কানের
কাছে ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছে বাবা মা। ছেলে
নাকি কথা বলছে না। বলাটা
কি খুব ইম্পরট্যান্ট। লিখলেও
তো চলে। আমি যে এই হাজার হাজার পাতা নিজের
ডায়েরি লিখে চলেছি তাতে কি ? কিচ্ছু না ? এদের
কাছে শুধু ওদের ভাষায় কথা বলাটাই ইম্পরট্যান্ট। তাই অনেক দিন ডায়েরি লিখতে পারিনি। কনসেনট্রেট করছিলাম যাতে ওদের ভাষায়
কথা বলতে পারি।
ব্যাপারটা
কিন্তু বেশ জটিল। এবং
আরো জটিল আকার ধারণ করলো যখন আমার দেড় বছরের ডাক্তার ভিসিট এসে হাজির হলো। আমার ডাক্তারটা ভয়ানক দেখতে হলেও খুব
ভালো। খুব মজাদার। আর সবথেকে বেশি যা মজাদার, সেটা হলো
তার ভৌ ভৌ টা । যার
নাম চকোলেট চিপ। হার্সির
চকোলেট চিপের মতোই দেখতে। কিন্তু আমার সাইজের ডবল। আমি গেলেই ডাক্তার ওকে নিয়ে চলে আসে। আগে বেশ ভয় পেতাম। কিন্তু যখন মা একটা ডগির ছবি দেখিয়ে
বলে “ডগি কি বলে — ভৌ ভৌ ” আর বাবা সেই কুকুরের ছবিই দেখিয়ে বলে “ডগি কি বলে — উফ উফ ” তখন
ভাবলাম এ তো আমারই সমগোত্রীয়। ও
কি বলে সেটাই সবার ক্লিয়ার নয়। তাহলে
ভয় পেয়ে কি হবে। শুরু
করলাম চটকাতে।
ডগির
কথাই যখন এলো তখন একটা পুরানো দুঃখের গান গেয়ে নিই। আমার ঠেলে দেওয়ার সমস্যা নিয়ে
যখন পার্টিতে কথা ওঠে, তখন যখন সবাই বলে “ও ঠিক হয়ে যাবে।” তখন বাবা একটা ডায়ালগ
দিয়ে আমাকে অপমান করে। বলে
, “ঠিক তো হয়ে যাবে , কিন্তু একটা কথা বলো , কোনো কুকুর যদি কাউকে কামড়ে দিয়ে মেরে
ফেলে , তাহলে কুকুরের মালিক কতটা দোষী? আমার স্টেটাস এখন ওই মালিকের মতো যখন
অধ্যান কাউকে ধাক্কা দেয় আর কেউ বেকায়দায় পরে যায়। ” তাহলে ভাবো। নিজের বাবা নিজের ছেলেকে
কুকুর বলছে। ঠিক আছে
মেনেই নিলাম। আর তার
পর থেকেই চকোলেট চিপকে ভালো লেগে গেলো।
কিন্তু
সেদিন ডাক্তার আমাকে অনেক কিছু বলে টলে দেখলো যে আমি উত্তর দিই কিনা। আমি তখন চকোলেট চিপের সাথে খেলতে ব্যস্ত।
বুঝতেই পারিনি কখন আমাকে ডেকেছে। এদিকে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাবা মার
মুখ হাড়ি। ডাক্তার
বলেছে নাকি যদি আমি আর দু মাসের মধ্যে কথা বলতে না পারি তাহলে আমাকে অন্য একটা
ডাক্তারের কাছে দেখতে নিয়ে যাবে। আচ্ছা
, কথা না বলাটা কি হ্যান্ড ফুট এন্ড মাউথ এর মতো অসুস্থতা নাকি। হ্যা গত মাসে আমার
এই রোগটাই হয়েছিল। কি
ভয়ানক রোগ রে বাবা। মুখে
কি যন্তনা। মুখ
বন্ধই করতে পারছিলাম না। আর
টপ টপ করে নাল পরে যাচ্ছিলো। পরের
দিন তো আবার জ্বর চলে এলো। তখন
রাত অনেক , ডাক্তার নেই। মা
বাবার মধ্যে বেশ একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম যে এমার্জেন্সিতে যেতে হবে কি না। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়তে
ব্যাপারটা মিটে গেলো।
কিন্তু
যেটা মিটলো না, সেটা আমার কথা বলা নিয়ে। পরের
দিন দেখলাম একটা ছোট হলুদ রঙের সুটকেস এসেছে আমার জন্য। তার মধ্যে থেকে বেশ কিছু বই পত্র
বেরিয়ে এলো। আর সকাল
বিকাল শুরু হলো মা বাবার ধস্তা ধস্তি। “এটা
কি আধ্যান ? এটা ওয়াটার । এটা কোট । এটা স্পুন।” আমি পরলাম মহা ফাঁপরে। আরে বাবা , সারা বাড়িতেই তো এই
জিনিসগুলো ছড়িয়ে আছে। ওগুলো
তুলে তুলে বললেই তো হলো। ওই
বইতে কি লেখা আছে সেটা পড়িয়ে কি লাভ। আমি
তো স্পুন আর ফর্ক নিয়ে খেলতেই ভালোবাসি। কিন্তু
ওটা যে স্পুন আর ওটা যে ফর্ক সেটা তো আমি জানিনা। শুনেছিলাম চামচ আর কাঁটাচামচ। এখন থেকে এইগুলোই নাকি বলতে হবে।
চেষ্টা
প্রচুর করতে লাগলাম। কিন্ত
বিশেষ ম্যানেজ করে উঠতে পারলাম না। সবথেকে
বড় সমস্যা এগুলো চু চু টিভিতে দেখায় না। ওখানে
তো ওয়ান পটেটো, টু পটেটো থ্রি পটেটো চলতে
থাকে। এদিকে বাবা মা নাছোড়বান্দা। আর মুখ পাংশু। এদিকে ক্রিসমাসের পর থেকে মা বাবার
দুজনেরই ছুটি। আর আমার
ওপর অত্যাচার। কি
বিরক্তিকর যে দিনগুলো কেটেছে কি আর বলবো। ওই
একই জিনিস দশবার করে বলতে থাকে, যেটা আমার ভালো লাগে না। বার বার করে আমি বুঝিয়ে দিতে লাগলাম
যে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু
কে কার কথা শোনে।
আমার
একটু নম্বরের দিকে বেশি ঝোঁক। বেশ
কয়েকদিন আগেই আমি আমার প্রথম শব্দ বলেছিলাম , ‘ফো’ . সেদিন বাবা সারাদিন বলে
যাচ্ছিলো সোপ বাবলে ফু দাও , চায়ে ফু দাও , আর একটা ট্যারা ব্যাকা লেখার দিকে
আঙ্গুল দিয়ে বলছিলো ফোর। সবথেকে
মজাদার ছিল লেখাটার পাশে চারটে মাছের ছবি ছিল। আর বাবা বলছিলো , “ফোর ফিশ - গ্লুপ
,গ্লুপ ,গ্লুপ ,গ্লুপ” আর আমি হেসে ফাটিয়ে দিচ্ছিলাম। শেষে বাবা যখন হাল ছেড়ে দিলো তখন
দেখলাম আমার এন্টারটেনমেন্ট কমে যাচ্ছে। তাই
বলেই দিলাম , “ফো” ব্যাস তাতেই কাজ হয়ে গেলো। তার
পর সারাদিন শুধু ওয়ান , টু থ্রি , চলতে থাকলো।
কিন্তু
ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার আমার এফোর্টটাকে আন্ডারএস্টিমেট করে দিলো। বললো যে আমার নাকি এখন শব্দ বলার সময়
, নাম্বার না। ডাক্তার
ডাক্তার হতে পারে , কিন্তু সে কে যে আমাকে বলে দেবে কখন আমি কি বলবো। আমারো জেদ চেপে গেলো। আমিও ঠিক করলাম নাম্বার ছাড়া কিছুই
বলবো না। যখনই
টিভিতে “দেয়ার আর টেন ইন দা বেড এন্ড দা লিটিল ওয়ান সেড রোল ওভার , রোল ওভার ”
চলতে থাকে তখনিই আমি মুখ খুলতে আরম্ভ করলাম। সবাই বেশ চাপে।
আমি বেশ
মজা নিচ্ছিলাম। কিন্তু
যখন দেখলাম বাবা ঠাম্মাকে বেশ কাতর ভাবে বলছে যে আমি ওকে স্পিচ ডাক্তারের কাছে
নিয়ে যেতে চাইনা। তখন
দেখলাম নাহ। একে বছর
শেষ হয়ে আসছে। সবার মুড
খারাপ করে লাভ নেই। সেদিন
টেবিলে বসে বাবা মা খাচ্ছিলো আর আমার দিকে দুটো রুটি দেখিয়ে বললো টু । আমি তখন গড়
গড় করে বলে দিলাম , ওয়া, টুপ্ , থি , ফো , ফাই , সিক , সেয়ে , এইত , নাই , টননন।
সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো আর তার পর ভিডিওর পর ভিডিও তুলে যেতে লাগলো। আর আমি ওয়ান টু টেন বলে যেতে লাগলাম।
সবাই নিউ
ইয়ার রিসোলিউশন নিয়ে প্রচুর কথা বলছে। আমি
দেখলাম আমারও কিছু একটা শপথ তো নেওয়া উচিত। যখন
আমার কথা বলা নিয়ে সবার এতো চিন্তা। তাই
এই বছর আমার নিউ ইয়ার রিসোলিউশন হলো কথা বলা। বছর
শেষ হওয়ার আগে যদি না আমি গড় গড় করে আমার নিজের ডায়েরি সবাইকে পরে না শোনাতে পারি তাহলে আমার বাবার নাম বদলে দেবে।
এখন সবাই
বুঝলে তো , কেন এতদিন গায়েব ছিলাম। সবাইকে
হ্যাপি নিউ ইয়ার।
আধ্যান রোজ ডায়েরী লিখুক।
ReplyDelete