Tuesday, May 30, 2017

সুইসাইডের ঠিক আগে




আর মাত্র কয়েক মিনিট।  তার পরেই আমি আর আমি নই।  আমার দেহ , যা আমার সবথেকে প্রিয়, সবথেকে আপন ; তার কোনো প্রয়োজন থাকবে না। আমায় যারা নার্সিসিস্ট বলে তারা হয়তো এবার থামবে। বাথরুম আটকে আজ আর আমি নিজের শরীরের দিকে তাকাবো না।  ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকবো না পৃথিবীর সবথেকে প্রিয় জিনিসটির দিকে - আমার দিকে।  আয়নার সামনে আজ আমি নিজের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবো না।  কি কঠিন ছিল প্রশ্নগুলো।  আমি যদি ওরকম না করতাম তাহলে কি হতো? আমি যদি এরকম করি তাহলে কি হবে? আমার যদি সেইরকম না হয় ভবিষ্যতে তাহলে আমার কি হবে? প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ তখনও ছিল না, আজও নেই।  তাহলে যে ঘন্টার পর ঘন্টা একা আমার এই ওয়ান রুম কিচেনের বাথরুমে বসে শাওয়ার চালিয়ে প্রশ্ন করে করে নিজের কাছে নিজেই ছোটো, বড় , মাঝারী হয়েছিলাম , সব কি জাস্ট ওয়েস্টেজ অফ টাইম ? কি বিরক্ত হতো সবাই, যখন অফিস থেকে ফিরে রোজ কারো না কারুকে ফোন করে আমার একাকীত্বের সঙ্গী বানাতাম।  আমার তো ফ্রি ফোন।  অফিস পেড।  ওদেরও তো পয়সা খরচ হতো না।  শুধু খরচ হতো সময়।  সময় কি সত্যি এতটাই দামি।  আমার জন্যে কারো কি এইটুকু সময় নেই। কোথায় কিনতে পাওয়া যায় এই সময়।  আমার কাছে প্রচুর টাকা।  টাকা দিয়ে তো সব কেনা যায়।  আমি কিনে এনে দেব তাদের জন্য।  আমি তাদের জন্যও কিনবো।  আমার জন্যেও।  তাদেরটাও খরচ করবো , আমারটাও।  তবু কেন তারা বলে ওঠে  - ব্যস্ত আছি, পরে ফোন করিস।  আমার কিন্তু ভালোই লাগতো একা থাকতে। কলেজে যখন সবাই লাফিয়ে কুপিয়ে বেড়াতো , তখন আমি সেই সর্ষে ক্ষেতে গিয়ে বসে থাকতাম।  গ্রামের কলেজ, মুড়ি আর ছোলার ছেঁচকি সঙ্গে নিয়ে যেতাম।  কি ভালো লাগতো একা থাকতে। ঘন্টার পর ঘন্টা নানা লেখকের সাথে গলায় গলা মিলিয়ে শব্দের সঙ্গে খেলা করতাম।  ডাইরির পাতা ভরে যেত।  কখনো ছন্দে , কখনো গদ্যে কখনো সনেটের অমিত্রাক্ষর ছন্দে গদ্যের বাষ্প মিশিয়ে এক বলয় তৈরী করতাম। বলে না সৃষ্টিই ব্লিস অফ সলিচিউড , একাকীত্বই সৃজনশীলতা আনে ।   তখন তো এই ট্যাব বা স্মার্টফোন ছিল না। হাতে ছিল অনেক সময়।  অনেক - অনেক সময়।  আজ প্রায় শেষ হতে চলেছে যার প্রয়োজন।  স্টপওয়াচের স্টপকক গলায় আটকে থাকতো সারাটা জীবন।  ইঁদুর দৌড়ে ইচ্ছা কখনোই ছিল না।  কিন্তু নিজের ইচ্ছায় কি আর মানুষ চলে। চলে না।  অন্য কারো ইচ্ছায় চলার ইচ্ছাই প্রেম।  সেই প্রেম তো করেছিলাম।  বন্ধু হতে , ভালোবাসতে।  প্লেটোনিকের ন্যাকামো থেকে , শেষের কবিতা সবই তো চেষ্টা করেছিলাম।  মিষ্টি মিষ্টি , ঝাঁঝালো , কড়া , তেতো বা আমলকির মতো প্রথমে কষ্টা পরে মিষ্টি।  সবই স্বাদ নিয়ে ও দিয়েছিলাম।  সারাজীবনের সঙ্গ দেব বলে চূড়ান্ত পরিশ্রমে যোগ্যতা প্রদর্শনের লড়াইয়ে জিতিনি তা তো নয়।  এই জেতা  হারার দৌড় কি তবে সেই ইঁদুর দৌড়।  কিন্ত জীবন যে হার জিৎ ছাড়া আর কিছু নয়।  শরীর সামনে এগিয়ে যায় , আর পা তাকে ব্যালান্স করতে থাকে , তাকে উলটে পড়তে দেয়না।  কখনো শরীর জেতে , কখনো পা।  এই ভাবেই তো মানুষ এগিয়ে যায়।  এই এগিয়ে যেতে যেতে আমি অনেককে পিছুতে ফেলে এসেছি।  ফিরেও তাকায়নি।  কেন তাকাবো?  তাদের কি আমি বারণ করেছিলাম আমার সাথে না দৌড়োতে।  তাদের জীবনের কাছে অনেক চাওয়া ছিল।  তাদের শান্তি লাগবে, আনন্দ লাগবে , রিলাক্সেশন লাগবে।  তারা দৌড়াতে দৌড়াতে দেখতে চায় না।  থেমে, এক জায়গায় বসে, চিবিয়ে চিবিয়ে শুধু খেতে চায় তা নয় , পরে উগলে আবার জাবরও কাটতে চায়।  আমার সবকিছুই দৌড়াতে দৌড়াতে।  আমি হাঙ্গর , থামলেই মৃত্যু।  তলিয়ে যাবো।  কিন্তু ভিড়ের থেকে একা হয়ে পড়েছি যখন বড় হয়েছি।  এটাই তো ছোটবেলা থেকে শিখেছিলাম।  যে যত বড়, সে ততো একা।  তার একাকীত্বই শান্তনা।  ঝাঁকের কৈ না হয়ে যখন অন্য স্রোতে গা ভাসিয়েছিলাম তখন সত্যি আমি ধরা পড়িনি অনেক জায়গায়।  কিন্তু একদিন বড়শির আগার  টোপ বুঝতে পারিনি।  কেউ বলে দেওয়ার ছিল না।  গিলে ফেলেছিলাম। হিড় হিড় করে টেনে তুলে আমার বড়শি বার করে ছেড়ে দিয়েছিলো জীবনের মাঝে।  ঠোঁটের ওপরটা  ছিঁড়ে গেছিলো কিন্তু বেঁচে গেছিলাম।  সেদিনের সেই একটু বাতাসের জন্য , একটু জীবনের জন্য যে খাবি খাচ্ছিলাম, আর কিছু মিনিটের মধ্যে সেই জীবন থেকে আমি বেরিয়ে যাবো।  আমি এখনো জানিনা কেন যাবো।  অনেক কারণ।  অনেক - অনেক - অনেক।  অপমান , অভিমান ,অবজ্ঞা , অনুতাপ , অসম্মান , অবহেলা  , অপপ্রচার আরো কত কি যে কারণ সে আমি আজ আর গুনতে চাইনা।  প্রতিনিয়ত তিল তিল করে বানানো এই শরীর আজ আমার কাছে এক বিরক্তিকর প্রাপ্তি।  ওই গীতাতে কি একটা যেন বলে না আমরা সবাই আত্মা।  সারাজীবন সেই আত্মার শুদ্ধি করি।  অধ্যাত্মিকতাই শেষ লক্ষ্য।  তাহলে আত্মহনের বিরুদ্ধে কেন সবাই।  তপস্যায় মৃত্যুবরণ বা মহাপরিনির্বাণ কি তাহলে নোংরামো।  আর আত্মহত্যায় ফেল করলে সেটা ক্রাইম  কেন? আমার জীবন রাখবো কি না রাখবো আমার ব্যাপার।  আমি থাকলাম কি না থাকলাম তখন তো কারো এসে যায় না । অঞ্জলির সময় তো কেউ ডাকতে আসেনি । যখন এক কড়াই গরম তেলে মাছটা ছাড়তেই অর্ধেক তেল এসে গায়ে পরে গেলো তখনও তো কেউ আসেনি ।  কি বীভৎস ফোস্কা পড়েছিল তখন।  একটু মলম গানোর জন্যেও তো কেউ আসেনি।  আজ তবে যখন আমি ব্লেড দিয়ে হাতটা কেটে ফেলবো , নিজের ইচ্ছায় , বন্ধ ঘরে , বন্ধ বাথরুমে , রাত দুটোয়, তখন কেউ কি আসবে আমায় বাঁচাতে।  আসবে না।  সকলেই চায় সমস্যাগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে ধরতে।  যেন আমি কিছুই বুঝতে পারিনা।  তারাই সব জানে।  সবাই বলে তোমার সমস্যা তুমি সমাধান করো।  আমার সমস্যা তো আমিই সমাধান করবো।  আমার সমস্যা যে কি সেটা তো আমিই ভালো জানি।  কিন্তু সবাই আগে বোঝাতে চায় যে ওদের দেখানো সমস্যাই আমার সমস্যা।  না , কখনোই নয়।  সারাদিন খেটে খুটে ঘরে ফিরে নিজের জন্যে চা বানানোটা আমার কাছে সমস্যা নয়।  আমার কাছে সমস্যা , একা এই ঘরে ঢোকার।  দুটো চড়ুই , দুটো শালিক যখন এসে ক্যা ক্যা করে ডাকতে থাকে , তখন তারাই আমার জীবনের সাথী।  তাদের কর্কশ আওয়াজ মিটিংয়ের মধ্যে মিউট বাটন প্রেস করতে বাধ্য করলেও তারা  আমার সাথে আছে।  দুটো পায়রা রোজ চেষ্টা করে ঘরে ঢুকে বাসা বাঁধবার।  ওরে , আমার বাসা যে আমি ভাঙতে  চলেছি।  দুটো ডিম পেড়ে তা দিতে জাবি যখন তখন যদি অন্য লোক এসে বাসায় লাথি মেরে ভেঙে দেয় তখন কি করবি।  তার থেকে আমি তোদের বাসাই গড়তে দেব না।  যারা আমার বাসা গড়ার জন্য হাত এগিয়ে দিয়েছিলো , তারা এখন সব হাত গুটিয়ে নিয়ে বলে দিয়েছে , - তোমার সমস্যা  তুমি সমাধান করো।  তাই করছি।  লোকে বলে আত্মহত্যা মহাপাপ , . কাপুরুষের কাজ।  কিসের পৌরুষ।  একা ঘরে কার কাছে শক্তির প্রদর্শন করবো।  পুরুষ তার বীর্য দিয়ে হয় আঘাত করে  নয় গড়ে।  এই ওয়ান রুম কিচেনে আঘাত করার মতো শুধু আছে মৃত অবলা সামগ্রী। এরা সকলেই আগেই দেহ রেখেছে , কিন্তু দিব্যি বর্তমান আছে।  আমারও দেহ থাকবে।  থাকবে কি ? শুনেছি মানুষের লাশ জলে পরিণত হতে বেশ কয়েকদিন লাগে।  ততদিনে তো কেউ এসে খোঁজ ও নেবে না।  অফিসের লোকেরা তো আমার এড্রেসও জানেনা।  তাদের সবথেকে বেশি দায়।  কত প্রেসেন্টেশন কত ডকুমেন্টেশান পেন্ডিং হয়ে থাকবে।  তারা খোঁজ নেবেই যে করে হোক।  কিন্তু ততদিনে আমি জল - আমি হাওয়া - আমি বাষ্প।  আমার সত্যি কি কোনো প্রয়োজন আছে এই পৃথিবীতে।  সবাই তো বলে নো বডি ইস  ইনডিসপেনসিবলে।  তাহলে একশো কোটির দেশে আমার দরকার কি ? আমি থাকলেও যা না থাকলেও তাই।  তাহলে ? আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজন।  ছ্যাঃ।  মা বাবা বাদ দিয়ে সব ধান্দাবাজ।  যতক্ষণ দরকার ততক্ষন আছে।  রস নিংড়ে ছিবড়ে ফেলে দেওয়া।  কারো কিছু এসে যায় না।  আমার জন্য শিয়াল কুকুরেও কাঁদবে না।  আর কাঁদলেই বা কি , আমি কি শুনতে পাবো।  না।  আমি তখন কি অবস্থায় থাকবো।  ঠিক যেমন গাঁজা খাবার মতো হয় , তেমন।  তলিয়ে যেতে থাকবো গভীরে - আরো গভীরে।  নরকে যাবো না স্বর্গে।  ননভেজ মানুষ - নরকে তো যাবোই।  বৈতরনী তো পার হতেই হবে।  ভয় কি ?যদি নরক না থাকে তবে আর কি - কেল্লা ফতেহ , জয় মার্কসের জয় বলে হ্যাপি এন্ডিং।  আর না থাকলে আরো কয়েকদিন এঁটে বসে থাকা।  টিকে থেকে ব্যাক করার রাস্তা খোঁজা।  পের্সিভেরান্স তো আছেই।  মরতে চাইছি , পারছি না বলে, তা কিন্তু নয়।  আমার আর কিছু করার নেই।  মানুষ সবথেকে কখন একা জানোতো -  যখন ভিড়ের মধ্যে সে একা।  যখন লক্ষ লক্ষ মুখ পাশ কাটিয়ে চলে যাবে কিন্তু কেউ আমার জন্য ফিরে তাকাবে না।  তখন মানুষ একা হয়ে যায়।  আজ ঘর থেকে বেরিয়ে আমি পয়সা ওড়াতে পারি , দোকানের পর দোকান পেরিয়ে যাই।  এক একটা সবজির দোকানে এক একটা বাজার কিনতে দু চারখানা কথা আদান প্রদান করতে পারি।  কিন্তু তারা সবাই অপেক্ষা করে আমার মানিব্যাগে হাত যাওয়ার।  যেই গেছে সেই চুপ।  আর তাদের দরকার নেই।  আমার দরকার তো শেষ হয়নি , তবু ...।   কিন্তু এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি শেষ মুহূর্ত গুলো একদম আলাদা।  যারা রোগশয্যায় পরে মৃত্যুযন্ত্রনা ভোগ করে, তারা হয়তো ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখে। আমার কাছে এখনো শরীরটা কি সুন্দর লাগছে।  নাকের জায়গায় নাক , কানের জায়গায় কান , ফু দিলে চুল ওড়ে , ব্রহ্মতালু এখনো সাদা হয়নি, চামড়া কুঁচকোয়নি , চোখে ছানি নেই , এমনকি চোখে চশমাও নেই, চওড়া কাঁধ , স্থুল  পেশী সব বর্তমান।  কি সুন্দর করে সাজানো আমার এক্সটেরিওর।  আর তার মধ্যে ঢাকা পরে আছে আমার একাকিত্বে গুমরে ওঠা ধ্বসে যাওয়া মনটা -  যে থাকে এই শরীরের মধ্যে।  মহাকাশে ভারশূন্য অবস্থায় যে ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধি মানুষকে বোঝায় সে মানুষ,  সেই ইন্টেলিজেন্স আজ  রক্তাক্ত।  তার কাছে বাকি সব অপ্রয়োজনীয়।  কিন্তু তাও যেন বাঁচতে ইচ্ছা করে।  নতুন কিছু দেখার , নতুন কিছু চেনার ইচ্ছা এখনও মরে যায়নি।  ঘরভর্তি বই নেই বটে , তবে আই প্যাডের মেমোরি ফুল।  রোজই নতুন কিছু ঘটছে , কত খবর , কত কিছু।  যদি জানতাম মরণের পারে কি আছে তাহলে হয়তো মৃত্যু অনেক আগেই আসতো। এই বিরক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।  ভেবোনা দোলাচালে ভুগছি।  উদ্যেশ্য স্থির।  কাল সকাল আর দেখতে চাইনা।  অন্তত এই নাম , এই শরীর নিয়ে। ব্লেড বার করে হাতে চালাতে চালাতে তবু যেন মনে হচ্ছে , কেউ আটকে নিক আমায় , কেউ একবার আটকে নিক।          












     

No comments:

Post a Comment