Thursday, January 4, 2018

২২) অতিথি পয়সা ভব


চারপাশে এখন প্রাউড প্রাউড আলোচনা।  সবাই এখন সো কল্ড ন্যাশনালিস্ট।  গেরুয়া সবুজ সাদা দেখলেই টপ টপ করে নাল ঝোল পরে যাচ্ছে।  লালাপোষ  ভিজে চুপচুপে।  কিন্তু প্রাউড কামস বিফোর ফলস।  না না আমি আজকে সেই গর্বিত ভারতীয়দের গর্ব ভাঙতে এই লেখাটা লিখছিনা।  এই লেখাটা শুধু একটা ঘটনা নিয়ে যা আমার মনে প্রশ্ন তুলেছিল যখন আমার বারো বছর বয়স।  যখন প্রথমবার তাজমহল দেখতে গেছিলাম বাবা মার সাথে।  

টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে চোখে পড়েছিল সেই বোর্ড যা দেখে ভারতীয় হবার জন্য বেশ গর্ব বোধ
করেছিলাম। সারা পৃথিবী থেকে টাজম্যাহাল দেখতে আসা লক্ষ লক্ষ বিদেশীরা আজ যে দামে টিকিট কিনবে তার ভগ্নাংশও আমাকে দিতে হবে না তাজমহল দেখতে গেলে।  আমার দেশকে এরা গরিব করেছে।  কিন্তু সেইতো আসতে হলো আমার দেশের অমূল্য প্রাচীন মনুমেন্ট দেখতে।  সকল দেশের সেরা সে দেশ আমার জন্মভূমি।  

বাবাকে বলতে বাবা তখন একটাই কথা বলেছিলো , ‘এটা গর্বের বিষয় নয়।  এটা নোংরামো।  ’ 

টিনেজে বাবা মার মতো শত্রু দুটো হয়না।  তারওপর যদি তারা বিশ্বাসে আঘাত দেয়।  সেদিন খুব রেগে গেছিলাম।  রাগ পুষে ডাইরিতে লিখেছিলাম , ‘ দেশ পরিবারের থেকেও বড়।  আর তাদের যদি কেউ দেশের সম্বন্ধে বিরূপ আচরণ করে তাহলে হয় শাস্তি দাও তাকে নয় ব্যাড দিয়ে দাও জীবন থেকে।’ 

সেই বাদ দিতে দিতে একদিন বিদেশে পারি দিলাম।  বিলাত নয় , আমেরিকা।  শুরু হলো একের পর এক মুনষ্য সৃষ্টি অবাক করা সৌন্দর্য দেখা।  লস এঞ্জেলস , নিউ ইয়র্ক , শিকাগো , ডেট্রয়েট , বোস্টন সব জায়গা একের পর এক ঘুরতে লাগলাম আর দেখতে লাগলাম একের পর এক পৃথিবীবিখ্যাত জিনিস।  কিন্ত কোথাও নন আমেরিকানের জন্য টিকিট তো আলাদা দেখলাম না।  দেখলামনা ফরেনার শব্দটাও।  কেউ বললোও না ফরেনার।  একটাই লাইন আর টিকিটের দাম একটাই।  

খচখচ করতে লাগলো।  কিন্তু বার বার মনকে বোঝাতে লাগলাম , এটা ইম্মিগ্রেন্ট এর দেশ।  সবাই এখানে বাইরে থেকে এসেছে।  এখানকার লোকেদের খুন করে এদেশে নিজেদের জায়গা বানিয়েছে।  তাই ফরেনার বলে কোনো কথা নেই। এদেশে শুধু কালো সাদার নোংরামো। যাদের জাতীয়তাবোধ বেশি তারা বিদেশিদের শুধুই পর্যটক মনে করে।  আর পর্যটনে অর্থসংগ্রহই প্রাধান্য।  

বয়স বাড়ার সাথে সাথে বন্ধুরা ধীরে ধীরে গ্লোবাল হতে লাগলো।  সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল আমার কানেকশান।  স্কুলের বন্ধু , কলেজের বন্ধু , অফিসের কলিগরা নানা দেশে গিয়ে ডেরা বাঁধলো।  অনেকে নেহাত দেশে থেকে বিদেশে হানিমুন , বা ভ্যাকেশন ট্রিপ করতে লাগলো।  অরকুট শেষ হয়ে এসে গেলো ফেসবুকের জমানা।  ইন্টারনেট হয়ে উঠলো শক্তিশালী।  নানা দেশের আঁখো দেখা হাল চোখের সামনে আসতে লাগলো ফেসবুক পোস্ট বা ফেসবুক লাইভের মধ্যে দিয়ে।  বন্ধুরা কখনো গিজার পিরামিড ,  কখনো আইফেল টাওয়ার , কখনো বাকিংহাম প্যালেস থেকে লাইভ হতে আরম্ভ করলো।  সকলের কাছেই আমার প্রশ্ন থাকতো ‘হ্যারে , আমাদের জন্য কি আলাদা টিকিট?’ সব জায়গায় উত্তর না বাচক।  

ইতিমধ্যে একাধিক সাদা/কালো ক্লায়েন্ট ঘুরে এলো আমার জন্মভূমি।  সকলেই বিশদ বিবরণ দিলো দেশের।  ট্যাজমাহাল ছাড়াও কুটুব মিনার , রেড ফোর্ট , বাহাই টেম্পল , কান্যাকুম্যারি , মাইসোর প্যালেস , ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সবার খবর একে একে পেতে থাকলাম।  দেশের ভিড় , হন্কিং , ট্রাফিক সবকিছুর পর আমি অপেক্ষা করতাম সেই প্রশ্নের।  কিন্তু কেউ বলতো না।  একদিন নিজেই খুঁচিয়ে প্রশ্ন করলাম , ‘ডিড ইউ সি দা ডিফারেন্স অফ এন্ট্রি ফী ফর ফরেনার এন্ড ইন্ডিয়ান্স .’ সকলেই নোটিস করেছে।  কিন্তু সবাই প্রায় একই কথাই বললো , ‘আই ডোন্ট মাইন্ড দা প্রাইস. এস আই স দা পভার্টি দেয়ার . এন্ড হোয়াট আই স ইস প্রাইসলেস।’  

খুব নিচু মনে হলো নিজেকে।  এখন এখানে দেশি পর্যটকের অভাব নেই।  তারা কি এখানের প্রাইসলেস জিনিস দেখতে আসে না? তাজমহল যেমন মনুষ্যসৃষ্টি আশ্চর্য এই দেশের আকাশচুম্বী বিল্ডিং এর সারি কি আমাদের আশ্চর্য্য করে না।  সেগুলো কি প্রাইসলেস নয়।  কিন্তু আমাদের এই ভিখিরিগিরি করা রক্তে বসে গেছে।  যে দেশ পৃথিবীর দশটা বড় দেশের মধ্যে পরে, তাদের কি এরকম করা শোভা পায়।  সবার কাছে এখনো ইন্ডিয়া পুওর।  মানছি আমরা এখনো গরিব।  এখনও আমাদের দেশের এক বিশাল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে।  কিন্তু ওই মনুমেন্টগুলোর এন্ট্রি ফি কি কোনো ভাবেও সেই দরিদ্র লোকেদের পেট ভরছে ? ভরছে না।  সেগুলো মনুমেন্ট সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করার কথা কিন্তু সেটাও হচ্ছে না।  তাজমহল কালো হয়ে যাচ্ছে , রেড ফোর্ট নোংরা, মুঘল গার্ডেন এ ফুল ফোটে না।  আর নেতাদের পকেট যায় উপচে।  

বড় হতে হলে , অন্ধ ভাবে গর্বিত হলে চলে না।  নিজের পেছনের গু আগে ধুতে হবে।  কোহিনুর নিয়ে আসতে  হবে বলে চ্যাঁচালে চলবে না , যা আছে আমাদের তা আগে সংরক্ষণ প্রয়োজন।  আগে আমাদের নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আর পরিবর্তন না করলে চেঁচিয়ে লাভ নেই যখন সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এসে বলবে - “পুওর ইন্ডিয়ান , ডার্টি ইন্ডিয়ান .”   



প্রবন্ধ

No comments:

Post a Comment