Tuesday, June 3, 2014

নৃসংশ প্রত্যুষ

ফুরফুরে মেজাজে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। সুন্দর সকাল। ঝকঝকে রোদে নতুন পাতা উচ্ছাসে ফেটে পরছে। শীতের চূড়ান্ত আঘাতে নুয়ে পড়া শুকনো ডালপালা আবার কুসুমিত মনহরা। আকাশ নীল।  মাঝে মাঝে সাদা মেঘ মিষ্টি হাসি হেসে সুপ্রভাত বলে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙ্গেছে কার্ডিনাল পাখির ডাকে। বেরনোর সময় পাশের এপার্টমেন্ট এর ভোঁতামুখ পাগ টাও যেন হাসি মুখে তাকিয়েছে আমার দিকে। রোজ ভুলে যাওয়া টিফিন বক্স টাও আজ ঠিক ঠাক হাতে ঝুলে পরেছে। শুক্রবারের সকাল, তাই কাজও কম। সব কিছুই আজ যেন ঠিক ঠাক।

পার্কিং থেকে বার করে accelator এ চাপ দিতে আমার টয়োটা ক্যাম্রির ড্যাশবোর্ড এ “জাগরনে যায় বিভাবরী” বেজে উঠল। আমার এক কুসংস্কারের উদাহরন আমার গাড়িতে লোড করা সিডি তে গানের কালেকশান। একই সিডি তে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ঝিনছ্যাক গান, বিষাদ ও উদ্দামের গান সব ভরে রাখি। দিনের শুরুতে যে গান চলে দিন টা সেরকমই হয়। কিন্তু আজকে যখন এই গানটা চলল তখন আর ভাবার কিছু নেই। সব যখন সুন্দর তখন অফিস যাত্রাও সুন্দর হওয়ার কথা। 

এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে একটা ছোট রাস্তা, তার পর কিছুটা দূর যেতে পরবে ফ্রিওয়ে।  ফ্রিওয়ে আর হাইওয়ের  মধ্যে তফাত শুধু সিগনালের। ফ্রিওয়েতে সিগনাল থাকে না।  ১২০ কিলোমিটার গতিতে ক্রমাগত গাড়ি চলে যাচ্ছে। আমাকেও মিশতে হয় তাদের সাথে আর অনুরূপ কৌশলে বেরিয়েও আসতে হয়।
  
ছোটো রাস্তায় বেরোতেই এক নারকীয় দৃশ্যের সঙ্গে চোখা চোখি। মোড়ের মাথায় একটা বড় সর হরিণ মরে পরে আছে।  গলাটা রাস্তার দিকে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে মাথা থেকে। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। বসন্তের দিন শুরু হলো শীতল মৃত্যুর দর্শনে।

এই দৃশ্য এখন অনবরত। রাস্তায় শুধু রক্তের ছড়াছড়ি। কিছুটা এগোতেই দেখি একটা কাঠবিড়ালি রাস্তার মাঝে পরে আছে।  বেশিক্ষণ  মরে নি। কারণ, পুরো শরীরটাই এখনো দেখা যাচ্ছে। পাশ কাটাতে গিয়ে পাশের লেনে একটু ঢুকে পরেছিলাম।   পেছন থেকে হর্ন খেলাম। ধাক্কা মারতে মারতে মারেনি পেছনের লোকটা। সামলে নিয়েছে। কি ভাগ্য।

আরেকটু এগোতে দেখি সামনের গাড়িগুলো দাড়িয়ে আছে।  আমার সামনে অন্তত দশটা গাড়ি। এখানে হর্ন মারার চল বা নিয়ম নেই।  তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম ওই হরিণ আর কাঠবিরালিটার কথা।  হরিণের দ্রুততা চিতাকেও হার মানায় কখনো কখনো। কিন্তু দেখো। রাস্তার মোড়ে মরে পড়ে আছে সুগন্ধি মৃগনাভির অধিকারী সুন্দরী। আগামী ২ ঘন্টায় সেই দেহ কেউ তুলবেও না।  পরেই থাকবে। কারো অসতর্কতায় তার মৃত্যু ঘটেছে বটে, কিন্তু আরো অনেকের অসতর্কতায় তার শরীরের বেশ কিছু অংশ পিষ্ট হয়ে বিভত্স রূপ নেবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

হরিনের আঘাতে বা হরিন কে আঘাত করে অনেক বড় বড় ঘটনা থুড়ি বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে বহুবার। উত্তর আমেরিকা আর কানাডার বহু প্রদেশে এর জন্য আলাদা ইন্সুরেন্স আছে।  কারণ এত বড় জন্তু বিনা ছাপ রেখে ইহলোক ত্যাগ করে না।  রাস্তা পেরোবার হুটোপাটা তে সচরাচর এই ধাক্কা ঘটে থাকে। কিন্তু ধাক্কার ঠিক আগের মুহুর্তে মৃত্যুর চোখে চোখ রাখে এই নয়নাভিরাম জন্তুটি।  মাথা দিয়ে আটকাতে চায় মৃত্যুর গতি।  পারেনা।  শুধু আঁচর লাগে মৃত্যুর গায়ে আর রক্ত দিয়ে পা ধুয়ে নিঃশব্দে বিদায় নেয়।  

এই ছোটো ছোটো রাস্তায় যখন এই ঘটনা ঘটে তখন সিটি অফিস থেকে ওই দেহাবশেস সরিয়ে দেওয়া হয় ঘন্টা দুই তিনের মধ্যে। কিন্তু যখন এই ঘটনা ঘটে ফ্রিওয়ে তে।  তখন সেই দেহ কতদিন পরে থাকবে তার কোনো ইযত্তা নেই।  গত গরমে Detroit  থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার সময় পেনসিলভেনিয়ার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম।  দুপাশ ধরে এইরকম লাশের ছড়াছড়ি ছিল।  জনবসতি নেই চারপাশে, তাই পচে গলে মিশে যাওয়া ছাড়া সত্কারের ব্যবস্থাও ছিল না সেই লাশগুলোর। সে এক বিভত্স রূপ. যারা দেখেছে তারা ভুলবে না।
  
আর এই ঘটনা সব জন্তুর ক্ষেত্রেই সত্যি। ওই ছোটো কাঠবিরালিটা , যার চপলতা আর দ্রুততার নজির দেওয়া যায়, তার লাশটার কিছুই বেঁচে থাকবে না আমি যখন অফিস থেকে ফিরব। কেউ তুলবেও না।  কেউ সাবধানতাও নেবে না।  কারণ অনেকে দেখতেই পাবে না।  আধুনিকতার অতিরিক্ততায় মানুষ এখন গাড়ি চালানোর সময় এক অদ্ভূত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চালিত হয়।  রাস্তায় চোখ, স্টিয়ারিং এ এক হাত, আরেক হাতে কফি, কানে ব্লু টুথ হেডসেটে কথা বলতে বলতে মানুষ গাড়ি চালায়। তার মন শুধু তার চোখের বশে থাকে না।  তাই চোখ ও সেটাই দেখে, যা তার দেহকে বাঁচাতে পারে। অন্যের দেহ নয়।  তাই পরে থেতলে যাওয়া দেহটা ধীরে ধীরে মিশতে থাকে মাটির সাথে -- এক একটা চাকার আঘাতের সাথে। শেষে ফুরফুরে লোমওয়ালা চামড়াটা হাওয়ায় উড়ে রাস্তার পাশে সরে আসে।  

আবার এক হর্ন খেলাম।  খেয়ালই করিনি সামনের গাড়ি গুলো এগিয়ে গেছে। কিছুটা এগোতে বুঝতে পারলাম ট্রাফিক জ্যাম এর কারণ। একটি কানাডিয়ান গুস পরিবার রাস্তা পেরোলেন। এ এক দারুন সুন্দর দৃশ্য। শীতের শেষে ঝাঁকে ঝাঁকে এই গুস বা বড় হাঁস ( আমাদের রাজ হাঁসের মত ) এসে হাজির হয় পঞ্চহ্রদ( ইরি, হুরণ, অন্টারিও, সুপিরিয়র, মিশিগান )  বা গ্রেট লেকস এর চার ধারে। যদিও সারা উত্তর আমেরিকায় এদের বিচরণ ক্ষেত্র তবে সব থেকে বেশি ঝাঁক এই অঞ্চলেই দেখা যায়।  বসন্তের সাথে সাথে ডিম ফুটে বেরোয় হলুদ তুলোর মত ছোটো ছোটো বাচ্চা। এরা পরিবার কেন্দ্রিক এবং এক সাথে পরিবারের মত ঘোরে। শীতের শেষ সময় যখন এরা ডিম পাড়ে এবং তাতে তা দেয় তখন পুরুষ হাঁস গুলো সাংঘাতিক মারকুটে হয়ে ওঠে।  তাই "গুস এটাক" উত্তর আমেরিকার উত্তর ভাগে এক বড় সর সমস্যা।  এরা পরিযায়ী কিন্তু এদের গন্তব্য প্রত্যেক বছরই প্রায় একই থাকে। তাই গত বছর যে গুসটা আমাদের অফিসে সংসার বানিয়েছিল সে এবার চেষ্টা করেছিল সেখানেই বাস বাঁধতে। গত বছর একটা লাল ব্যান্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটির গলায়। তার থেকেই চেনা গেছে এবার। কিন্তু এবার আর তাকে বাসা বাঁধতে দেওয়া হয়নি। 

যাই হোক, এই গুস রা কখনো ফ্রিওয়ে তে মারা পরেনা। কারণ এরা লোকালয়ে থাকে আর ছোটো  ছোটো দলে ভাগ হয়ে ছোটো রাস্তা পেরোয়। আর এদের জন্য গাড়ি থেমে যায়।  মাঝে মাঝেই এই  মা , বাবা আর তাদের পাঁচটি তুলোর দলা যত ট্রাফিক জ্যাম এর কারণ হয়ে যায়।  মনটা খুশি হয়ে গেল।  কার না ভালো লাগে এই দৃশ্য। 
সামনেই ফ্রিওয়ে। ফ্রিওয়ে তে উঠতে গেলে একটা রাম্প মানে গোল রাস্তা ধরে স্পীড আপ করতে হয়। এক্সিলারেটর এ জোরে চাপ দিযে এগোতেই দেখি পালকের মেলা। নীলচে কালো পালকে সামনের রাস্তা যেন ভরে গেছে। সামনের গাড়ি গুলও ধীরে হয়ে গেছে। আমিও ধীরে করে নিতে বুঝতে পারলাম কেস টা কি।  একটা টার্কি ধাক্কা খেয়েছে কিন্তু পালাবার চেষ্টায় আবার আরেকটা গাড়িতে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশে পরে আছে।  টার্কির প্রচুর পালক আর মুরগির থেকে বেশ কিছুটা বড়।  বেশ সুন্দর দেখতে একটা পাখি। ময়ুরের মত পেখম মেলে। গলাটা যদিও শকুনের মত।   কিন্তু জংলি টার্কি দেখলে সত্যি মন ভরে যায়।  খেতে ইচ্ছা করে না।  তা সেই একটা টার্কির জীবন শেষ হলো চোখের সামনে। সারা রাস্তা জুড়ে নীলচে কালো  পালক ছড়িয়ে। কিছু উড়ে আমার গাড়ির উপর পড়ল।  

কি আর করব , ধীরে ধীরে সব গাড়ির সাথে আমিও গিয়ে উঠলাম ফ্রিওয়ে তে।  আজকে যেন নৃশংসতার ঝাপটা আসছে। গাড়ি ছুটছে একশ কুড়ি কিলোমিটার গতিতে। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে পরে থাকা নানা ধরনের জন্তুর রিগার মর্টিস দেহ দেখতে পাচ্ছি। পেরিয়ে যাচ্ছি কিছু না ভেবে। মরা রেকুন, বিভার, ধেরে ইঁদুর, কয়টি, লাল শিয়াল দেখতে দেখতে দিনটা বিষিয়ে যেতে লাগলো।  মাঝে মাঝেই রাস্তার মাঝখানে লাল থোকা থোকা রক্ত। সকলেই অবলীলায় পিষে চলেছে দেহ গুলোকে। আমিও তাই।  মাঝে মাঝেই মসৃন রাস্তায় ঘটাং করে গাড়িটা নেচে উঠছে। বুঝতে পারছি কোনো জন্তুর হাড়ের ওপর দিয়ে চাকা টা চলে গেল।
  
হঠাত একটা ফোন এলো, সাধারণত গাড়িতে আমি ফোন ধরিনা। bluetooth টাও  ব্যাগে। আড়  চোখে দেখলাম , ম্যানেজার এর ফোন।  ছেড়ে দিতেই পারতাম কিন্তু দেখলাম সামনের অনেকটা রাস্তা ফাঁকা। সামনে কোনো গাড়ি নেই।  ফোনটা তুলে কথা বলতে লাগলাম। খুব জরুরি ফোন ছিল বুঝলাম , না ধরলে আমাকে পস্তাতে হত।  সামনে প্রায় এক মাইল রাস্তা দেখা যাচ্ছে। কোনো গাড়ি নেই।  মন সরিয়ে নিলাম রাস্তা থেকে। হঠাত কি এক অজানা আশঙ্কায় সম্বিত ফিরে পেতে দেখি দশ  সেকেন্ড দুরে একটা রেকুন রাস্তা পেরোনোর জন্য পা বাড়িয়েছে।  ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে দেখি পাসের লেন এ ঠিক আমার পাশেই একটা গাড়ি একই স্পিড এ যাচ্ছে। ফোনটা ছেড়ে স্টিয়ারিং এ হাত রাখতেই দেখি রেকুনটা ঘুরে মানুষের মত উঠে দাড়ালো আর তারপরেই সামনের বাম্পারে একটা ঘটাং করে শব্দ। বাদিকের চাকাটা একটু নড়ে উঠলো। গতি থামল না।  আমার হৃতপিন্ডের গতি বেড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে আবার সাধারণ হয়ে গেল।  

1 comment: