোর , যৌবন সবই মানুষ একবারই পায়। একটার সাফল্যের ছাপ আরেক জীবনে এসে পরে। জানিনা এই শিশুদের পরবর্তী জীবন কেমন হবে। যুদ্ধের সময়ের বছরের পর বছর এই লকডাউনে বসে থাকা শিশুগুলোর ওপর পরবর্তীকালে এসেছিলো মানসিক বিকৃতি। জানিনা , এরাও কোনো কিছুর শিকার হবে কি না।
শেষ হোক এই বন্দী দশা এই কামনা করি।
No comments:
Post a Comment