ভোরে উঠতে দীপনের অন্যের মত গায়ে জ্বর
আসেনা। আনন্দ আসে। প্রবল আনন্দ। রোজ সকালে খালি চোখে দেখতে পাওয়া সবথেকে শক্তিশালী জীবন্ত ক্লীবটিকে একটুর জন্য হারিয়ে দিতে তার বেশ লাগে। এখনও সে জানে না যে গোটা
পৃথিবীকে যে হির হির করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে সে কখনই হারাতে পারবেনা। কিন্তু
শিশুর ইচ্ছাশক্তির কাছে কে জিততে পারে? তারা
তো জিতবে বলেই নেমেছে। মাঠে হারলেই ‘চোট্টা’ তাই স্বয়ং সূর্যও অপেক্ষা করে দীপনের ওঠার।
দীপন সকালে উঠে মাঠে যায়। ক্ষেত নয়। শহরের
মধ্যে শেষ বেঁচে থাকা দুরমুশ করে সমান করা ঘাস ছাঁটা দুরন্ত সবুজ এক মাঠ। দীপনের
কাকা অনেক কষ্টে কোন এক বিপ্লবীর ইতিহাসের সাথে এই মাঠের নাম জুরে রাজ্য সরকারের
কাছ থেকে জোগাড় করে এনেছে এর জীবিত থাকার প্রতিশ্রুতি। নাহলে কবেই কতজনের ভিত
নরবরে করে বিশাল বিশাল ফ্লাত বারি উঠে জেত।
দীপন জানে এই কীর্তি তার কাকার। সে বোঝে
এখন কেউ চায়না বাচ্চারা খেলুক। সবাই চায় তারা যেন শুধু চুপ করে থাকে। একদম চুপ।
বাবা যতই লোকেদের সামনে বলুক না কেন স্মার্টফোন বাচ্চাদের জন্য খারাপ। কই তিনি তো
বারি এসেই নিজের স্মার্টফোন ছুরে দেন দীপনের দিকে। দীপনের মজা। লাফিয়ে পরে নিয়ে Candy Crush, Angry bird, Minecraft খেলতে শুরু করে।
সে বোঝে এই সময় তার কথা বলা বারণ। বাবা এখন ক্লান্ত। খুব ক্লান্ত। তার আবদার বায়না
শোনার তার এখন সময় নয়। তাই দীপন চুপ করে খেলে।
কাকু কিন্তু অন্য ধরনের। এক বারের জন্য
ফোন দেয়না। যখন দীপন কাছে থাকে সবসময় দীপনের সাথে কথা বলেনা বটে। তবে দীপন কিছু
প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। দীপনের প্রচুর প্রশ্ন। ওর কাছে সবকিছুই অবাক করার মত। এইত
কয়েকদিন আগে কাকু বারিতে একটা পাম্প লাগাল। ছোট্ট একটা জন্ত্র কিন্তু লাগানোর পর
থেকেই আর দীপন কে স্নান করানর তাড়া লাগায়না কেউ। সবসময় জল পরতে থাকে কল দিয়ে। কই
আগেতো হত না। খেলে যখন সে ফিরত তখন দেখত সবাই লাইন দিয়ে দারিয়ে আছে স্নান করবে
বলে। আর সবাই বলছে “জল চলে যাবে , তাড়াতাড়ি কর।” জল আবার যায় নাকি। সবসময়ই তো পাশের
পুকুরে জল থাকে। বুঝতে পারে না। কাকু কিন্তু বুঝিয়েছিল তাকে। বাবার মত বলে দেয়নি “সব জেনে কি হবে।”
বাবা সবসময় ব্যাস্ত থাকে কেন? মায়ের তো না হয় কাজ আছে। রান্না করা, ঘর পরিস্কার করা, দীপন কে স্নান করান, বাসনও মাঝে মাঝে মাজতে দেখে যখন কাজের মাসি আসে না। কিন্ত বাবা তো
অফিস থেকে ফিরে আর কিছুই করে না। শুধু সোফায় বসে বসে ল্যাপটপে গেম খেলে। সেই গেম
গুলর মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না দীপন। কোন রঙ নেই , কোন লোক নেই। এক রাশ শুধু লেখা আর লেখা। বাবা কে
একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল দীপন, “বাবা , আমি যখন গেম খেলি তখন তো খুব মজা পাই। তুমি এমন খিঁচিয়ে থাক কেন গেম খেলতে
খেলতে।” বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, “এই গেম খুব শক্ত রে দিপু , যখন আমার মত হবি তখন এর
থেকেও বেশি খিঁচিয়ে থাকবি।”
খেললাম না এমন গেম। দীপন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বাবার গেম টা পচা , কিন্তু তার গেম গুলো
বেশ মজাদার। না না , স্মার্টফোনের গুলো না। ক্রিকেট, ফুটবল, কবাডি ... এখনও যদিও কবাডি সে খেলেনা। কাকু
বলেছে এখনও ওর বয়সের ছেলেপিলে ক্লাবে আসেনি বেশি তাই কবাডি এখনও বড়দের খেলা।
কিন্তু ওর দেখতে বেশ লাগে। টিভি তে কিন্তু কখনও দেখায় না। সবসময় ক্রিকেট নয়ত
ফুটবল। মাঝে মাঝে বাবা টেনিস দেখে। বেশ লাগে দেখতে। খেলার থেকে বেশি ভাল লাগে
মাঠটা দেখতে। ওগুলো কি ঘাস? কি জানি। কাকু বলে আমাদের দেশে
ওসব বড়োলোকেদের খেলা।
দীপন কিন্তু জানে ও বড়লোক। ওদের বাড়িতে
এ সি আছে। ওর ফ্রেন্ড আর্য ওকে বলেছিল। তাও কেন ও টেনিস খেলতে
পারেনা। কাকু দীপনকে একটা র্যাকেট এনে দিয়েছিল। র্যাকেট দিয়ে ক্যাম্বিস বলটাকে
জোরে দেওয়ালে মারতে racket এর তার ফার ছিঁড়ে যা তা অবস্থা। কাকু এসে রেগে
কাই, “তোকে বলেছিলাম না কক দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে হয়। বল
দিয়ে নয়। এটা টেনিস নয়” যাহ বাবা দেখতে তো এক ধরনের। তাহলে
সমস্যা কিসের? দীপন প্রশ্ন করা থামায়নি। কাকু তখন নিয়ে
গিয়েছিল খেলার দোকানে। দীপন বুঝেছিল। শুধু বোঝেনি কেন টেনিসের racket দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা যাবে না। ওটা তো শক্ত।
বাবা মাঝে মাঝে একটা ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা
বন্ধ করে দেয়। বাড়িতে তখন কারফিউ লাগে যেন। কেউ কথা বলে না। সবাই সবার দিকে তাকিয়ে
মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলে মিটিং চলছে। মীটিং? প্রথম
বার অবাক হয়ে গেছিল। কাকুর মিটিং তো রাস্তায় হয়। কি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাকু কথা বলে।
সবাই শুনতে পায়। আর যারা আস পাস দিয়ে যায় তারা তো কই চুপ করে থাকে না। বন্ধ ঘরের
দরজায় কান পেতে শোনে দীপন। বাবাও চেঁচাচ্ছে। হয়ত এরকমই হয়। কাকু বাইরে চেঁচায় ,
বাবা ভেতরে।
বাবা বাইরেও চ্যাঁচায় , বেশির ভাগটাই মায়ের ওপর। বাবার কথা না শুনলেই
চ্যাঁচায়, মা ও চ্যাঁচায় তার ওপর। তার পরে কাঁদে। বাবা কে তো
কই কাঁদতে দেখেনা দীপন। দীপনও তো কাঁদে, মাঝে মাঝেই তার নানা
জিনিসে দুঃখ হয়। তখন কাঁদে। পা ছড়িয়ে কাঁদে। সবথেকে দুঃখ হয় কেউ তার প্রশ্নের
উত্তর না দিলে। সব প্রশ্নের না। বেশির ভাগ সময় , “কেন কিনে
দেবে না?” বাবাই তো সব কিছু কিনে দেয়। তাই বাবা নিজের জন্য
নিজেই কিনে নেয় , তাই বাবা কাঁদে না। দীপন যখন বড় হবে তখন
দীপন নিজের জন্য কিনবে। আর কাঁদবে না।
সকালে জখন মাঠে যায় দীপন তখন দেখে কাকু
দৌড়াচ্ছে। রোজ দশপাক দৌড়ায় কাকু। দীপন কে দেখতে পেলেই বলে , “দৌড়া”। কাকুর সাথে পেরে ওঠেনা দীপন। কাকু মাঝে মাঝেই ধিরে হয়ে যায়। দীপনের
সাথে তাল মেলানোর জন্য। কাকুর কত মাসল। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দারিয়ে হাতটা ভাঁজ
করে; যেমন কাকু করে। কিন্তু সেটা তো ফুলে ওঠে না কাকুর
মত। বাবার মতই থাকে। বাবার বেশ কিছুটা ভুরি আছে। ছোট হাতের ইংরাজির পি এর মতন
বাবাকে দেখতে। কাকুকে একবার লিখেছিল – প্রথমে ও তার নিচে ভি
আর তার নিচে এম। কাকুর হাসি আর ধরে না।
বাবা সকালে বেরিয়ে যায়। দীপনকে মাঠে
ছেড়ে দিয়ে। সেই রাতে ফেরে। সারা সপ্তাহ এরকম চলে। শনিবার বাবার ছুটি কিন্তু দীপনের
স্কুল। সেদিন বিকালে আবার সাঁতার শিখতে যায় দীপন। রবিবার কিন্তু সারাদিন বাবা আর
ছেলে। তখন বাবা সারাদিন ওর সাথে খেলে, কথা
বলে, সকালে বাজার করতে নিয়ে যায়। সেখানে সব জিনিসের নাম বলে
বলে দেয় দীপন কে। এঁচোর পাকলে কাঁঠাল হয় আর মোচা পাকলে কলা সে তো বাবার কাছ থেকেই
শিখেছে দীপন। বাবা খুব সহজে শেখায়। সব কিছু। যা বলে দীপন একবারেই শিখে যায়। পরের
প্রশ্ন তার মাথাতেই আসে না। কিন্তু বিকাল হতেই বাবা আবার আগের মত ল্যাপটপে গেম
খেলতে আরম্ভ করে।
কাকু কিন্তু রোজ দুপুরে বাড়ি আসে খেতে।
কাকুর কোনো ঠিক নেই। কখনও অনেক রাতে ফেরে যখন দীপন ঘুমিয়ে পরেছে। কখনও সারাদিন
বাড়ি থেকে বেরোয় না। বই হাতে , কাগজ পেন হাতে ,
বসে থাকে। বাবার মত গেম খেলেনা। পড়াশোনা করে। মা বলে কাকুর মত
পড়াশোনা করতে। কাকু যখন পরে তখন দীপন দূরে বসে পড়ে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে,
কাকুর সে এক অন্য রুপ। পাথরের মত । নরেনা পর্যন্ত। দীপন অনেক চেষ্টা
করে দেখেছে কিন্তু পারেনি। কিছুক্ষন পর পরই তার ইচ্ছা করে একটু অন্য ভাবে বসতে।
কাকু একটা বই যে কতক্ষণ ধরে পড়ে। বিরক্ত লাগেনা? কিন্তু
কাকুকে দেখতে বেশ ভাল লাগে।
দীপনের মনে তাই খুব দ্বিধা। সে বুঝতে
পারে না কার মত হবে সে? বাবার মত না কাকুর মত।
তার কাছে দুজনেই প্রিয়। খুউউব প্রিয়। সবাই ভালবাসে তার কাকুকে বাবাকে প্রায় কেউ
চেনেই না। কাকু নাকি রোজগার করে না। তাই কাকুর বিয়ে হচ্ছে না। বাবা করে। তাকে
রোজগার করতে হবে নাহলে সারাজিবন বাবার কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে আর বাবা না বলবে
দোকানে সাজানো খেলনা গুলো থেকে। কাকু রোজগার না করলেও কাকুর কাছে তো কখনও টাকার
কমতি দেখেনি দীপন। ওকে নিয়ে যখন খেলনার দোকানে যায় দীপন দেখেছে কাকুর মোটা
মানিব্যাগ থেকে করকরে টাকা বার করে দিচ্ছে। বাবার বরঞ্ছ টাকা থাকে না। একটা কার্ড
বার করে ঘশে দেয়। বাবার মানিব্যাগ পাতলা। কাকুর মোটা। সবাই ভুল বলে। দীপনের বন্ধু
সহেশও তো ভুল বলে তাই টিচার তাকে শাস্তি দেয়। এরা শাস্তি পায়না কেন?
কাকু কি সুন্দর দেখতে। ঠিক যেন
রাজপুত্তুর। দীপন বাবার মত দেখতে কিন্তু বাবা বড্ড বুড়ো হয়ে গেছে। দীপন বুড়ো হতে
চায় না। দাদুর মত খাটে শুয়ে থাকতে চায়না। সে কাকুর মত দৌড়াতে চায়। রাস্তার ওপর
দারিয়ে মাইক ধরে চেঁচিয়ে সবাইকে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চায়। মা বলে দীপনেরও
নাকি ছেলে হবে। সে তখন নাকি তার সাথে খেলবে। কিন্ত তার যখন ছেলে তার সাথে খেলবে তখন কি সে বাবার মত একা একা
ল্যাপটপে গেম খেলবে? না। দীপন সারা সপ্তাহ
রবিবারের সকালের জন্য বসে থাকে। বাবার মত হলে চলবে না। বাবা ভালো নয়। কাকু ভালো।
সবসময় ওর সাথে থাকে।
আচ্ছা বাবা কেন কাকু হয়ে জেতে পারেনা।
আর কাকু বাবা। তাহলে তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। পাশের বারির কাকু যখন পিসিকে বিয়ে করে
তখন মা বলেছিল, “এখন থেকে ও আর কাকু নয়, পিসো,”। সেও তো কাকু থেকে পিসো হল। স্কুলের স্যর যখন মাসির সাথে বিয়ে করল তখন
সেও তো মেসো হল। কাকু যদি মা কে বিয়ে করে তাহলে তো কাকুও বাবা হতে পারে। সবাই বলে
বাবার মত হতে। কিন্তু সে তো কাকুর মত হতে চায়। সে মা কে খুব ভালবাসে আর মা কত হাসে
যখন কাকু খেতে আসে দুপুরে। বাবা একা একা মিটিং করে বাড়িতে। মা কে ঢুকতে দেয়না।
কাকু আর মা তো দিব্যি মিটিং করে। সে তখন মন দিয়ে পড়ে। কাকুর মত পড়ার চেষ্টা করে।
হওয়ার চেষ্টা করে কাকুর মত।
No comments:
Post a Comment