Tuesday, May 1, 2018

৪৬) আধ্যানের ডায়েরী - দেশে বিদেশে ( সকল পর্ব একত্রে )


“কে বলেছে ও আমেরিকান।  ও হলো আমেরিকান পাসপোর্ট হোল্ডার  ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া।” বাবা অন্তত চল্লিশবার ফোনে এই কথা বলেছে সবাইকে।  দোষটা বাবার নয়। সবাই মিলে একবার তুলছে, একবার ফেলছে।  একবার বলছে আমেরিকান বয় আসছে।  একবার বলছে দেশি ছানা আসছে। কি কনফিউশান।  বাবা ই বা কোথায় যায়।  এই জন্যেই বোধহয় বাবা বার বার বলে, ছেলে হবে আমেরিকান বর্ন কনফিউসড দেশি মানে এ বি সি ডি ।  

যাকগে বাবা।  ওসব বাবা মায়ের ঝামেলা।  আমি বরঞ্চ শুরু করি আমার বাবার দেশে ঘোরার গল্প।  হ্যাঁ হ্যাঁ , দেশটা আমারও, কিন্তু বাবার আপাতত আমার থেকে বেশি।  বাবা ওখানে ছাব্বিশ বছর কাটিয়েছে আর আমি বাইশ মাস বয়সে গিয়ে হাজির হলাম।  বাবার আলাদাই এক্সাইটমেন্ট ছিল ছেলেকে দেশে নিয়ে যাওয়ার।  কিন্তু যেহেতু কাপড়ে হাগা লোক , তাই সেই এক্সাইটমেন্ট ছাপিয়ে গেছিলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার ভয়।  কিন্তু আমি কনফিডেন্ট ছিলাম। ট্রপিক্যাল কান্ট্রি , ডিফারেন্ট সেটআপ , নতুন নতুন রোগ , অনেক ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল , কিন্তু মি মাইসেলফ এন্ড আই ছিলাম সুপার কনফিডেন্ট - আই উইল গিভ দা বেস্ট। 

কনফিডেন্সটা চুপসে গেলো যখন ঘন্টা তিনেক ড্রাইভ করে আমাকে নিয়ে গিয়ে হাজির করা হলো একটা বিশাল জায়গায়।  এদিকে মা আমাকে ঝুলিয়ে নিয়েছে গায়ের সাথে।  ঘেমে যাচ্ছি , এদিকে দুধলিনের খিদে পাচ্ছে অথচ লাইন আর এগোচ্ছে না।  সেখানে যখন অনেক্ষন দাঁড়ানোর পর আমরা ভেতরে ঢুকলাম ,তখন দেখি আরো বড়ো জায়গা।  অনেক লোক , আর অনেক খেলার জায়গা।  তখন আমায় পায় কে।  আমরাই প্রথম প্লেনে উঠলাম।  সবাই অনেক কিছু ভয় দেখিয়েছিলো।  প্লেনে নাকি অনেক প্রব্লেম হবে।  আমি নাকি সিট্ পাবোনা।  বাবা নাকি কিপ্টেমো করে আমার সিট্ কেনেনি।  এবার নাকি আমাকে কোলে করে যেতে হবে।  আমার কোলে থাকতে বিশেষ ভালো লাগে না।  আর জার্নি নাকি অনেক্ষনের।  তাই একটু ঘাবড়ে গেছিলাম বটে।  কিন্তু শেষমেশ দেখলাম আমাকে একটা ফ্রি তে সিট্ দিয়েছে।  দেবে না কেন।  আমি তো আমিই।  

বাবা খুঁচিয়ে আমাকে জানলার ধরে বসিয়ে দিলো বটে, কিন্তু তখনা তো রাত, জানলাটাই বুঝতে পারলাম না।  এই প্লেন যে কি জিনিস সে না চড়লে বোঝা যাবেনা।  আমি যদিও চড়েও বুঝিনি।  শুধু যখন প্লেনটা ছেড়ে দিলো, বাবা তখন মা কে খোঁচাতে লাগলো, “ওকে দুধ দাও দাও, এখুনি কান বন্ধ হয়ে যাবে“ বলে ।  তখন বুঝতে পারলাম যে বাবার আওয়াজ আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।  যেই না এক ঢোক গিলেছি সেই দেখি বাবার কথা পরিষ্কার।  আবার কিছুক্ষণের মধ্যে সেই এক কেস।  হেব্বি মজা লাগছিলো।  আমি একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছিলাম।  

প্রথমে তো আমি কোলেই বসেছিলাম।  তারপর যখন কান বন্ধ হওয়া বন্ধ হলো তখন আমাকে নামিয়ে দিয়ে পাশে বসিয়ে দিলো।  তখন দেখি আমার সামনে টিভি।  আর এই প্রথম বার বাবা আর মা আমাকে টিভি দেখার জন্য উৎসাহিত করছে।  কি মজা।  কিন্ত হা ভগবান আমার ফেভারিট চুচু টিভি কই।  নানা কিছু টিপে টাপে আমি থেমে গেলাম।  কিন্তু করার মতো তো কিছু থাকতে হবে।  হঠাৎ দেখি মা ব্যাগ থেকে খিচুড়ি বার করছে।  এই রে।  এখানেও খিচুরী।  আমি কোথায় ভাবলাম ঘুরতে গিয়ে ভালো মন্দ খাবো। তা নয় সেই পুরানো ঘ্যাঁট।  বাবা আমার পক্ষে ছিল সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো কিন্তু বেচারা অসহায়।  মা যুদ্ধ শুরু করার আগে নিজের ফোনে চু চু টিভি লাগিয়ে দিলো , ব্যাস আমিও ন্যাতা।  কিছুক্ষনের মধ্যে যদিও বোর হয়ে চিৎকার করে খিচুড়ির বাটি উল্টে ফোনে চুমু খেয়ে যা তা কান্ড করে ফেললাম।  কিন্তু পেটটা ভরে গেলো।  এবার আরাম করে হালকা মুতে ডায়পার চেঞ্জ করে শুয়ে পড়বো।  পাবলিক প্লেস, তাই বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করতে হবে।  সেটার অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ দেখি মা আমার প্যান্ট ধরে টানছে।  ও মা, এখানে ওপেনলি চেঞ্জ করবে নাকি, আমার কি প্রেস্টিজ নেই নাকি।  দেখি বাবা দাঁড়িয়ে পরলো আর বলতে লাগলো, “এখানেই করে দাও।  কেউ কিছু বললে আমি দেখবো।”  যেহেতু হাগু হয়নি তাই গন্ধ ছড়ানোর ব্যাপার নেই।  দিব্যি আমার ডাইপার টপটপ চেঞ্জ হয়ে গেলো।  আর কিছুক্ষনের মধ্যে সবাই মিলে দে ঘুম।   

মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভাঙছিল , কখনো উঠে দেখি বাবা জেগে , কখনো মা।  বেশির ভাগ সময় দেখি বাবা মায়ের কাছে কোনো রকমে একটা ঝুলে থেকে শুয়ে আছে।  ইস বাবাদের কি কষ্ট। হয়তো আমার বাবারই বেশি কষ্ট , আমি কখনো বাবার মতো বাবা হবো না।  

বেশ কিছুক্ষন ঘুমিয়ে টুমিয়ে যখন উঠলাম তখন দেখি সামনে কত খাবার , কিন্তু সব অখাদ্য . আমার পছন্দ ওই স্পুনগুলো।  আমি যত নিতে  চাইছি , মা ততো কেড়ে নিচ্ছে শেষে ওই খাবার দেওয়া আন্টিটা আমায় একটা খেলনা দিয়ে গেলো।  বাজে খেলনা,  আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঢুকে গেলাম সামনের সিটের তলায়।  শেষমেশ বাবা বুঝতে পারলো এই ভাবে আমার মতো জিনিসকে আটকানো যাবে না।  ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিতে আমি প্লেনটা এক চক্কর মেরে এলাম। 

অনেক বড় জায়গা।  হাঁটছি তো হাঁটছি , মাঝে মাঝে পিছু ফিরে দেখে নিচ্ছি বাবা আমায় ফলো করছে কিনা।   এতো লোক, কিন্তু সবাই বসে আছে কেন? কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়েও দেখলাম, কেউ নড়বে  না , ঠিক যেমন বাবা সন্ধ্যেবেলা নড়ে না,  এরাও নড়ছে না।  আমার বয়সী একজন ছিল , দিলাম ধাক্কা , কিন্তু ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতে দেখি বাবা পেছন থেকে সরি বলতে বলতে দৌড়ে আসছে।  আমিও দিলাম ছুট সামনের দিকে, এক পাক ঘুরে দেখি বাবা আর আমার মাঝে চারটে চেয়ার।  কিন্তু এ কি রে বাবা, এক মহিলা খপাৎ করে আমায় ধরে নিলো।  দ্যাটস হাইলি ডিসগাস্টিং , কিন্তু মায়ের মতোই গায়ের শক্তি তাই বিশেষ কিছু করতে পারলাম না।  পেছন থেকে দেখি বাবা এসে কোলে তুলে নিয়ে আবার সেই সিটে নিয়ে গেলো।  

এই খেলা বার বার চলতে চলতে একসময় আবার ঘুম পেয়ে গেলো।  ঘুম ভাঙতে দেখি আবার সেই দুধ
খাওয়া আর বাবা মায়ের আওয়াজ কমে যাওয়া খেলা শুরু. কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা প্লেন থেকে বেরিয়ে গেলাম।  মায়ের দেখি মুখ কাঁচুমাঁচু , আমরা নাকি দেরিতে বেড়িয়েছি বলে এয়ারপোর্ট এর স্ট্রলার নাকি সবাই নিয়ে নিয়েছে।  মা টা না হেব্বি বুদ্ধু , সবার কি স্ট্রলার আছে নাকি।  আর নাই বা থাকুক স্ট্রলার আমার তো বাবা আছে। ফাঁকা এয়ারপোর্টে দৌড়াতে শুরু করতেই বাবা সোজা কাঁধে তুলে নিলো।  কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই যদিও লাল টুকটুকে একটা স্ট্রলারে আমায় বসিয়ে দিলো , তারপর শুধু চলা আর চলা।  

একজায়গায় একটা দরজা ছিল।  আমি ওর মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে দেখি হুমদো মতো একটা লোক এসে সামনে দাঁড়িয়ে একটা খেলনা দিয়ে আমার সারা গায়ে বুলিয়ে দিলো।  মা খুব হাসছিল , আমার নাকি চেকিং হচ্ছে।  চেকিং আবার কি? সে থাকগে , সেখান থেকে বেরিয়ে সে এক প্রকান্ড বাজারে ঢুকলাম।  কতো দোকান, কত মানুষ , কত আলো।  সবাই কত কি কিনছে।  আমার ঘুরতেই থাকলাম দোকান থেকে দোকানে , কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মা কিচ্ছু কিনল না।  কতক্ষন ঘুরেছি জানিনা , মাঝে স্ট্রলারে বসে বসেই এক চোট ঘুমিয়ে নিয়ে চোখ খুলতে দেখি আবার একটা প্লেনে গিয়ে ঢুকেছি।  এ কি রে বাবা।  তার ওপর এটা কি ছোটো প্লেন।  সবাই সবাইকে ধাক্কা দিচ্ছে।  তবে মজার ব্যাপার হলো বাবা মা যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাতেই সবাই কথা বলছে।  

এই প্লেনে আমাকে সত্যি সত্যি সিট দেয়নি।  আমরা প্লেনে ঢুকেই প্রথম সিটে গিয়ে বসেছিলাম। তারপর লোক উঠেই যাচ্ছে , উঠেই যাচ্ছে।  এদিকে মা আমাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে।  শেষে বাবা নিজে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় নিজের সিটের সাথে সেই বেল্ট দিয়ে বেঁধে দিলো।  খুব গরম লাগছিল , বার বার  জুতো খোলা চেষ্টা ককরছিলাম কিন্তু বাবা এমন ভাবে আটকে রেখেছিল যে কিছুতেই সামনে ঝুঁকতে পারছিলাম না।  অনেকবার আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেও যখন বাবা মা বুঝল না , তখন বুঝলাম যে নিজের লোকেরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে পর হয়ে যায়।  পাশ দিয়ে যে লোকগুলো যাচ্ছিল তাদেরই ধরলাম , একজন ঠিক বুঝলো।  আমার জুতো খুলে দিয়ে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো।  আমিও মায়ের দিকে একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে নিজের সেলফ সাফিসিয়েন্ট হওয়ার একটা ভাব দেখলাম।  

এই প্লেনে খুব দম বন্ধ হয়ে আসছিল।  দৌড়ানোর জায়গাও খুব কম।  কিছুক্ষন ঘুরে টুরে এসে আমিও বিরক্ত হয়ে গেলাম।  এ কি রে বাবা , সবাই গাল টাল টিপে দিচ্ছে।  আমি কি পুতুল নাকি।  সবাই হাত লাগাবে।  বাবার পাশে দুজন বসে ছিল।  তারা ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত শুধু সাদা পড়েছিল।  কি বোরিং রে বাবা।  আমার কি সুন্দর নানা ছবি আঁকা ড্রেস।  ওদের মধ্যে যে মায়ের মতন , সে আবার  আমাকে বার বার কোলে নিতে চায়।  কেন বাপু , চিনিনা জানিনা কোলে কেন যাবো? তবে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম দ্যাট ইস দা ট্রিক। এই লোকগুলো আলাদা।  এদের কোলে গেলে তবেই বাবা মা খুশি।  

দ্যাটস ফাইন, কিন্তু যতক্ষণে আমরা নামলাম ততক্ষনে বেশ ইরিটেট হয়ে গেছি , বুঝলাম জার্নিটা অনেকটা।  এই এয়ারপোর্টটাও বেশ বড় , তবে সবথেকে বিরক্তিকর হলো ব্যাগ নেওয়া।  ওই গোল জায়গাটায়, যেখানে একের পর এক ব্যাগ আসছিলো , আমার কি ইচ্ছা করছিলো উঠে যেতে, কিন্তু বাবা কিছুতেই উঠতে দিচ্ছিল না।  শেষে মাও চলে গেলো বাথরুমে। ব্যাস , আর কি চাই , বাবাকে ট্যাঁকে গোজা কোনো প্রব্লেম নেই।  বাবা ইসি , বাবা চায় আমাকে ফ্রিডম দিতে।  আমি দৌড়াব আর বাবা আমার পেছন পেছন দৌড়াবে।  এতেই বাবা খুশি।  আমি দৌড়ে গেলাম , আর বাবাও দৌড়াতে লাগলো আমার পেছন পেছন।  কিন্তু মাঝে মধ্যেই কেউ না কেউ আমাকে ধরতে লাগলো।  এ কি রে বাবা।  আমি তাদের কি করেছি? আমার দেশে তো এরকম হয় না।  বার পাঁচেক বাবা আমাকে অন্য লোকেদের কাছ থেকে উদ্ধার করার পর যখন দেখলাম মা ফিরে এসেছে , তখন আমরা বেরোনোর জন্য রেডি হয়ে গেলাম।  

এবার আমি কিছুতেই মায়ের গা থেকে ঝুলবো না।  বাবা দেখলাম আমাকে সুটকেসের বোঝার ওপরেই তুলে দিলো।  আর ঠেলতে লাগলো কার্ট টাকে।  একটা দরজা দিয়ে বেরোতে দমকা একটা গরম এসে গায়ে লাগলো। আর সামনে কত লোক দাঁড়িয়ে।  সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন ছুটে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো।  আমার ঠাম্মা।  কি মিষ্টি।  হেঁসে কেঁদে নেচে কুঁদে আমায় কোলে করে আদর করেই গেলো করেই গেলো।  বাবা পেছন থেকে অনেক কিছু বলার বা করার চেষ্টা করেও বিশেষ কিছু করতে পারলো না।  শুধু আমি কোলে উঠেছি সেই খুশিতেই পাগল হয়ে গেছে।  আমি বুঝলাম দিস ইসি ট্রিক ওয়ার্কস।  দাদুও ছিল।  ইতস্তত করতে করতে যখন হাত বাড়ালো তখন আমি সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।  দেখলাম আই ওয়াস রাইট।  দাদুও সেম আক্শান।  আদর করেই গেলো করেই গেলো।  

গরমটা সয়ে গেছিলো।  আমরা একটা বিশাল গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু এ কি ? আমার কার সিট্ কৈ ? সে তো ছাড়ো , আমার সিট কই ? অপেক্ষা করতে লাগলাম।  এক সময় দেখি গাড়ি ছেড়েও দিলো।  আমি তখন ঠাম্মার কোলে। কার সিট নেই, সিট বেল্ট নেই , আর শক্ত সিটের থেকে ঠাম্মার কোল সব সময় ভালো।  বাবা সামনের সিটে বসে আছে।  বাবা ড্রাইভ করছে না।  অন্য একটা লোক করছে।  বাবা বার বার পিছনে ঘুরে ঘুরে আমায় দেখতে লাগলো।  আমি লক্ষ করছিলাম বটে , কিন্তু এখন আমার দেখার জন্য অনেক বেশি কিছু আছে।  এখানে জানলা দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়।  কত গাড়ি।  একদম পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।  কত লোক।  একদম গাড়ির সামনে দিয়ে কত লোক হাঁটছে।  শুধু খুব আওয়াজ।  সবাই হংক করছে।  আমার দেশে একটা হংক  শুনলেই বাবা - মা দুজনেই প্রচন্ড উত্তে
জিত হয়ে পরে।  সবসময় মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে থাকে।  কিন্তু এখানে সেরকম ভাবে দেখতে গেলে তো মাথা সোজা রাখাই যাবে না।  আর আমাদের যে গাড়ি চালাচ্ছে সে তো বার বার হংক করছে।  এতো বার তো বাবা বা মা করে না।  কিন্তু আমার বেশ মজা লাগছে।  আওয়াজ হলে ভালোই লাগে বেশ।  বেশ মনে হচ্ছে ড্রাইভার অন দা বাস গোস পি-পি-পি - পি-পি-পি অল থ্রূ দা টাউন।  

আগে পিছে এতো গাড়ি আছে বলে গাড়ি খুব আস্তে চলছিল।  খুব খু-ও-ও-ব আস্তে।  তাতে যদিও আমার সুবিধা হচ্ছিলো , কারণ আমি সব কিছু দেখতে দেখতে যেতে পারছিলাম।  এখানে তো আর সেই একঘেঁয়ে একই গাছগাছালি দেখতে হয় না।  নানা ধরণের বাড়ি , নানা ধরণের হোর্ডিং , নানা ধরণের গাড়ি।  ও হ্যাঁ , আমি তো থ।  কত ধরণের গাড়ি এখানে।  পুরো ট্রিপ যখন শেষ করলাম তখন অনেক অনেক গাড়ি দেখে ফেলেছি।  সেই গল্প আসতে আসতে বলবো।  

হঠাৎ করে কি যেন হলো সব কিছু ধুলোয় ঢেকে গেলো।  ঠাম্মা আমার মুখ ঢাকা দিতে গিয়ে চোখের ওপর হাত রেখে দিলো।  মা কাশতে আরম্ভ করে দিলো।  বাবা কিন্তু এস ইট ইস।  মুখ পিছনে ঘুরিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলো মায়ের ওপর , আর বলতে লাগলো , ‘ শুরু হয়ে গেলো তো এন আর আই ন্যাকামো’।  এন আর আই  যে কি জিনিস জানিনা।  তবে আমার সারা মুখ কচকচ করতে লাগলো বালিতে।  গাড়ির কাঁচ গুলো বন্ধ করে দিতে গিয়ে হলো উল্টো বিপত্তি।  ঘেমে নিয়ে স্নান করে গেলাম আমরা।  তার থেকে ধুলোই ভালো।  আমার বিশেষ কষ্ট হচ্ছিলো না , আই মিন আমি বিশেষ পাত্তা দিচ্ছিলাম না।  তখন আমার মন গাড়ির চারপাশে দৌড়াতে থাকা নানা জিনিসে।  

আমরা যতক্ষণে বাড়ি পৌছালাম ততক্ষনে একদম ঝুলে গেছি।  বার বার ধুলো খেতে খেতে ব্যাপারটা প্রথমে কিছু মনে না হলেও পরে কেসটা ঠিক জমে নি।  ঘরে ঢোকার আগে আরো কয়েকজন আমাকে চটকে নিলো।  আমিও চলে গেলাম সবার কোলে কোলে।  সবাই খুশি।  কিন্ত আমি তখন আমার প্লে গ্রাউন্ড খুঁজে বেড়াচ্ছি। ঘরে ঢুকেই খাটে উঠে পড়লাম।  খাটের গায়ে আবার ছোট একটা ব্যালকনি।  জানলা দিয়ে ঢুকতে হয়।  আমাদের জানলা দিয়ে ঢোকা যায় না।  কিন্তু এখানে দিব্যি।  বেশ মজাদার সেই জানলাটা।  ঠিক যেন আমার জন্য বানানো।  আমি উঠে গিয়ে চিৎকার করে ওয়ান তু থি বলে দিলাম সবাই কে।  ঠাম্মা দাদু আমার পেছনে দৌড়ে গেলো।  হেব্বি খেলা , শুধু খেলা , কিছুক্ষন পরে খাবার দাবার শেষ হয়ে যেতে একদম ঢুলে পড়লাম।  বাবা এসে সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো।  আমাকে ঝাঁকিয়ে টাকিয়ে অনেক করে  জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করলো।  আর বলতে লাগল , ‘ জেগে থাক , নাহলে জেট ল্যাগ হবে। ‘ 

জেট ল্যাগ যে কি জিনিস সে তো আর সেদিন বুঝিনি।  শুরু হলো সেদিন রাত থেকে পাগলামো।  রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না।  তার ওপরে এখানে আবার টিভি তো অনেক ওপরে।  দেয়াল থেকে ঝুলছে। আমি না পারছি ডেভ আর এভা কে ধরতে।  না পারছি মাংকি গুলোকে চুমু খেতে।  কিন্তু যেটা পেয়েছি সেটা হলো ক্রেয়ন।  নামটা খটোমটো হলেও কি দারুন লাগে ওগুলো দিয়ে লিখতে।  দাদু এসে ধরিয়ে দিতেই আমি দেয়াল দিলাম ভরিয়ে।  ঠাম্মা আবার অনেক বই এনে রেখেছিলো আমার জন্য।  নতুন বই পড়তে কার না ভালো লাগে। কিন্তু রাতের ঘুম নিয়ে চিন্তায় পড়লো সবাই।  শেষমেশ বাবা বললো আমি দাদু ঠাম্মার কাছে শোবো।  

ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগলো না আমার।  মানছি দাদু ঠাম্মা আমার নিজের,  কিন্ত  যতই হোক , আমার রাতে মা কে লাগে।  কিন্তু আমি প্রোটেস্ট করিনি।  দাদু ঠাম্মার কাছেও শুয়ে দেখে নি। ক্যারোল বলেছিলো ইটস দা সুইটেস্ট টাইম।  কিন্তু সবথেকে মজাদার ব্যাপার হলো, খাটের  মধ্যে কি যেন একটা দিয়ে আর একটা রুম বানিয়ে দিলো।  ভেতরে ঢুকতে পারবে , কিন্ত বেরোতে পারবে না।  ভেতর থেকে দেখলাম মা অনেক বার কাঁচু মাচু মুখ করে চলে গেলো।  কিন্তু আমার তখন সেসব দেখার সময় নেই।  আমি তখন ঘরের মধ্যে ঘর নিয়ে মশগুল।  আর দাদু ঠাম্মা নিয়ে।  সত্যি ক্যারোল ঠিক বলেছিলো।  ইটস দা সুইটেস্ট টাইম।  

একটু চোখ লেগে গেছিলো কিন্তু তারপরেই উঠে অন্ধকার ঘরেই আমি চালু করেদিলাম টু থি ফোর।  রোজ রাতে বাবা মা কে জ্বালাই।  আজ না হয় অন্যদের।  বাবা মা বিরক্ত হয়ে যায় , কিন্তু ঠাম্মা দাদু তো বিরক্ত হয়নি।  সারাক্ষন লাফালাফি করে দেখি সকাল হয়ে গেছে।  বাবা এসে আবার নিয়ে গেলো মায়ের কাছে।  মা তখন জড়িয়ে সরিয়ে আবার শুয়ে পড়লো।  আমারও চোখ জুড়িয়ে এলো।  

পরের দিন কত কত লোক এলো আমাকে দেখতে।  আমি সবার কোলে গেলাম।  সবার সাথে খেলা করলাম আর করলাম খাওয়া নিয়ে যুদ্ধ।  এখানেও খিচুড়ি।  ধুর আর ভালো লাগে না।  বুঝতে পারছিলাম একটা চাপা টেনশন চলছে আমার খাওয়া নিয়ে।  কিন্তু আমার কিছু করার নেই।  আমার মোটেও ভালো লাগছিলো না।  শরীরটা ক্যামন যেন একটা করছিল।  তার ওপর সেই একই ওট আর দই, আর না হলে খিচুড়ি।  সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখে নিলো আমাকে খাওয়ানো যায় কিনা।  কিন্তু আমি কাউকে এলাও করলাম না।  শেষে সেই মোষের মতো বাবা ঘাড় ধরে খাইয়ে দিলো।  

পরের দিন সকাল থেকে মা বেশ খুশি খুশি ।  আজ নাকি আমরা যাবো মামার বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে মামার বাড়ি।  সেখানে নাকি গিয়ে আমি যা খুশি তাই করতে পারি।  সকাল থেকেই বাড়িতে সাজ সাজ রব। একটা লাল টুকটুকে গাড়ি করে আমরা যখন মামার বাড়ি রওনা হলাম তখনও সেই এক কেস, আমি মায়ের কোলে। আমার কোনো সিট্ নেই।  এ কি রে বাবা।  কিন্তু যখন গিয়ে পৌছালাম তখন দেখি সেই আমার দাদু দিদা  , যারা আমার ওখানে অনেক দিন ছিল তারা এসে হাজির।  সাথে এক নতুন লোক, যে এতদিন ফোনে থাকতো - মাসি।   

তাহলে এটা মাসির বাড়ি , মামার বাড়ি নয়।  মামা নেই।  আছে দাদু দিদা আর মাসি।  আর আছে আমার জন্যে আগে থেকে কিনে রাখা তিনটে গাড়ি।  কি সুন্দর গাড়ি গুলো।  লাল হলুদ আর সাদা।  লালটা ধরে ছুঁড়ে দিলাম প্রথমে।  দেখলাম নাহ , বেশ টেকসই।  আর এখানে খাটটা বেশ উঁচু , তাই আমি একটার পর একটা গাড়ি খাটে তুলতে লাগলাম আর কাউন্ট করতে লাগলাম।  বেশ মজা।  মাসি আবার হাতে কিছু একটা নিয়ে দূর থেকে লাল গাড়িটাকে সরিয়ে দিচ্ছিলো।  আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না হাতের ঐটা কি।  যখন বেশি ঝামেলা করলো দিলাম গাড়িটাকে ভেঙে। আমাকে নিয়ে চ্যাংড়ামো আমি বিশেষ বরদাস্ত করতে পারিনা। মাসির সাথেই আমার বেশি খেলা ছিল।  দিদা দাদু তো নড়তেই পারে না। কিন্ত মাসির সব কিছু ভালো শুধু আমার একটা বিচ্ছিরি নাম দিয়েছে - নানটু।  ছি এটা আবার একটা নাম হলো।  কিন্তু আমার বিরক্তির কথা এখন তো আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনা , তাই মেনেই নিলাম।    

বেশ কয়েকদিন ওখানেই কাটালাম।  অনেক কিছু দেখলাম , অনেক কিছু নতুন লাগলো।  কিন্তু সবথেকে মজা লাগলো ছাদে গিয়ে।  ছাদে অনেক পাখি থাকে।  আমার দেশে আমি তো কখনো ছাদে উঠিনি।  তাই পাখিও দেখিনি।  ইন ফ্যাক্ট দেখেছি, কিন্তু এতো কাছ থেকে দেখিনি।  পাখি গুলো আবার বক বক বকম করে আওয়াজ করে।  মাসি ওদের খেতে দেয় আর ওরা এসে লটপট করে পায়ের কাছে।  আমি যেই না ধরতে যাই সেই উড়ে চলে যায়।  কি ভালো লাগে , ওদের ওড়া দেখতে। আমি কেন উড়তে পারিনা।  জানিনা বাপু।  একটু চেষ্টা করেছিলাম , থপ করে পরে গেলাম।  

মাসি সবাইকে খেতে দেয়।  এখানে রাস্তায় কত কত বিংগো আছে।  বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালেই অনেক অনেক বিংগো দেখতে পাই।  সবাই খেলা করে।  আর মাসি ওদের খেতে দেয়।  আমার কি যে ইচ্ছা করে যে একবার গিয়ে ওদের ধরে চটকে দিই।  একবার বাবার পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে হাত ছেড়ে চোঁ চা দৌড় লাগিয়েছিলাম একটা বিংগোর পেছনে।  কিছুটা যাওয়ার পর দেখি বিংগো টা ঘুরে দাড়িয়েছে।  বাবা পিছন থেকে দৌড়ে আসছে আর মাসি চিৎকার করছে , ‘ওটা কামরায় - ওটা কামড়ায় ’ । কামড়ায় ! তাতে আবার কি।  আমিও তো কামড়াই , আমার মাঝে মাঝেই দাঁত সুরসুর করে আর আমি দিই ঘ্যাঁক করে কামড়ে।  তাতে তো সবার মজাই লাগে। তাহলে কি বিংগো যদি কামরায় তাহলে সমস্যা।  কি জানি।  জানিনা।  

এখানে বেশ কিছু মু মু আছে।  বেশ বড় , বড়।  বেশ দুলকি চলে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যায়।  সবথেকে মজার ব্যাপার কি জানো , এখানে প্রচুর লোক।  বারান্দায় এসে দাঁড়ালে পর পর সামনে দিয়ে লোক চলে যায়।  আমি তাদের সাথে কথা বলতেই থাকি , বলতেই থাকি।  মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়ে কথা বলে।  আবার চলে যায়। আমি ওই গ্রিলের ওপারে কিছুতেই যেতে পারিনা। অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি।  

একদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি কি ভয়ানক সাউন্ড।  সারা বাড়ি কাঁপছে।  খাট কাঁপছে, বিছানা কাঁপছে , মা কাঁপছে কিন্ত চোখ খুলছে না।  ভয়ে সিঁটিয়ে মায়ের কোলে ঢুকে পড়েছিলাম।  ঘুম আসেনি , কিন্তু পরের দিন দাদুর সাথে বেড়াতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সেটা ট্রেনের আওয়াজ।  আর ট্রেন চলে গেলে সব কিছু কাঁপতে থাকে।  এতদিন আমাকে সবাই মিলে মুরগি করেছিল।  ট্রেনের নাকি আওয়াজ কু ঝিক ঝিক ঝিক।  মোটেও না।  ধুধুম ধুধুম ধুধ ধুধ ধুধুম ধুধুম ধুধ ধুধুম ধুধুম ধুধ ধুম।  এরকম আওয়াজ।  আমি রোজ দাদুর সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছি। দাদু আমাকে ট্রেন দেখিয়েছে , গাড়ি দেখিয়েছে , ঠিক যেমন আমার বাড়িতে যখন দাদু ছিল তখন যেমন দেখাতো।  এখানেও তেমন।  কিন্তু  ওটা তো দাদুর জায়গা নয়।  দাদু তাই বেশি কিছু দেখতে পারতো না।  এখানে তো দাদু সব চেনে , তাই অনেক কিছু দেখিয়ে দেখিয়ে আমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসতো।


এর মধ্যে একদিন বাবা মা আর আমি গেলাম বাবার প্রথম বাড়ি দেখতে। বাবা নাকি যখন আমার থেকে একটু বড় ছিল তখন ওই বাড়িতে থাকতো।  যে গাড়িতে আমাকে চাপিয়ে নিয়ে গেলো, আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ  , আমি হেব্বি ভয় পেয়ে গেছি।  সব দিক খোলা।  যে কোনো সময়ে ছিটকে পরে যাবার ভয় করছিলো।  এরকম গাড়িতে কেউ চাপে নাকি!  মা কে আঁকড়ে ধরে বসেছিলাম।  আগের গাড়ি গুলোতে এটলিস্ট চলে ফিরে বেড়ানোর ব্যবস্থা থাকে।  এটাতে তো মায়ের কোল থেকে নামলেই ধুপপা।  নামটাও কেমন একটা যেন - টোটো।  আমাদের এখানকার দোকানে যে শপিং কার্ট আছে না , সেটার থেকেও এই গাড়িটাা খারাপ ।  কিন্তু থাক সে কথা , আমরা ঠিক ভাবেই  পৌঁছে গেলাম আরেক ঠাম্মা দাদুর বাড়ি।  

বাবা নাকি মাকেও  এই বাড়িতে প্রথম বার নিয়ে এলো।  বাবা অনেক কিছু বলে যাচ্ছিলো।  কিন্তু আমার নজর ছিল একটা আয়নার ওপর।  আয়নাটা বেশ মিষ্টি।  ছোট্ট মতো।  আমি ধরে নিজের মুখ দেখছিলাম।  কিন্তু সবাই এতো হাঁ-হাঁ করে তেড়ে এলো যে ভেবড়ে গিয়ে দিলাম ছুঁড়ে ফেলে।  আর পরে গিয়ে খান খান হয়ে ভেঙে গেলো। এখানে একটা সমস্যা কিছু একটা ছুঁড়ে ফেললেই যায় ভেঙে।  আমার বাড়ির মতো তো আর কার্পেট নেই এখানে। সব শক্ত লাল কালো মেঝে।  আর হ্যাঁ , দোষ কি আমার নাকি।  এতো প্রটেকটিভ হলে চলে।  এবার যদি ভাঙা কাঁচ পায়ে ঢুকে যায় তাহলে? কিন্তু আমার এই ঠাম্মা সব পরিষ্কার করে দিলো , আর আমার নজর গিয়ে পড়লো তখন দাদুর হাতে থাকা পেনের ওপর।  কি সুন্দর সবুজ রঙের পেন।  দাদুও কিছুতেই দেবে না , আর আমিও নেবো।  শেষ মেশ দিতে বাধ্য হলো।  আর আমি তখন সব জায়গায় লিখে লিখে বেড়াতে লাগলাম।  

পেন জিনিসটা এখন আমার নতুন ভালোবাসা।  দেখলেই কিছু একটা করতে ইচ্ছা করে।  আর অনেক কিছু করাও যায়।  ঘষে দিলে লেখা পরে , চুষতে বেশ ভালো লাগে , যে কোনো জিনিসে আটকে যায় , স্পেশালি যেকোনো খাবারে।  মা যখন ম্যাগি বানিয়ে দেয় তখন হাতে ধরেই খাই , কিন্তু পেন ঢুকিয়ে দিতে আরো মজা লাগে।  দাদু ঠাম্মা একটা প্লেটে করে চারটে গোল গোল সাদা জিনিস এনে দিলো বাবার হাতে। আগেও দেখেছি ওগুলো।  দিলাম ঢুকিয়ে পেনটা। দেখলাম  আর সোজা উঠে চলে এলো পেনের আগায়।  প্লেট উল্টে চটচটে একটা জল পরে গেলো খাটের ওপর।  যেহেতু সেটা খাবার জিনিস , তাই জিভে লাগিয়ে দেখতে গেলাম।  ইশ কি বাজে খেতে - মিষ্টি তো।  মুখ বেঁকিয়ে বাবাকেই খাইয়ে দিলাম।  জিনিসটা খেতে খারাপ হতে পারে কিন্তু পেনের আগায়া ভালোই ওঠে তাই ওই চারটেই পেনের আগায় লাগিয়ে খাইয়ে দিলাম সবাইকে।  এবার বাড়ি ফেরার পালা। 

এর কয়েকদিন পরে আবার ঠাম্মা দাদুর বাড়ি যাবার দিন চলে এলো।  এবার আর ঠাম্মা দাদুর বাড়ি না , এবার বড় ঠাম্মার বাড়িতে যেতে হবে।  বাবার - বাবার - মা।  সেটা অনেক দূর।  সক্কাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সব্বাই রেডি।  বাবা গাড়ি নিয়ে এসেছে , মা আর আমি গাড়িতে উঠে আবার এক জায়গা থেকে ঠাম্মা দাদুকে তুলে নিলাম।  তার পর যাচ্ছি তো যাচ্ছি।  গাড়ি চলছে তো চলছে।  আমি ঠাম্মা দাদুর কোলে আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে আছি।  ঠান্ডা হাওয়ায় আমার একটু ঝিমুনি এসে গেছিলো।  হঠাৎ কি হলো দেখি বাবা পিছন থেকে আমাকে সামনের সিটে নিয়ে এসে বসলো। আরে আরে করছে কি ? কিডস আর নট এলাউড ইন ফ্রন্ট সিট।  

কিন্তু বাবা তো বাবা।  নিজের দেশে এসে বাবার একটা ল্যাজ বেরিয়েছে।  প্রচুর ইন্কারেক্ট জিনিস করে চলেছে। সবাই বারণ করছে কিন্তু শুনছে  না।  আমি কিন্তু বাবার এই আউট অফ দা বক্স এটিচুড বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছি।  কারণ আই এম দা ওয়ান হু ইস পজিটিভলি বেনিফিটেড ফ্রম ইট।  কিন্তু এটাকে আমি ঠিক মনে নিলাম না।  যদি কিছু হয়ে যায়।  কিন্তু কিছুই হলো না।  বরঞ্চ আমার কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেলো যে বাবা বা মা যখন গাড়ি চালায় তখন ওরা কি দেখে।  কি সুন্দর লাগে সামনের রাস্তাটা।  মনেই হয় না গাড়িতে আছি আর গাড়িটা এগোচ্ছে।  আমি একবার করে বাবার কোলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম।  আমি যখন আমার কার সিট্ থেকে ওঠার চেষ্টা করি তখন এই বাবাই চোখ লাল করে বারণ করে।  কিন্তু সেই বাবাই আমাকে এনকারেজ করছিলো দেখার জন্য।  

একটা বাঁক নিতে একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেলো।  দুটো পিগ রাস্তা পার হচ্ছিলো।  অইংক অইংক করতে করতে।  যে গাড়ি চালাচ্ছিল সে কি জোরে হর্ন বাজালো।  একটা টপকে গেলো কিন্তু একটার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলো লোকটা।  গাড়িটা একটু হেলে দুলে আবার সোজা চলতে লাগলো।  মা পেছন থেকে চিৎকার করে উঠলো।  বাবা শান্ত।  ঠাম্মা গুমড়োচ্ছে।  আচ্ছা ওই পিগটার কি হলো।  গাড়ি কারোর ওপর দিয়ে চলে গেলে কি হয়।  বাবা ব্যাক মিরর দিয়ে দেখে বললো পরে আছে।  ও আচ্ছা।  পরে গেছে তাহলে।  মায়ের না, সব কিছুতেই চিৎকার করা একটা অভ্যাস।  

আমরা যখন গিয়ে পৌছালাম তখন দেখি এক গুচ্ছ লোক বাড়িতে।  এই বাড়িটা কি বড়।  বিশাল বড়।  আমাদের বাড়ির থেকেও।  আর সামনে বিশাল খেলার জায়গা।  আর সবথেকে মজাদার হলো আমার দাদা , গলু।  হ্যাঁ গো হ্যাঁ , আমার একটা দাদা আছে।  আমাকে হেব্বি ভালোবাসে। আমার জন্মদিনে আমাকে উইশ করেছিল। আমি যেদিন এলাম , সেদিন আমার সাথে ফোন থেকে কথাটা বলেছিলো।  আর এখন সামনে আমার সাথে কত খেলা।  হেব্বি মজা। এই গলু দাদার মা টা পচা।  আমার জেম্মা , আমার নাম দিয়েছে পটল।  আই ডোন্ট নো হোয়াট পটল  মিন্স বাট ইট সাউন্ডস বাজে।  আর দাদাকেও ডাকে ভিন্ডি বলে।  কিন্তু জেম্মা আমাকে খুব আদর করেছে।  একটা সুন্দর জামা দিয়েছে।  সবুজ রঙের।  

সেদিন নাকি বাড়িতে কি একটা ফেস্টিভ্যাল।  দোল , অদ্ভুত নাম , বাট কোয়াইট ফেমাস ।  প্রচুর লোক , বাড়িতে অনেক কিছু করে বেড়াচ্ছে।  অনেকেই রান্না করছে।  নানা ধরণের রান্না।  কি না ভোগ নিয়ে যাওয়া হবে , কোনো একটা জায়গায়।  আমিও যাবো।  কিন্তু কে বা আমাকে নিয়ে যাবে।  তার থেকে আমি আর দাদা প্রচুর খেলে নিলাম।  এই বাড়িতে অনেক অনেক গাছ আছে।  বেশ বড় বড় গাছ।  আর গাছ থেকে অনেক অনেক পাতা পড়ছে।  দাদা দেখলাম গিয়ে সেই পাতার ওপর শুয়ে পড়লো। আর আমাকে ডাকতে লাগলো।  বাবা দেখি পেছন থেকে এসে চ্যংদোলা করে আমাকে সেই পাতার ওপর শুইয়ে দিলো।  আমি বললাম না , বাবা অনেক ইন্কারেক্ট জিনিস করছে , কিন্তু যা করছে তাতে বেশ মজা হচ্ছে।  কি মজা ওই পাতার ওপর শুয়ে।  দাদা আবার পাতা তুলে তুলে আমার গায়ের ওপর দিতে লাগলো।  আমিও দিতে লাগলাম।  যেরকম ভাবে ডেকেয়ারে উড চিপস নিয়ে খেলি সেরকম ভাবেই পাতা নিয়ে খেলতে লাগলাম।  আরো কত কিছু খেলা।  সেই প্রথম শিখলাম কারো পেছনে তাড়া করে ধরে ফেললে বলতে হয় , ‘এই যাঃ। ’ পরে যদিও অনেক জিনিসেই বলতে শুনলাম এই যাঃ। আমিও অনেক জিনিসেই লাগাতে আরম্ভ করলাম ‘এই যাঃ’।  

কিন্তু সত্যি সত্যি এই যাঃ হয়ে গেলো যখন আমরা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে ঘুরতে গেলাম।  সবাই মিলে সেজে গুজে হাতে থালা টালা নিয়ে যখন আমরা বেরোলাম তখন খুব মজা লাগছিলো।  আমাদের ওখানে যেরকম গাছপালা।  এখানেও সেরকম।  কত গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা রাস্তায় এসে হাজির হলাম।  সেখানে বেশ কিছু টোটো দাঁড়িয়ে ছিল।  আমি প্রমাদ গুনলাম।  আবার সেই সব খোলা গাড়িতে চাপতে হবে।  কিন্তু সেগুলো  ছেড়ে দিয়ে বাবা গিয়ে বসলো আর একটা গাড়িতে তাতে কিছুই নেই।  না ওপরে ছাদ , না ধরার কিছু।  সবটাই ফাঁকা।  সামনে একটা লোক সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে একটা সিটে গিয়ে বসলো আর তার পেছনে লাগানো একটা কাঠের বানানো জায়গায় সবাই টুক টুক করে উঠে পড়লাম। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো , “আধ্যানের ভ্যানেও চাপা হয়ে গেলো।” কি ভয়ঙ্কর গাড়ি রে বাবা।  আমায় মা আবার সামনে ধরে বসেছিল। টেকনিক্যালি , মায়ের কোলে ঝুলছিলাম।  যেকোনো সময় পরে যেতে পারি।  কিন্তু আমি বীরপুরুষ।  বাবা আমাকে দিন দিন সাহসী করে তুলছে।  আমি ভয় পাইনা বটে, কিন্তু সেদিন ভয় পেয়ে গেছিলাম।  

আরে তোমাদের তো বড় ঠাম্মার কথাই বলা হয়নি।  বাবার বাবার মা।  সে নাকি অনেক অনেক বড়।  অনেক দিন আগে হ্যাপি বার্থডে হয়েছিল।  কিন্তু কি মিষ্টি।  সব চুল সাদা।  আর সাদা শাড়ি পরে।  ছোট্টোখাট্টো।  আমি যখন গেলাম তখন অনেক গুলো ছবির সামনে চুপ করে বসেছিল। ওই ছবিগুলো আমাদের বাড়িতেও দেখেছি।  আমি চেটে দিতাম বলে এখন ছবিগুলোকে ঝুলিয়ে দিয়েছে।  আমার নাগালের বাইরে।  এখানে নাগালে পেয়ে ধরতে গেছি দেখি বড় ঠাম্মা আমায় ধরে চটকে দিলো।  কি মিষ্টি একটা গন্ধ গায়ে। কি নরম গা হাত পা।  আমি ভাবতাম মা ই সবথেকে নরম।  কিন্ত না , বড় ঠাম্মি একেবারে তুলতুলে।  কিন্তু আমার চামড়ার মতো চামড়া নয়।  কিরকম ভাঁজ করা করা।  বাবার চামড়া ধরে টানলে ওঠে না।  কিন্তু ঠাম্মার চামড়া ধরে বার বার টানলে দেখেছি কিরকম হাতে চলে আসে।  আর আমি টানলে ঠাম্মা কি মিষ্টি হাসি দেয়।  আমার নাম দিয়েছে পুতি।  এটাও কেমন যেন নাম।  কিন্ত ঠাম্মা যখন বলে তখন বেশ মিষ্টি লাগে।  

সেই বড় ঠাম্মাও আমার সাথে ওখানে গেলো।  গিয়ে দেখি অনেক লোক।  সবাই একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা পুতুল নিয়ে খেলা করছে। আমি উঁকি দিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম এই পুতুলটা কোথায় যেন দেখেছি।  তারপর মনে পড়লো ওই ছবিগুলো যেগুলো ঝোলানো আছে তাদের মধ্যেই একজন।  এখানে এসে থেকে আমি তাদের দেখে চলেছি যারা ছবিতে বা মোবাইলে থাকতো।  আমি কি তাহলে ফোনে ঢুকে পড়েছি।  কিন্তু ফোন তো ছোট্ট।  এই জায়গাটা তো অনেক বড়।  খুব কনফিউসিং। তবে এখানে আমার অনেক লোক।  সবাই আমাকে আদর করছে।  সবাই আমার সাথে খেলছে , সবাই মজা করছে।  ওখানে কেউ নেই।  

সে যাইহোক , ওই ঘরে ঢুকেই আমার আবার পটি হয়ে গেলো।  ওখানে যখন পটি হতো  , তখন আমার ডাইপার চেঞ্জ করে ধুইয়ে , পাউডার মাখিয়ে আবার ডাইপার পড়াতে বাবার বা মায়ের বেশি সময় লাগতো না।  সবার জন্য আলাদা জায়গা আছে।  কিন্তু ওখানে তো আর আমার মতো ডাইপার পড়া কেউ নেই , তাই আমার ডাইপার খুলিয়ে ধোয়াতে নিয়ে যেতে হলো একটা গোল মতো জায়গায়।  সেখানে মাঝখানে আবার আরো  বড় গোল আছে।  একটা বালতি দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।  সেটা সেই গোলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে টানতেই এক বালতি জল উঠে চলে এলো।  আমি অবাক।  কোনো কিছু নতুন দেখলে বেশ কিউরিসিটি বেড়ে যায়।  বাবার কোলে ঝানাপাঝাঁপি করতে বাবা বুঝতে পেরে আমাকে ওই গোলের মধ্যে উঁকি দিতে দিলো।  নীচটা খুব অন্ধকার।  আর কিছু একটা চকচক করছে।  কেউ মনে হয় নিচে থাকে যে এক বালতি জল ভরে দিলো। সেই দিয়ে ধোয়া টোয়া হয়ে গেলো।  ওখান থেকে কে একজন বলে দিলো , পায়ে জল দিয়ে আসবি।  


এই পায়ে জল দেওয়ার কোথায় মনে পরে গেলো , আই ডোন্ট লাইক বাথরুম হিয়ার। আরে বাথরুম মানেই সবসময় জলে জলাকার।  কেন বাবা?  জলের জন্য জলের জায়গা আছে।  আমাকে ক্লিন করানোর জন্য বেসিন আছে, স্নান করানোর জন্য বাথটব আছে, রান্নার সিংক আছে, সবই তো এখানেও সেম।  তাহলে বাথরুমে এতো জল থৈ থৈ করছে কেন।  মানছি এখানে বাথটাব নেই।  কিন্তু তা বলে বাথরুমের পুরোটাতেই জল থাকবে সে আবার কি ধরণের কথা। সবসময় মনে হয় পরে যাবো। ধুপ করে পরে যাবো।  আর বাথরুমের ভেতর এতো বালতি কেন ? আর সব বালতি সব সময় ভরা থাকে কেন ? এতো জল দরকার কেন? আর জল শুকোয় না কেন ? আমি তো কতবার আমার বাথরুমে জল ফেলে দি। মা এসে কাগজ দিয়ে পুঁছে দেয়।  এখানে দিচ্ছে না কেন? ভিজে জায়গায় আবার জল ফেলে ভিজিয়ে দেয়। এই একটা জিনিসে আমার সত্যি আপত্তি।  ভালো লাগে না।  তাই স্নান করার সময় সেই খেলা করাও আর হয় না।  কোনো রকমে স্নান করে তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে পারলে বাঁচি।  তার ওপর এখানে বলছে পায়ে জল দাও।  

এখানে পায়ে জল দিলে কিন্তু পা ধোয়া হয় না।  কারণ ধুলো লেগেই থাকে।  আমার পা ধুয়ে দিয়ে যখন গিয়ে মায়ের শাড়িতে পা পুঁছলাম , দেখি মায়ের শাড়ি কালো। ও হ্যাঁ , মা এখানে সারি পড়েছে। কি সুন্দর লাগে মা কে শাড়ি পরে।  যতটা না সুন্দর মা কে দেখায় , তার থেকে ভালো লাগে শাড়ি নিয়ে খেলতে।  এখানে সবাই শাড়ি পরে থাকে।  সব্বাই।  কেউ প্যান্ট শার্ট পরে না।  আমিও বড় হয়ে শাড়ি পড়ব।

যাইহোক ওরা পুতুলটা নিয়ে খেলছিল , আর আমি বোর হচ্ছিলাম।  কিছুক্ষন পর ঘুম পেয়ে গেলো।  ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি আবার আগের বাড়িতে ফিরে এসেছি।  খুব খিদে পেয়ে গেছিলো।  কিন্তু মা কে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। বাবার কাছেই ঘ্যান ঘ্যান করতে আরম্ভ করলাম।  কিছুক্ষন পর দেখি মা আবার খিচুড়ি নিয়ে চলে এসেছে।  তখন খিদের মাথায় , ওই খিচুড়িই আমার কাছে অমৃত লাগার কথা।  কিন্তু মুখে দিতেই আমার ব্রম্ভান্ড জলে গেলো।  পাশ থেকে কে যেন বললো , ‘ভোগের খিচুড়ি ভালোই লাগবে।’ সে আবার কি জিনিস।  ভোগের খিচুড়ি।  কি ভয়ঙ্কর খেতে।  সাংঘাতিক ঝাঁঝালো।  মুখে নিতেই পারছিলাম না।  একদম ভালো লাগছিলো না।  মা কয়েকবার মিষ্টি করে চেষ্টা করে বাবাকে ধরিয়ে দিলো।  বাবাও চেষ্টা করে বুঝতে পারলো যে ওটা আমার ভালো লাগছে না।  ভালো খারাপের ব্যাপার নেই।  আমি খেতেই পারছিলাম না।  কোথায় মা সুন্দর করে আমার জন্য স্পেশাল খিচুড়ি বানিয়ে দেয় , আর কোথায় এই ভোগের খিচুড়ি।  খুব বাজে , খুব বাজে।  যাইহোক মা শেষমেশ ওট মেখে এনে আমার প্রাণ বাঁচালো।  একে খিদেতে পেট জ্বলছে , তারওপর ওই ভয়ঙ্কর পেট জ্বলা খিচুড়ি।  এক পেট খেয়ে তখন দেখি এনার্জি তুঙ্গে।  


আর তখন বাড়িতে প্রচুর লোক আসছে।  সবাই আসছে আর আমাদের বাগানে রাখা টেবিলে বসে পড়ছে।  টেবিল গুলো বেশ মজাদার।  আমি ধাক্কা দিলেই পড়ে যাচ্ছে।  কিন্তু তাতেই বসে লোকেরা খাচ্ছে।  যত লোক আসছে , তত লোক আমাকে চটকাচ্ছে।  আর আমাকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করছে।  প্রথম প্রথম আমি জেন্টেলম্যানের মতো সবার কোলে যাচ্ছিলাম।  কিন্তু কিছুক্ষন পরে আর পেরে উঠলাম না।  তারপর আমি দৌড়াতে শুরু করলাম যতক্ষণ না  হাঁফিয়ে উঠি। 

বিকেলে যখন বাড়ি ফাঁকা।  তখনও আমি ক্লান্ত হইনি।  কিন্তু সবাই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে।  আমি দেখলাম আমি তো না খেললে বোর হয়ে যাবো।  সবাই এদিক ওদিক বসে আছে। কেউ খাটে কেউ চেয়ারে , আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে । আমার কাউন্টিং খেলা শুরু করলাম।  ঠাম্মা নিচে বসে ছিল, আমি হাত ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে খাটে বসলাম আর বললাম , “ওয়ান” . নেক্সট হলো আমার জেম্মা ঠাম্মা মানে আমার বাবার বম্মা।  তাকেও চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঠাম্মার পাশে বসলাম আর বললাম , “তু” , এরপর ছিল জেঠু।  বসেই ছিল তাই নাম দিলাম , “থি” এরপর মা কে বসাতে গেলাম কিন্তু মা বসলো না।  আর বাবা আমার দিকে ফোন তাক করে ছিল।  তাই বেশি পাত্তা দিলাম না। মা যেহেতু বসলো না।  তাহলে সবাইকে আবার দাঁড় করিয়ে দি।  সবাই কে আবার এক এক করে হাত ধরে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম।  এবার পালা আমার সাথে “ইয়া ইয়া ইয়া ইয়া ” খেলা।  ওই যেরকম ফাইভ লিটিল ডাক্স গুলো করে , ওরকম ভাবে হাত দুটোকে ঝাপটাতে হবে , আর মুখ দিয়ে দিয়ে বলতে হবে , ‘ ইয়া ইয়া ইয়া ইয়া ‘ । এটা দেখেছি অনেকেই বেশ ভালো খেলে।  কিন্তু সবাই একসাথে যে করবে সেটা ভাবিনি।  আমি যেই বললাম ‘ ইয়া ইয়া ইয়া ইয়া ‘ সবাই দেখি উত্তরে করলো ‘ ইয়া ইয়া ইয়া ইয়া ‘।এই তো।  ফোর বিগ ডাক্স আর আমি  ফাইভ।  বেশ কিছুক্ষন করার পর সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়লো।  তখন আর আমি ওদের ছেড়ে দাদার সাথে খেলতে লাগলাম।  

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি দাদা চারটে বালতি নিয়েছে।  আর তাতে জল ভরে কি একটা জিনিস গুলছে।  কি সুন্দর সব রং হয়ে যাচ্ছে বালতি গুলোতে।  আর একটা থালাতে , নানা ধরণের রঙের গুঁড়ো রাখা রয়েছে। কিন্ত মা কিছুতেই আমায় এগোতে দেবে না।  বাবা মাঝে মাঝে এগিয়ে আসছে ছো মেরে তুলে নিয়ে যাবার জন্য।  কিন্ত মা একেবারে অগ্নিমূর্তি ধরেছে।  তারপর সবাই আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিয়ে দেখলাম থালা থেকে ওই গুঁড়ো গুলো তুলছে আর একে অপরের মাথায় মাখাচ্ছে।  এ কি রকমের খেলা।  আমিও খেলবো।  কিন্ত কিছুক্ষনের মধ্যে সবাই কিরকম ভয়ানক দেখতে হয়ে গেলো।  ওই গুঁড়োগুলো তো সুন্দর সুন্দর রঙের ছিল।  কি করে সবাই কালো হয়ে গেলো? কাউকে চেনা যাচ্ছে না।  বাবা আবার দাদারা পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে।  আর দাদা কেঁদে কেঁদে ফিরছে।  আমি রীতিমতো কনফিউসড হয়ে গেলাম এবার কি করবো ভেবে। মাও উশখুশ উশখুশ করছিলো , এবার জেম্মা গিয়ে মা কে ধরে ওই গুঁড়ো মাখিয়ে দিতে আমার গায়েও কিছুটা লেগে গেলো।  একটু টেস্ট করে দেখলাম সেটা মোটেও খাবার জিনিস না।  ততক্ষনে সবাই আমাকে এক এক আঙ্গুল করে লাগিয়ে দিয়েছে।  কেউ আমাকে বিশেষ মাখাইনি।  আর আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না এতে খুশির কি আছে।  তাই সবাই যখন ছবি তুলছিলো আমি বেশ গোমড়া গোমড়া মুখ করেই ছিলাম।  

রাতে আমরা আবার বাড়ি ফিরে এলাম সেই গাড়িটা করে।  রাস্তায় একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে বাবা কি একটা কিনে এনে সবার হাতে ঠোঙা করে করে ধরিয়ে দিলো।  চপ মুড়ি।  এটা নাকি পরম চরম উপাদেয় খাদ্য।  মানছি মুড়ি একটা সত্যি উপাদেয় খাদ্য।  আমি খুব ভালোবাসি, কিন্তু চপের গন্ধ আমার বিশেষ সুবিধার মনে হলো না। যাই হোক আমরা যখন গিয়ে পৌছালাম তখন রাত হয়ে গেছে।  

এবার বাবার পার্টি।  বাবা হেব্বি এক্সাইটেড ছিল বাবার বন্ধুদের কাছে আমাকে দেখানোর জন্য।  আমার নাকি ওখানে অনেকগুলো দাদা আছে।  আমার থেকে সবাই বড়।  অনেক বড় কিন্ত আমার গলু দাদার মতো বড় নয়।  আমিও এক্সাইটেড ছিলাম সবার সাথে দেখা করার জন্য।  বিকেলে আমরা সাজুগুজু করে প্রথমে বাবার এক বন্ধুর বাড়ি যাবো।  সেখানে আমার দুজন ফ্রেন্ড আছে।  তাদের সঙ্গে খেলা করে আমরা যাবো আরেকটা বাড়িতে। সেখানে সবাই আসবে।  আমরা আবার টোটো চেপে প্রাণ হাতে করে অন্ধকার রাস্তা ধরে যখন গিয়ে হাজির হলাম তখন আমার শরীর হঠাৎ করে খারাপ লাগতে লাগলো।  কি জানি কি হলো , পেট ঘুলিয়ে পটি হয়ে গেলো।  আর পটি হতেই কি যন্তন্না। এতো কনফিডেন্স নিয়ে এতদিন ছিলাম।  কোনো কিচ্ছু হয়নি।  যেদিন হওয়ার কথা ছিল না সেদিনই শুরু হলো সেই ভয়ঙ্কর ডাইপার র্যাশ।  কি লজ্জা, কি লজ্জা। বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।  সরি বাবা।  কিন্তু কাকুটা বললো , কোনো অসুবিধা নেই।  সবার সাথে দেখা করে তার পর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে যাস।  সেদিন আবার আমার ওই ফ্রেন্ড দুজনেরও শরীর খারাপ।  তাই ওরাও নাকি যাচ্চে না।  আমি একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।  

কিন্ত ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাকুটা বললো সবাইকে ওর বাইকে চেপে পড়তে। এই বাইক জিনিসটা এখানে প্রচুর।  বাবার একটা সাইকেল আছে।  যখন বড় ঠাম্মার বাড়ি গেছিলাম তখন বাবার সাইকেলে চেপেছিলাম।  কি সাংঘাতিক।  আমার জন্য একটা ছোট্ট সিট ছিল সামনে। জেঠু বলেছিলো ওটা নাকি বাবা যখন ছোট ছিল তখন বাবার জন্য বানানো হয়েছিল।  আমি বেশ খুশি হয়ে ওর ওপর উঠতে গিয়ে দেখি এ তো টোটোর থেকেও খারাপ অবস্থা।  ভাগ্যিস চালিয়ে নিয়ে যায়নি।  নাহলে যেকোনো সময় আমি ধরাম করে পরে যেতাম। যদিও সাইকেল অনেক আস্তে চলে।  তবু পরে গেলে খুব লাগতো।  আর এই বাইক তো পুরো সাইকেল এর মতো , কিন্তু অনেক জোরে চলে।  আর তার মধ্যে চারজন ঢুকবো কি করে। 
  

প্রথমে ওই কাকু।  তারপর আমি তারপর মা , তারপর বাবা চেপে বসলাম।  আমার তো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি।  কাকুটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলাম।  এক হাতে কাকুকে ধরেছি, আর মা কে সমানে ঠেসে যাচ্ছি।  জানিনা বাবা কি ভাবে বসে ছিল। আর তিনজনেই মোটা মোটা।  কিছুতেই ফিট হচ্ছিলো না। আর তারপর যখন বাইক ছেড়ে দিলো তখন তো টলমল টলমল করছে পৃথিবী।  আমার প্রাণ যায় যায়।  কিন্তু বেশিক্ষন ওতে বসতে হলো না।  কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।  আমার খুব ঘুম পেয়েগেছিলো।  ঘরে ঢুকে মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।  ঘুম ভাঙলো , দেখি আমি আবার বাড়িতে চলে এসেছি।  ব্যাপারটা কি ? বাবা নেই।  বাবা নাকি এসে আমাদের রেখে চলে গেছে। আমার ফ্রেন্ড দের নাকি কেউ আসেনি শুধু এক জন ছাড়া।  কি আর করবো।  তার সাথেও দেখা হলো না।  কিন্তু ওই ডাইপার র্যাশটা বড্ডো জ্বালাচ্ছিলো।  সারা শরীর ছেড়ে দিয়েছিলো ক্লান্তিতে।  আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।  


ঘুম ভাঙলো প্রচন্ড পেটের যন্ত্রনায়।  সাংঘাতিক যন্ত্রনা।  সে যন্ত্রনা আর বলে বোঝাতে পারবো না।  দেখি মা , ঠাম্মা , দাদু আমাকে কোলে নিয়ে বসে আছে।  হঠাৎ বাবা একটা কাকুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।  আমি নাকি ঘুমের মধ্যে ঘন্টাখানেক ধরে কাঁদছি।  সাংঘাতিক কাঁদছি।  জেগে যখন এতো কষ্ট হচ্ছে তখন নিশ্চই ঘুমের মধ্যে আরো কষ্ট হচ্ছিলো।  আমি তো আর বড়দের মতো বলে বোঝাতে পারবো না কোথায় কষ্ট হচ্ছে।  এই কাকুটা আমার জন্য একটা ওষুধ এনেছিল।  ওটা খাইয়ে দিতে ক্লান্ত শরীর আরো এলিয়ে পড়লো।  দেখলাম বাবা কাঁচুমাঁচু হয়ে একবার আমার দিকে , একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।  সরি বাবা।  এরকম করে তোমার পার্টি পন্ড করে দেওয়ার জন্য।  খাওয়াটা যদি আমার হাতে থাকতো তাহলে হয়তো ব্যাপারটা এরকম হতো না।  তোমরাই একরকম জোর করে গেলানোর চেষ্টা করো আর তাতেই আমার শরীর খারাপ হয়।  আমার কোনো দোষ নেই।  


এতকিছু হওয়ার পরের দিন সব ঠিক।  এবার আবার মাসির বাড়ি যাওয়ার পালা।  ওখানেই বাকিটা সময় থেকে আবার আমি আমার দেশে। বাকিটা সময় ওখানে আর বেশি কিছু ঘটেনি। অনেক কিছু শব্দ শিখেছি।  দিদা দিন রাত আমাকে বলতে থাকতো চল চল চল।  আমিও একদিন জিভটাকে মুখের ওপরের দিকে লাগিয়ে আওয়াজ করতেই বেরিয়ে এলো চ।  দু তিনবার করতেই বেরোলো চ-চ-চ।  তখন দিদার হাতই ধরা ছিল।  দেখলাম দিদাও বললো ঠিক আছে চ।  দিয়ে এগিয়ে গেলো।  আমি বুঝলাম চ মানে এগিয়ে যাওয়া।  তাই যখনিই কাউকে কোথাও নিয়ে যেতে হতো বলতে আরম্ভ করলাম চ-চ-চ।  দেখলাম সবাই ঠিক ঠাক এগিয়ে যাচ্ছে।  

একদিন  মাসির সাথে বসে বসে চু চু টিভি দেখছি।  সেখানে বলছিলো এস ফর ষ্টার।  আমার বেশ লাগে ষ্টার বলতে।  আমি বললাম এস - ষ্টার।  “ফর” বলতে বেশ প্রব্লেম , ঠোঁট টোট নাচাতে হয়।  মাসি আমার দিকে ঘুরে বললো।  “সিস্টার ? “ আমি বললাম এস-স্টা-আ-আ-র। মাসি তো খুব খুশি।  মাসি ভেবেছে আমি নাকি মাসিকে সিস্টার বলছি।  ভেবে খুশি হলেই হলো।  তারপর থেকে আমি মাসিকে দেখলেই বলতে আরম্ভ করলাম এস-ষ্টার।  কিন্তু ধীরে ধীরে আমার কথাও পাল্টে বেরিয়ে আসতে লাগলো সিস্টার।  সবাই খুব খুশি।  আমিও খুশি।  

এবার মায়ের বন্ধুদের পালা।  একদিন রাতে আমরা আবার টোটো চেপে একজনের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম।  যাবার আগে মা বলে দিয়েছিলো কোনো ঝামেলা না করতে।  মা নাকি বহু বছর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে।  বাবার কেসটা কেঁচিয়ে দেওয়ার পর মা বেশ চাপে ছিল।  যে লোকটা আমাকে টোটো থেকে কোলে তুলে নিলো সেটাকে দেখিয়ে মা বললো , ‘ এটা কাকু-মামা’ । সে আবার কি।  সেই কাকু মামা নাকি মা বাবার বিয়ের কারণ।  আর বাবা মা দু তরফেরই বন্ধু।  ইম্পরট্যান্ট পিপল।  বেশ আদর টাদর করে দিলাম।  সবাই খুশি।  ওখানে গিয়ে দেখি আমার তিন তিনটে বন্ধু।  খুব খেললাম, কিন্তু ঝগড়া বাঁধলো সেই গাড়ি নিয়ে। ওরাও ছাড়বে না।  আমিও ছাড়বো না।  ছাড়বো কেন ? গাড়ি গুলো কি সুন্দর।  আমার যেটা ইচ্ছা সেটা আমি নেবো।  কেউ যেন ঝামেলা না করে। ওরা করতে এলো আমিও ঝাঁঝিয়ে দিলাম।  কিন্ত এরা তো দেখি ফাইট ব্যাক করে।  কিন্তু আল্টিমেটলি আন্টি এসে সব ঠিক করে দিলো।  পুরো ট্রিপটাতে আমি শুধু বাবাকে বার বার সরি বলে গেছি আর মা আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে গেছে।   
সিস্টার একদিন আমাকে কোলে করে বারান্দায় ঘুরছিলো।  দেখি একটা লোক টু লিটিল মানকি নিয়ে ঘুরছিলো।  ঠিক আমাদের জানলার সামনে আমাকে দেখতে পেয়ে , থেমে গেলো। দুটো মানকিও থেমে গেলো।  আমি জানি মাংকিরা বেড এ জাম্প করে।  মাংকি গুলো দারুন ছিল কিন্তু লোকটাকে আমার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিলো না।  কি ভাবে মাংকি গুলোকে বেঁধে রেখেছে।  আমি টেনশন করছিলাম যে যদি মানকি গুলো আমার বেড এ উঠে এসে জাম্প করতে চায়।  অনলি মাংকি কে এলাও করতে পারি।  কিন্তু ওই লোকটাকে নয়।  কিন্তু কাউকেই ঢুকতে দিলো না মাসি।  ওরা ওখানে বসে বসে কত খেলা দেখালো।  দুটো মাংকি  কি সুন্দর।  আমি যদি ওদের সাথে চলে যেতে পারতাম খুব ভালো হতো।  বললামও, কিন্তু ওরা নিয়ে গেলো না।  

ফেরত আসার দু  দিন আগে  আমার ঠাম্মার স্কুলে একদিন যাওয়ার প্ল্যান ছিল।  ঠাম্মার নাকি আমার মতো ডে কেয়ার আছে।  সেখানে অনেক অনেক ছেলে আছে আমার মতোন।  আমি যখন আমার বাড়িতে ছিলাম।  তখন থেকে প্ল্যান করছিলো আমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য।  কিন্তু সময়ই হয়ে ওঠেনি।  তাই সেদিন বাবা আমাকে নিয়ে সোজা স্কুলে নিয়ে চলে গেলো।  বিশাল একটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি ঠাম্মা বাইরে দাঁড়িয়ে।  আমাকে কোলে করে নিয়ে ঠাম্মার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসলো।  আর সাথে সাথে এক গাদা টিচার এসে ঘরে ঢুকে পড়লো।  কি সাংঘাতিক ব্যাপার।  এতো লোক এইটুকু যায়গায়। সবাই আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে।  সবাই আমাকে কোলে নেবে।  জায়গা ছোট্ট।  হাঁফ ধরে যাচ্ছিলো। আর অতগুলো নতুন লোক। মনে হচ্ছিলো সবাই কামড়ে দেবে।  সবাই অথচ আদরই করছিলো।  আমি থতমত খেয়ে, ভয় পেয়ে, খাবি খেয়ে  কেঁদে ফেললাম।  এগেন আই অ্যাম সরি ঠাম্মা।  

বুঝতেই পারছিলাম ঠাম্মা সবার কাছে আমার সোশ্যালাইজিং স্কিল নিয়ে অনেক ভালো ভালো বলে এসেছে।  কিন্ত কি করবো , আমারও তো একটা লিমিটেশন আছে।  আমি একদম ঘাবড়ে গেছিলাম সেদিন।  খুব ঘাবড়ে গেছিলাম।  ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠাম্মা আমাকে কোলে করে নিয়ে ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিলো।  তখন আমায় পায় কে।  আমিও দৌড়ে বেড়াচ্ছি।  আর সবাই আমার সাথে সাথে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।  এর মধ্যে একজন এগিয়ে এসে আমাকে চকোলেট দিলো।  কিন্তু আমার নজর তার বুকে আটকানো পেন টার দিকে।  পেন টা নিয়ে আমি সব দেয়ালে লিখে দিয়ে চলে এলাম।  ওটাই থাকুক ওদের স্মৃতি হয়ে। 

এই পেন নিয়ে আরেকদিন তুমুল কান্ড হয়েছিল।  বাবা মা আমাকে নিয়ে কোনো একটা অফিসে গেছিলো।  ছোট্ট জায়গা।  অনেক টেবিল।  অনেক লোক ঘোরাফেরা করছে।  মা দেখলাম এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে দৌড়াদৌড়ি করছে আর বাবা আমাকে চেপে ধরে এক জায়গায় বসে আছে।  আমার কি বিরক্ত লাগছিলো।  কিন্তু কিছুতেই ছাড়ছিল না।  প্রত্যেক টেবিলে যে যে লোকগুলো বসে ছিল সবার হাতে একটা করে পেন ছিল।  পেন দিয়ে ওরা অনেক কিছু লিখছিলো।  শুধু দেখছিলো না আমার দিকে।  আমি একের পর এক টেবিলের সামনে গিয়ে জুল জুল করে তাকাচ্ছিলাম পেনের দিকে।  হাত বাড়াচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছিলাম না।  আমি তো গুড বয় তাই বায়না করছিলাম না।  আমি করিনা বায়না।  আই ডোন্ট লাইক ন্যাগিং।  আই ট্রাই , ট্রাই হার্ডার, তারপর ক্ষমা করে দিই।  কিন্তু হঠাৎ করে দেখি একজন বাবার কাছে এসে একটা পেন এগিয়ে দিলো, আর একটা কাগজ।  লোকেদের ক্ষমা করতে পারি।  কিন্তু বাবাকে নয়।  হামলে পরে পেন টা নিয়ে অনেক কাগজের ওপর লিখতে যাচ্ছিলাম, লোকটা আঁতকে উঠে কাগজ টেনে নিয়ে কেটে পড়লো।  বাবা কোনো রকমে আমাকে টেনে এনে বসলো।  আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে অপমানে মুখ চোখ লাল হয়ে কান্না বেরিয়ে এলো।  তখন একটা লোক এসে আমাকে একটা পেন দিয়ে শান্ত করলো।  

পেনের গল্প অনেক।  সব লিখলে সবাই বোর হয়ে যাবে।  কিন্ত সবথেকে বড় পেন হলো সবাইকে ছেড়ে চলে আসার পেন।  যেদিন চলে আসছি, সেদিন এয়ারপোর্ট এ সবাই কাঁদছিলো।  সব্বাই।  আমাকে ছাড়তে এসেছিলো দিদা , দাদু আর সিস্টার মানে মাসি। আমরা বাইরে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম কারণ অনেক আগে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম।  যখন আর বাইরে অপেক্ষা করা যাচ্ছে না।  তখন আবার কার্টের ওপর বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে আমরা যখন গেটের কাছে পৌছালাম তখন দেখি আমাকে আর মা কে কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।  এদিকে বাবা ঢুকে গেছে।  আমি পড়লাম ফাঁপরে।  তাহলে কি বাবা এবার আমাকে আর মা কে ছেড়ে আবার চলে যাবে।  জীবনের প্রথম এক বছর বাবাকে পাইনি।  সেই ভয়ঙ্কর সময়গুলো এখনো আমার মন থেকে যায়নি।  আর আমি চাইনা বাবাকে ছেড়ে থাকতে।  কিন্ত বাবার অঙ্গভঙ্গি দেখে মোটেই মনে হচ্ছিলো না যে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। 

বেশ কিছুক্ষন পর বাবা আবার বেরিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে ভেতরে চলে এলো।  পিছন ফিরে দেখলাম দাদু দিদার চোখে জল।  আবার আমি, বাবা আর মা।  প্লেনের গল্প আর নতুন করে করলাম না।  সেই এক ভাবেই অনেক কষ্ট সহ্য করে আমরা যখন আবার ফিরে এলাম তখন এখানে ঠান্ডা।  বাবার দেশে কি সুন্দর ওয়েদার ছিল।  আমাকে জ্যাকেট পড়তে হতো না , সর্দি নিয়ে হাঁসফাঁস করতে হতো না, খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতাম, গাছে পাতা ছিল , একটু ধুলো ছিল বটে , কিন্ত সব কিছু কি সুন্দর ছিল।  সবথেকে সুন্দর ছিল মানুষজন।  কত লোক ছিল আমার সাথে খেলার জন্য।  কত লোক ছিল দেখার জন্য।  যখন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাড়ির জন্য গাড়িতে চাপলাম তখন রাস্তার দুপাশ ধরে শুধু গাড়ি আর গাড়ি।  নেই অটো , নেই টোটো , নেই সাইকেল , নেই ভ্যান , নেই বাইক আছে শুধু গাড়ি গাড়ি আর গাড়ি।  


বাড়ি ফিরে প্রথমে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো।  সব চুপ চাপ।  শান্ত।  কোথাও কোনো আওয়াজ নেই।  নেই হর্নের প্যাঁ পোঁ।  কোথাও যেন কিচ্ছু নেই।  আমার পুরানো খেলনা গুলো ভুলে গেছিলাম।  আবার এক এক করে খেলনা গুলো মনে করতে লাগলাম।  আমার ঘর আমার বিছানা , আমার টিভি , আমার ব্যালকনি , আমার গাড়িগুলো সব আমার।  এটা আমার জায়গা।  আমার কাজের জায়গা।  আমার বড় হওয়ার জায়গা।  এখানেই আমায় থাকতে হবে।  আমি থাকবো। আর থাকবে বাবা আর মা।  আচ্ছা বাবা মা ও তো দাদু দিদা দাদু ঠাম্মাকে ছেড়ে চলে এসেছে।  আমার যেরকম কষ্ট হচ্ছিলো ওদেরও কি হচ্ছেনা।  আমি জানি বাবাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট।  আমি মা কে ছেড়ে এক রাত থেকে দেখেছি।  খুব কষ্ট লাগে।  আর এখন খুব কষ্ট লাগছে ।  খুব ফাঁকা লাগছে।  কিন্তু দ্যাট ওয়াস মাই ভ্যাকেশন।  পরের ভ্যাকেশন বাবা বলেছে আবার পরের পরের দূর্গা পুজোর সময়।  এবার যে সব ভুলত্রুটি করেছি।  পরের বারের আগে সব ঠিক করে নিতে হবে।  এর পরের বার গিয়ে আরো মজা করতে হবে।  অনেক অনেক মজা। আর  পরের বার সবাই কে গিয়ে বাংলায় বলতে হবে , “আমি আধ্যান - আমি আবার এসেছি। ”   

আধ্যানের ডায়েরীর আগের পাতাগুলো 


No comments:

Post a Comment