Thursday, September 28, 2017

আধ্যানের ডায়েরি - পুজো স্পেশাল



'ত্রাহিমাম  ত্রাহিমাম ।  মা বাঁচাও , মা , ও মা , বাঁচাও ' দুচোখে জল , ভেজা - ছেঁড়া - পোড়া কাপড় , গণেশ এসে মা দুর্গার কোলে ঝাঁপিয়ে পরে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো।  দূর্গা রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে চুল শোকানো থামিয়ে গণেশের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , ' কি হলো রে ? এরকম করে কাঁদছিস  কেন।  তুই না সিদ্ধিখোর বাপের সিদ্ধিদাতা গণেশ ?  এরকম ভিজে গেছিস কেন।  আর এই চটচটে জিনিসটা কি ? ' গণেশ তখন ফুঁপিয়েই চলেছে।  কোনো কথা বলতে পারছে না।  ওদিক থেকে লক্ষী , সরস্বতী , কার্তিকও এসে হাজির।  মহাদেব পায়ের কাছ থেকে মাথা তুলে ছিলিমে দু টান মেরে বললো , 'গনশা, সেল্ফ প্রটেকশন এর বুলি , শুধু  আওড়ালেই হয় না।  নিজেকেও কিছু করতে হয়।  মহাভারত লিখেই ক্ষান্ত হয়ে গেলি, এবার বি দা চেঞ্জ।  '

' রাখো  তোমার চেঞ্জ ' , গলা থেকে চিঁ চিঁ করে একটা বিক্ষুব্ধ আওয়াজ বেরিয়ে এলো গণেশের।  ততক্ষনে গণেশের মুখ সাদা হয়ে গেছে।  লক্ষী এসে কড়ে আঙুলের যত্নলালিত বড় নখটি দিয়ে গণেশের মুখে আঁচড় দিতে কিছুটা সাদা হাতে উঠে এলো , 'ও মা , এ  তো  মোম।  গলা মোম কে ঢেলে দিয়েছে তোর গায়ে।  নাকি পড়ে গিয়েছিলিস। '  দূর্গাও তখন হাত দিয়ে দেখে , 'ও মা তাই তো।  বাছা খুলে বল।  তোর বাবা সব জানে , কিন্তু কিছুই তো বলছে না।  ওগো গণশার হলো টা কি ? তুমিই বলে দাও না । '  ওদিকে মহিষাসুর তখন ছিলিমে নতুন গাঁজা পুরে সদ্য আগুন ধরিয়েছে।  খিক খিক করে হেঁসে বললো , 'দেখ কেমন লাগে '

গণেশ হঠাৎ রে রে করে তেড়ে এলো মহিষাসুরের দিকে , 'তুই ব্যাটা সব নষ্টের গোড়া।  ওটা মনে হয় তোরই অবতার। ' 'মা কালির দিব্যি বলছি , আমার অবতার নয়। আমার অবতাররা এখন সিরিয়াতে আছে।  এটা কেষ্টর অবতার। '  দূর্গা হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো গণেশকে , 'খুলে বল বাপ।  কার কথা বলছিস। ' গণেশ আবার শান্ত হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো , 'মা আমায় বাঁচাও।  আগের বছর পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ছিল।  কিন্তু আজ সেই আধ্যান বড় হয়ে গেছে। আর সেই কিউটনেস ওভারলোডেড নেই।  এখন নৃশংস হয়ে উঠেছে। এই হাল করেছে আমার।  রোজই করছে।  আমি কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছি না। '

এইবার সবাই নড়ে চড়ে উঠলো শুধু শিব ছাড়া।  মহিষাসুরের বাড়িয়ে দেওয়া গাঁজার কল্কেটা তে প্রথম সুখটান দিয়ে বলল , 'বলে যা , সবাই শুনুক' গণেশ বলে চললো , ' সেই মহালয়া থেকে শুরু
করেছে।  ঘুম থেকে বাবা মার আগে উঠে পরে।  আর উঠেই আমার ওপর এটাক।  প্রথম প্রথম চুষে রেখে দিতো।  কিছু বলতাম না।  শিশু , আমাদেরই জাতভাই।  কিন্তু রোজ সকালে এইভাবে কারোর মুখের লালা মাখতে কার ভালো লাগে।  কিন্তু পরশু দিন সোজা আমাকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো বাথরুমে।  এদিক ওদিক ধাক্কা ফাক্কা খেয়ে উল্টে পাল্টে পড়লাম গিয়ে কমোটের কাছে।  ভাগ্যিস ওর বাবা এসে তুলে নিয়ে গেল।  কিন্তু সে কি ছাড়ার পাত্র।  পরেরদিন হাতে করে নিয়ে এসে কমোটের জলে চোবানোর ব্যবস্থা করেছিলো।  এবার ওর মা বাঁচিয়ে নিলো।  যখন পর পর দু দিন কার্য সিদ্ধি হলো না।  তখন আজকে যেই ওর মা পুজো সেরে উঠেছে সোজা আমায় তুলে জ্বলন্ত মোমবাতির গলা মোমের ওপর ফেলে দিলো।  দেখো কাপড়টাও পুড়ে গেছে।  দেখো, দেখো , এই দেখো। ' গণেশ সোজা দাঁড়িয়ে ছেঁড়া ধুতির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।  এতটা পুড়ে গেছে যে গণেশের জকির জাঙ্গিয়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। 

মাতৃসুলভ মিষ্টি হাসি নিয়ে মা দূর্গা কিছু বলার আগেই কার্তিক একটা হাড় জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো , ' কিন্তু ভাই , ওই ছোট ছোট হাতে তোকে ধরলো কি করে। '  'আমি চাবির রিঙে ছিলাম।  সেখান থেকে আমাকে বেদিতে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে। ' সরস্বতী আরো ফিচেল , ' কি? চাবির রিঙে !! তোর শেষ মেশ এই অবস্থা দাদা। ' গণেশ বুঝলো ভুল দিকে ঘুরে যাচ্ছে ব্যাপারটা , ' না , মানে , ইয়ে।  মানে লোকে মনে করে আমার কাছে চাবি থাকলে ঘর সুরক্ষিত থাকবে তাই আর কি। ' 'কিন্তু তোকে তো খুলে রেখে দিয়েছে।  তার মানে তোর আর দরকার নেই।' কার্তিকের ঠোঁট উল্টে এই কমেন্টে গণেশ ক্ষেপে আগুন, 'দেখ কাতু , তুই টেকনিক্যালি ইনভিসিবল।  খুব একটা পুজো টুজো পাস না।  মায়ের সাথে সেঁটে বসে থাকিস বলে ফুললি প্রটেক্টেড।  আমার ব্যাপারটা সেরকম নয়।  আমাকের ইন্ডিভিজুয়ালি একট করতে হয়।  লোকে আমায় ভয় আর শ্রদ্ধা করে। 'হ্যা কমোটে চুবিয়ে। ' গণেশ এবার বিপাকে , 'মা দেখোনা , দাদা বলছে। '

'এই কাতু তুই চুপ কর আমি ব্যাপারটা দেখছি। '  ' মা শুধু দেখলে হবে না।  কিছু করো। হয় ওকে বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে বড় করে আমাকে ভয় পাওয়াতে শেখাও নয় আমাকে টেম্পোরারি অন্য কোনো জায়গায় ট্রান্সফার করো। ' 'কিন্তু বাবা , ওর তো এখন বাল্যকাল।  এখন তো এসব করবেই।  আমার সাথেও তো করে।  সেদিন একটা ঢাক পেটানোর লাঠি নিয়ে এসে আমার মাথায় এমন মেরেছে যে সারাদিন স্যারিডন খেয়ে থাকতে হয়েছে।  এই পুজোতে তো ফুলও পাচ্ছি না।  চিবিয়ে রেখেছে দিচ্ছে।  এঁটো ফুল আবার আমি একসেপ্ট করিনা। প্রদীপের জায়গায় এখন মোমবাতি জ্বালায় আধ্যানের জ্বালায়।  সেটা ও কে।  কিন্তু সেই পোড়া মোমবাতির সলতে চিবিয়ে রেখে দেয় আর কেউ জানতেও পারেনা।  আমি তো জানি , কারণ আমাকেই উৎসর্গ করা। জগন্নাথ কদিন আগেই কমপ্লেন করেছে , ওর হেলান দেওয়া স্ট্যান্ডটা ভেঙে দিয়েছিলো।  প্রায় ষোলো ঘন্টা মুখ থুবড়ে পড়েছিল।  হাত নেই তাই ওঠার ক্ষমতাও নেই।  শেষে আধ্যানের মা এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।  সবই দেখছি ,  কিন্তু কি করবো বল।  ওটা শিশু ভোলানাথ।'

'বাহ্ বাহ্।  আমার অবতার বানিয়ে দিলে ওই পোটেনশিয়াল ক্রিমিনাল মাইন্ড কে।  মানছি আমি ধ্বংসের দেবতা, তবে আমি ওসবে নেই। ওরকম অবতার ছাড়লে আমার সুনামে চোনা পরে যাবে।  কি ডেঞ্জারাস মাইরি।  আমার লিঙ্গ ধরে এমন আছাড় মারলো যে দু ফাঁক।  কত কষ্টে স্টিলপ্লেটিং করে বসে আছি।  আমি এসবে নেই।  ওই ছেলে যখন বুড়ো হবে , দেন আই উইল টেক কেয়ার।  মহিশাসুর পারবি ওটাকে কন্ট্রোল করতে। ' মহিশাসুর সুযোগসন্ধানী , 'আমার এই ফি বছর খোঁচার ঘা থেকে ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে কি?' 'না , ওটাই মেন্ সেলিং ফ্যাক্টর। অন্য কিছু চা। '  'তাহলে আর আমি কেন এতো রিস্ক নেবো।  মনস্টার টয় গুলোকে যেভাবে ছুড়ে ফেলে, তোমরা তো কেউ দেখোনি।  তোমরা কমোটে চোবানোর ভয়ে সিঁটিয়ে আছো। আমার টোটাল এক্সিস্টেন্সকে  সে একবার মারে একবার চোবায় , এই ভাবে দিন চলে যায়। ওই লক্ষীই সামলাবে ওকে।  ও তো সবার বাড়িতে লক্ষ্মীশ্রী এনে দেয়।  ওর কাছে ব্যাপারটা ইসি। '

লক্ষী বসে বসে ধানের শীষ চেবাচ্ছিল , ধড়মর করে উঠে বসলো , 'হোয়াই মি।  আমি কি কমপ্লেন করেছি।  আমার মনেও দুঃখ আছে।  আমিও অত্যাচারিত , জর্জরিত , নিপীড়িত ...' গলা আটকে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো লক্ষী।  দূর্গা তার চতুর্থ হাত বাড়িয়ে লক্ষীর মাথায় হাত রেখে বললো , 'বল মা , তুইও বল।  বুঝতে পারছি খুব কষ্টে আছিস। ' কাঁদতে কাঁদতে নাক দিয়ে সর্দি বেরিয়ে এলো লক্ষীর।  দূর্গা ষষ্ঠ হাতের কুঠার সরিয়ে একটা কাপড় তুলে নাক মুছিয়ে দিতে লক্ষী বললো , ' মা , ওই বাড়িটাতে সত্যিই আমি বিরাজ করতাম। ঝকঝকে তকতকে সব কিছু ছিল।  কি সুন্দর সুন্দর সব ডিভাইস।  সব কিছু জায়গায় জায়গায় সাজানো থাকতো।  আর এখন সারা কার্পেট জুড়ে ভাতের দানা।  আধ্যান কিন্তু খাবে না, শুধু ছড়াবে।  আর সেটা পরে মাড়াবে।  সেটা পরে শুকোবে।  সেটাই আবার খাবে।  পায়খানার রোল খাবার টেবিলে , রাস্তার জুতো স্টোভটপে , ছাড়া ডাইপার বিছানায় এমনকি একটা বিছানায় তো সে নিজের বাথরুম বানিয়ে ফেলেছে।  ডাইপার ছাড়ালেই সুসু করে দেয়।  আমার পাঁচালি চিবিয়ে চিবিয়ে ,জল ঢেলে , নাল ফেলে একটা ঢোল বানিয়ে দিয়েছে।  ওর মা পড়াও বন্ধ করে দিয়েছে।  সারাদিন এখানকার জিনিস ওখান করছে। নিজের বাবা মার মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয় নিজের গু চটকে।  আমার গা ঘুলিয়ে ওঠে।  তার উপর চিৎকার।  কান পাতা দায়।  সরস্বতী তো এটলিস্ট ওর বিদ্যা বুদ্ধি বাড়িয়ে দিতে পারে।  তবেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।  আমি কেন ? আমি মেন্টালি ওই বাড়িটা অনেক আগেই ভ্যাকেট করে দিয়েছি। '

'আমি জানতাম সব কিছু ঘুরে ফিরে শেষেমেশ আধ্যানের বিদ্যা বুদ্ধির ওপরেই আসবে আর আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া হবে।' গম্ভীর গলায় সরস্বতী বলে চললো , ' আমি চেষ্টা অনেক করেছি।  কিন্তু ব্যাটার এখনো কনসোনেন্ট এ ইন্টারেস্ট নেই।  শুধু এ , ই , আই আর  ও।  যেহেতু নিজেকে ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয়না , তাই  ইউ ও বলে না।  কি যে ভাবে কে জানে।  লার্নিং হবে কি করে, যদি ওর কাছে প্রিয় গায়ক শাকিরা হয়।  হিপ্স ডোন্ট লাই , এটা থেকে কি শিক্ষা পাচ্ছে।  টিভি ছাড়া খাবে না।  আর টিভিতে ঠিকঠাক নার্সারি রাইমও শুনবে না।  উত্তেজক জিনি ইন দা বটল শুনে হি হি করে হাঁসবে।  যখন পেটে ছিল তখন মিউসিক ভালোবাসতো , আমার শান্তি ছিল।  যে বাচ্চারা মিউসিক শোনে , তাদের শেখানো খুব একটা কঠিন হয়না।   কিন্তু এ যেহারে ওর মিউজিক্যাল খেলনা গুলোকে পেটায় , তাতে শুধু কুস্তি শেখানো ছাড়া আর কিছু শেখানো যাবে না।  আমি হাত তুলে দিয়েছি বাবা।  সবাইকে শেখানো যায় কিন্তু এ একটা এক্সট্রিম এঁড়ে মানুষ।  মা , কন্ট্রোল ইট।  তোমাকেই বলে না , সৃষ্টি স্থিতি বিনাশায় শক্তিভুতে সনাতনী , গুণাশ্রয়ে গুণময়ে , নারায়ণী নমস্তুতে।  ইউ টেক কেয়ার।  আমার দ্বারা হচ্ছে  না। '

গণেশ জুলজুল করে সবার দিকে তাকিয়ে আছে।  সবার কথা শুনে সে বেশ লজ্জিত।  সবাই নিজের কষ্ট কিভাবে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে।  সেই শুধু কমপ্লেনিং।  চিন্তিত দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে গণেশ বললো, 'মা , একি বাল্মীকি কেস নাকি?' . দূর্গাও ব্যাপারটা সেই এঙ্গেলেই চিন্তা করছিলো।  অনেক ভেবে নাম দিয়েছিলো আধ্যান।  কিন্তু এ তো রত্নাকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।  অলরেডি নাম যেহেতু আধ্যান  দেওয়া হয়ে গেছে , তাহলে ভবিতব্য তো ব্রম্ভা লিখেই গেছে।  মাথা ঘুরিয়ে স্বরস্বতী কে প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দিতে স্বরস্বতী বললো , ' আমার সাথে ব্রম্ভার কয়েকদিন ধরে আড়ি চলছে।  চার মাথা দিয়ে চারপাশে ঝাড়ি মারে।  আমি খোঁজ নিতে পারবো না। '  'দেখ মা , আমাদের জানাটা খুব দরকারি।  এ ছেলে যদি রত্নাকরের মতো বড় হয়ে  বাল্মীকি হয়ে যায় , দেন ইট ইস ফাইন।  কিন্তু না হয়ে যদি রাবনের মতো পলিটিকাল দস্যু তৈরী হয় তাহলে আবার অকাল বোধনের টাইম পাল্টে যাবে।  অলরেডি বছরে দু দুবার এই নোংরা গঙ্গা জলে ভাসতে আমার চুলের বারোটা বেজে গেছে।  আর একটা অকাল বোধন হলে মুশকিল হয়ে যাবে।  তুই একটু ম্যানেজ করে দে মা।  হাজার হোক স্বামী তো। '


'আচ্ছা দেখছি দেখছি।  তবে , গণেশ দাদা এখনকার মতো ইতি টানো।  সবাই সহ্য করছি , তুমিও করো।  এখন সারা বছরের রসদ সংগ্রহ করার সময়।  ওই পুঁচকে আধ্যান কাঠপিঁপড়ের মতো  আটখানা দাঁত বার করে কামড়াতে পাড়বে বটে কিন্তু আমাদের উৎখাত করতে পারবে না।  লেটস এনজয় দা পার্টি।  তারপর ব্যাপারটা নিয়ে দেখা যাবে। '  সবাই চুপচাপ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে দেখে দুর্গার মনে হলো মুড চেঞ্জ করা দরকার।  একটা মুচকি হেসে বললো ,  ' যাই বলো আধ্যান কিন্তু গণশার মতোই কিউট এন্ড এডরেবল।  তাইজন্যেই গণশার পেছনে পড়েছে। '   ব্যাস , সবাই একমত।  লক্ষী সরস্বতী শুরু হয়ে গেলো তাদের নারীসুলভ "কিউটনেস এডিকশান" মার্কা ভাষণ দিতে।  আর গণেশ বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে বসে বসে ভাবতে থাকলো , বাল গণেশ আর আধ্যানের মধ্যে মিল গুলো।    

আধ্যানের ডায়েরির আগের পাতাগুলো 

Saturday, September 9, 2017

3) ছেলেটা আসছে


ভোর ছটা, ঘুম ভেঙ্গে গেল বিপাশার দিনের প্রথম আলো ঘরে এসে পরছে অর্ধেক ঘর এখনো অন্ধকার মোবাইলের এলার্মটা বাজতে এখনো আধ ঘন্টা বাকি পাশে এখনও ঘুমিয়ে আছে প্রতীপ ওর কোনো টেনশন জীবনে হয়নি ছেলে আসছে বিপাশার বড় ছেলে এখন সে আকাশে উড়ছে অনেক দূর ফ্লাইট অর্ধেক গোলার্ধ পেরিয়ে আসছে গত বছর এই সময়েই উধাও হয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স এর প্লেনটা অত বড় আটলান্টিক পেরোনো কি চাড্ডিখানি ব্যাপার ছেলে বলেছিল পুরোটা সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসে না  নর্থ পোল দিয়ে নাকি ঘুরে আসে  তাই আবার হয় নাকি হলেও তাতেই বা রিস্ক কম কি  বরফ তো পাথরের মত  জলে নামলে তাও বাঁচার চান্স আছে  আছে কি? অত বড় সমুদ্রের মাঝে নামলে না এপারে যেতে পারবে না ওপারে সাঁতার কাটতে পারে বটে  কিন্তু বউ তো পারে না  হয়ত এমন ধরপাকড় করবে যে দুজনেই ডুবে মরবে ছেলেটার আবার একটু বেশি আদিখ্যেতা আছে বউ নিয়ে টাইটানিক সিনেমার মত নিজে মরে বৌকে বাঁচাবে কত করে শিখিয়েছে আপনি মরলে বাপের নাম  কিন্তু বাপ আর বউ তো আর এক নয় 

বিপাশা কখনো প্লেনে চড়েনি সারা জীবন ট্রেন জেনারেল থেকে স্লীপার ক্লাস থেকে AC Three Tier থেকে AC Two Tier. ধীরে ধীরে উত্থান হয়েছে বটে. কিন্তু পুরীও যাওয়া হয়নি প্লেনে প্রতীপের আক্রোফোবিয়া বিপাশার প্লেনে চড়ার শখের ঘ্যান ঘ্যান সামলাতে ট্রেনে আরো ভালো , আরো ভালো , আরো ভালো ব্যবস্থার পেছনে পয়সা ঢেলেছে প্রতীপ এয়ারপোর্ট এর সাথে যোগাযোগ শুধু ছাড়তে যাওয়া আর নিয়ে আসার বন্ধু বান্ধবের থেকে শুনে শুনে , কিছুটা ছেঁটে কিছুটা কেটে একটা মোটামুটি ছবি দাড়  করিয়েছে বিপাশা কিছুটা ভয়াবহ, কিন্তু মেঘ যখন নিচে দেখা যায় তখন মন টা নাকি খুশি হয়ে যায় তার ওপর ছোটছেলে দুদিন আগেই একটা ভিডিও দেখিয়েছে প্লেনের চাকাটা গেছে খারাপ হয়ে  সবাই বাহবা দিচ্ছে পাইলটের ; সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য ভেতরে যারা ছিল তাদের কি অবস্থা হয়েছিল ভাবো

বিপাশা আর ভাবতে পারে না  "এই শুনছো ! এবার ওঠো" প্রতীপ কে ঝাঁকিয়ে তুলে দেয় বিপাশা প্রতীপ এখনো বালিশের নিচে ঘড়ি রেখে শোয়  মোবাইল ব্যবহার করে না কুড়ি বছর পিছিয়ে আছে  চোখ কুঁচকে ঘড়ি দেখে বিপাশার দিকে ফিরে বলে, "কি হলো ! এখনো তো রাত বাকি?" প্রতীপ retire করার পর থেকে আর সকালে উঠতে পারে না  ঘুম ভেঙ্গে বিপাশাকে বসে থাকতে দেখে সেও উঠে বসে  বিপাশার থমথমে মুখ দেখে বলে , "কি হলো  বল tension হচ্ছে?" বিপাশা কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, 'যদি প্লেন নামতে গিয়ে ভেঙ্গে পরে.. দূর্গা দূর্গা" "ওহ এই ব্যাপার" প্রতীপ আবার বালিশে মাথা দিয়ে বলে, "আরেকটা তো আছে" প্রতীপের জন্ম হয়েছে লোকেদের পেছনে লাগার জন্য  কিন্তু মাঝে মাঝে সীমাটা অতিক্রম করে যায়  আর বদলে ঝাড় খায় 

"কি বলতে চাও কি তুমি?" ক্ষিপ্র বাঘিনীর মত বিপাশা চিত্কার করে ওঠে, "সকাল বেলা কি সব অলুক্ষণে কথাপ্রতীপ চোখ না খুলেই বলে ," অলুক্ষণে কথা বলছে কে ? আমি তো সল্যুশন দিচ্ছিলাম" বিপাশা থতমত খেয়ে যায়  শেষ দু মিনিট rewind করে লজ্জা পায়  না তার এসব ভাবা ঠিক নয়  নেগেটিভ লোকরা বলে হামেশাই তো প্লেন দুর্ঘটনা ঘটছে আর পসিটিভরা বলে রোজ হাজার হাজার প্লেন ওঠানামা করছে হায়রে রবীন্দ্রনাথ আর কোনো কথা তোমার মাথায় এলো না, প্রিয়জনের অনিষ্ট চিন্তা করাটা এখন মনে হয় তুমিই শিখিয়েছ "ধুর" বলে উঠে পড়ল বিপাশা 

ছেলেটা সেই কবে গেছে আমেরিকা বিয়ে করেই পগার পার ছেলেদের বিয়ে দিলে পর হয়ে যায়  তাবলে এইরকম  পাঁচ বছরে একবারের জন্যেও এলো না  বলতে গেলে বলে ফেঁসে গেছি আসতে পারছি না কেন ফেঁসে গেছিস? বোঝাতে চায়  কিন্তু বিপাশা বা প্রতীপ বিশেষ কিছুই বুঝতে পারে না  এইত বলে অফিসে নাকি ওর খুব নাম ডাক  এতই যদি নামডাক থাকে তাহলে ছুটি পাওয়া তো দু মিনিটের ব্যাপার একদিন ঘন্টাখানেক বাবার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে বলতে শেষমেষ প্রতীপ  বলল, "তার মানে তুমি পিচ্ ছাড়তে চাইছ না  তাই তো ?" ওদিক থেকে হ্যা বাচক শব্দ শোনার পর থেকে বিপাশার ঘ্যান ঘ্যানের বিশেষ পাত্তা দেন না প্রতীপ খুব বিরক্ত করলে বলে, "যা করছে ঠিক করছে"

ভিসা নিয়েও ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে দিন রাত শুধু এই ভিসা শেষ হয়ে যাছে , ওই ভিসায় পাল্টে যাচ্ছে দু বছর আগে বিপাশা খুশি হয়ে গেছিল যখন শুনলো ছেলের ভিসা শেষ হয়ে যাচ্ছে ফিরে আসছে ছেলে সে বছরও তেলতেলে গোফ দেখেও কাঁঠাল আর পাকলো না  বিপাশা একদিন নিজেই বলল , "আচ্ছা তুই আমাকে আগাপাস্তলা বলতে পারবি ভিসার এত কিসের ঢং." ছেলে হাসতে হাসতে বলেছিল, "তাহলে শোনো, সময় আছে তো" বিপাশা এক মনে শুনে যাচ্ছিল মানে বয়ে যাচ্ছিল একের পর এক নদী দিয়ে একবার এল ওয়ান একবার এইচ ওয়ান, কখনো বি কখনো কখনো আবার dependent ভিসা , ওয়ার্কিং ভিসা শুনতে শুনতে শেষমেষ বলল, "তার মানে তুই যা করছিস ঠিক করছিস তো?" ওদিক থেকে হ্যাবাচক শব্দ শুনে বিপাশার ঘ্যান ঘ্যান একেবারেই কমে গেছে 

এত জটিলতা তার পোষায় না  আজকালকার ছেলেরা যে পরিমান চাপ নেয় এইটুকু বয়সে তাতে ব্লাড প্রেসার সুগার এসব তো হবেই তার ওপরে বিপাশার শশুর বাড়ি তো এসব রোগের ঢিপি ঘুরে ঘুরে সমস্ত ঠাকুরের ছবির কাছে মাথা ঠুকে চা বানাতে যায় বিপাশা  ছেলে এতদিন বিদেশে থেকেও কফির থেকে চায়ের প্রতিই বেশি টান হবে না কেন  এই বাংলার চা তো সবথেকে বেস্ট ওরা ওখানেও তো দার্জিলিং চাই খায়  যদিও এখানে অনেক সস্তা, আর চায়ের ব্লেন্ডিংটাই আসল শিল্প সেটা তো এখানে দোকানে দোকানে আলাদা প্যাকেট করা তাজমহল আর ব্রুক বন্ড কি আর সে স্বাদ দিতে পারে! ওদের সবই Crush, tear এন্ড curl. মানে CTC চা. পাতা চা বলতে একহাত লম্বা লম্বা চা পাতা শুকিয়ে দিয়ে দেয়  বিপাশা শুনেছে সেই চা নাকি সবথেকে উত্কৃষ্ট কিন্তু মন মানে না 

ওদের আসতে আসতে রাত দশটা বাজবে কতদিন পরে তাদের দেখবে আনমনে হেসে ওঠে বিপাশা সেই ছোট্ট বাবু আজ বিদেশ থেকে পাঁচ বছর পরে বউ নিয়ে ঘরে আসছে আবার বউ তিন মাসের অন্তঃসত্বা সব খুশি যেন এক সাথে ঠাকুমা হতে চলেছে বিপাশা  একটু চিন্তাতেও আছে  প্রথম চার মাস সাবধানে থাকতে বলে  এরা সব আধুনিক এবং আধুনিকা বলতে গেলেই বলে ডাক্তার গ্রীন সিগনাল দিয়েছে তবেই না টিকিট কেটেছি বছর পাঁচ পরে বাচ্চা হলে তো আর হঠাত ভুল করে হয়না  তা এরকম প্ল্যানই বা করেছে কেন  তার থেকে ঘুরে গিয়ে  বাচ্চা নিলেই হত দেরী যখন হয়েইছে আরেকটু হলে ক্ষতি কি?

বছর দেড়েক আগে যখন বিপাশা আর থাকতে পারছিল না  সাথে নিউমনিয়া হয়  তখন বিপাশা ভেবেছিল আর ছেলের সাথে দেখা হবে না  ছেলেকে জানালে ছেলে উড়িয়ে দিল  এই যুগে কেউ নিউমোনিয়ায় মরে না ছেলে বলেছিল ওদের ওখানে ঘুরে যেতে  সেই প্রথম প্রতীপ  একটু নড়ে চড়ে বসেছিল হুটোপাটা করে পাসপোর্ট এর ব্যবস্থা করতে লেগেছিল ছেলে যেদিন থেকে আমেরিকা যায় বিপাশা পেছনে লেগেছিল প্রতিপের কোনো ইচ্ছা ছিল না প্রতিপের বিদেশ যাওয়ার বেশি খোঁচালেই বলত , "আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন , এই দেশেতেই মরি" উত্তরে বিপাশা বলত, "গাছ কোথাকার" প্রতীপ  কিন্তু সেবার একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল লোকে বলে ভাগ্যবানের বউ মরে  কিন্তু কথাটা ষাটোর্ধ পুরুষের জন্য বিশেষ খাটেনা তাই পাসপোর্ট-এর জন্য ভয়ংকর ছোটাছুটি করেছিল কিন্তু বিধি বাম  পুরো একটা বছর লেগে গেল পুলিশ verification আর birth place verification  নিয়ে চার পাঁচ মাস আগে যখন শেষমেষ পাসপোর্ট হাতে পেল তখন ছেলে বলল, "যাও এবার একটু বাংলাদেশে ঘুরে এসো , আমরা আসছি"

কত চোখের জল ফেলেছে বিপাশা গোপনে  ঠাকুরের কাছে কতবার চেয়েছে ছেলে একটু যেন ছুটি পাক  যে ছেলেকে কখনো চোখহারা করেনি বিপাশা সেই ছেলেকে ছেড়ে কি ভাবে বছর কাটিয়েছে সেই জানে  ছেলের প্রচুর অভিযোগ ছিল কলেজের সময়  বিপাশা কিছুতেই ওকে বন্ধুদের সাথে দীঘা , মন্দারমণি, বকখালি যেতে দেয়নি  মারামারি কাটাকাটি হয়ে যেত বাড়িতে প্রতিপের কোনো কিছুতেই না নেই  হাত তুলে নিতাই বিপাশা যদিও শুনেছিল মা কে না বলে শান্তিনিকেতন ঘুরে এসেছে হোস্টেলের বন্ধুরা মিলে কি বদ  নাগারে তিন দিন মিথ্যা বলে গিয়েছিল বিপাশা ধরতেই পারেনি এখন এমন গের ফস্কেছে আর ধরা দেওয়ার নাম নেই  মাঝে মাঝে ছেলের কাছে জিগ্গেস করেছে, "হ্যা রে তোর্ মা বাবা কে দেখতে ইচ্ছা করে না" কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে উত্তর দিয়েছে, "মা  আমি যেমন তোমার ছেলে তেমন তো কারো বাবা হব তাদের কথাও তো ভাবতে হবে  এখনও তোমরা ভেজিটেবল হয়ে যাওনি যখন হবে তখন দেখবে আমি ঠিক আছি" কথাটা খুব লেগেছিল কিন্তু কথাটা সত্য বই মিথ্যা নয় 

কাল থেকে ফোন এসে চলেছে অবিশ্রান্ত সবাই খোঁজ নিচ্ছে না , ছেলের খবর নয় বিপাশা ঠিক আছে কিনা  নিউমোনিয়ার পর থেকে শরীরটা বেশ ভঙ্গুর হয়ে গেছে একটুতেই রোগ যোগ এসে সুরসুরি দেয়  সবার ধারণা এতদিন পরে ছেলেকে দেখে হার্টএটাক করবে বুড়ি খুশির চোটে হার্ট এটাক করার নজির এখন অনেক পাওয়া গেছে  যেমন হাসি কান্নার মুখভঙ্গি সমান তেমনি নাকি হৃৎপিণ্ডও হাসি আর কান্নাকে সমান ভাবে নেয়। তাই খুশির চোটে মৃত্যুও ঘটতে পারে। বিপাশা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেও কালকে প্রতীপ একটা আর্টিকেল নিয়ে এসে পরিয়েছে। তার পরে একটু হলেও মাথার মধ্যে খছ খছ করছে বিপাশার।
ছোটো ছেলে ফোন করে বলল, “আর তো তোমার কোনও চিন্তা নেই। তোমার চোখের মনি চলে আসছে। বেঁচে থেকো যেন।” মেজোবোন ফোন করে বলল, “তুই বরঞ্চ ওকে রিসিভ করতে জাস না। উত্তেজনা কম হবে।” ভাসুর ফোন করেছিল, “আমরা কি যাবো সঙ্গে? পারবে তো?” আর প্রতীপ, “চিনি, চা পাতা আর সস্প্যান টা কিন্তু যাওয়ার আগে দেখিয়ে দিয়ে যেও
যত সময় এগিয়ে আসছে তত ধরফরানি বারছে বিপাশার। বউ বলে দিয়েছে অনেক দূর জারনি করে আসছে , খাওয়া দাওয়ার এলাহি ব্যাবস্তা যেন না করা হয়। ঝোল ঝোল পোস্তো আর ভাত। এক তরকারি ভাত দেওয়া নিয়ে অক্ষুনতা প্রকাশ করায় ছেলে বলল, “তাহলে না হয় দুটো মাছ ভাজা করে দিয়ো।” সেই তো , ছেলেটা মাছ খেতে এতো ভালোবাসে। বউয়ের সব জিনিসে বেশি বেশি। আলু কাটতে কাটতে বিপাশার চোখে ছেলের বিয়ের ছবি গুলো ভেসে ওঠে। লম্বা , ছিপছিপে , চাবুকের মত। বিয়ের ঠিক আগে আগে একটা ছোট্ট সোহাগ ভুরি এসেছিল বটে তবে মানিয়ে গিয়েছিল বেশ। আমেরিকা গিয়ে খুব মোটা হয়ে গেছিল শুনেছিলছবিগুলো যা সব পাঠাতো পুরো কুমড়োপটাশ। বলছিল তো অনেক ঝরিয়েছে রোজ সকালে লাউয়ের জুস খেয়ে দৌড়াতে যায়। পারেও বটে। মাংশ না খেলেই পারে। সাথে নিশ্চয়ই ঢুকু ঢুকু চলে।

এতদিন ছেলেটা বাইরে আছে হোস্টেলেও ছিল বেশ কদিন, একটা জিনিস কিন্ত মানতে হবে। কখনও একটা ফোনের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়নি বিপাশা কে। প্রত্যেক দিন প্রায় আধ ঘণ্টা করে কথা বলেছে সে। যখন ওদের দিন তখন এখানে রাত্রি। ছেলে তাই সকালে উঠে চা খেতে খেতে ফোন করত। কালকেও করেছিল। কাল যদিও অনেকটাই সংক্ষেপে কিন্তু করেছিল। নিত্য কি করছে না করছে কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে মোটামুটি ছবি পেয়ে যেত বিপাশা । অর্ধেক বুঝতে পারত না বটে। কিন্তু বেশ লাগত শুনতে। আজ নায়াগ্রা যাচ্ছে , কাল ডিসনি , পরশু স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। কত জায়গায় ঘুরেছেকত জায়গায় ঘুরেছে। বেশ গর্ব করে বলে, “ফ্রম আটলান্টিক টু প্যাসিফিক”। ছেলের চোখ দিয়ে গোটা আমেরিকা ঘোরা হয়ে গেছে তার।
ছেলে মাঝে মাঝে অভিমান করত, “পৃথিবী কোথা থেকে কোথায় চলে গেছে। আর তুমি একটু ভিডিও চ্যাট করতে পারো না।” ছোটো ছেলের পেছনে লেগে লেগে শেষে স্মার্টফোন ব্যাবহার করা শিখেছে বিপাশা। কম্পিউটারে বসে ভিডিও চ্যাট করা তার পোষায়নি। শেষ বছর দুই থেকে এখন প্রত্যেক সপ্তাহে সপ্তাহে চ্যাট হয়। সামনা সামনি দেখতে পায় ছেলেকে। ছেলের ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, বাইরে বরফ পরছে, চেরি ব্লসম, ওভেনে গ্রিল সালমন আরও কত কি। আগে যেমন মন কেঁদে কেঁদে উঠত,  থেকে থেকে এখন ততটা করে না। কিন্তু তাও যান্ত্রিক, সবসময় যান্ত্রিক। একটু ছুঁয়ে দেখব সেটাই সবথেকে বড় নেশার ব্যাপার। ওইটুকু স্ক্রীনে কি বা বোঝা যায়। বললেই বলে, “ভাবোতো মা। যদি ইন্টারনেট না থাকত, কম্পিউটার না থাকত তাহলে মাসে একবার চিঠি লিখতাম। সেটা দু মাস পরে পৌঁছাত আর দু বছর পর আমায় দেখতে পেতে।” তাই ঘোলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বিপাশা।

ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়ে গেছে। বুক করা গাড়ি এসে পরবে এবার। প্রতীপ এসে বলল, “ঠিক আছো তো?” বিপাশা বেশ কিছুক্ষন ধরে চুপ মেরে গেছে। খুশী আনন্দ উল্লাসের সাথে অনেক অভিমানও এসে মাথা চাড়া দিচ্ছে। খেলো অভিমান। দেখলে কথা বলব না। যখন বাবু হল, তখন থেকে সমস্ত চিন্তা ভাবনা তার প্রতি আবদ্ধ করেছে সে। কখনও নিজের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। এক মাথা লম্বা চুল ছিল। ছেলের জন্য সব কেটে দিতে হল। ছেলে পড়ছে, তার জন্য টিভি দেখা বন্ধ। সিনেমা দেখার পোকা মাথা থেকে লাইসিল দিয়ে নামান হল। ছেলের আবদার বায়নার জন্য সমস্ত শখ আহ্লাদ শিকেয় তুলে বসে থাকল। অথছ ছেলে নিজের পাখায় জোর পেতেই উড়ে গেল। আর ফিরে আসার নাম করে না। বলে তোমরা চলে এস। কেন আসব। আমরা তো বলিনি তুই নিজে বড় হ। বিয়েই কাল হয়েছে। একটু দেখে মেয়ে আনলে ঠিক হত। তা না , কোথা থেকে এক মেয়ে প্রেম করে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়েপিরিতি দেখলে গা জ্বলে যায়। ঐ মেয়েই ওকে আসতে দেয়নি। কিন্তু হাজার হোক এখন ওর ওপর রাগ করার কোনও মানে হয় না। এই সময় ওর সঙ্গে কেউ থাকলে কত ভালো হয়। তা না , আবার বউকে ট্যাঁকে গুঁজে ছুটবে আমেরিকা। কি জানি কি আছে এই ডলারে।

গাড়ি যখন বালি ব্রিজ পার হচ্ছে তখন দূর থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির দেখতে পেয়ে কপালে হাত ঠেকাল বিপাশা। একটু আগেই খবর পেয়েছে যে ওরা নেমে গেছে। প্লেন সময়ের আগে এসে পৌঁছে গেছে। যদিও ইম্মিগ্রেশন চেক করতে এখনও ঘণ্টা খানেক লাগবে। তার আগেই পৌঁছে যাবে বিপাশারা। যখন থেকে গাড়ি ছেড়েছে, বিপাশা এক মনে কিছু একটা চিন্তা করে যাচ্ছে। একদম চুপ। প্রতীপ ওকে চ্যাটার বক্স বলে। কিন্তু এখন মুখে একটা রা নেই। প্রতীপ তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষন তারপর ছেড়ে দিয়েছে। বুঝতে পেরেছে অনেক কিছু চলছে বিপাশার মনে। বিপাশা এখন রোলার কোস্টার রাইড করছে ।
ছেলে চিনতে পারবে তো।রিয়ার ভিউ কাঁচে মুখটা দেখে নিজেকেই নিজে চিনতে পারল না বিপাশা। পাঁচ বছরে যেন পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। বেশ বুড়ি বুড়ি লাগছে। সামনের দিকের চুলগুলো পাঁচ বছর আগেও পাকেনি । অনেক ঝড় চলে গেছে শরীরের ওপর দিয়ে, মনের ওপর দিয়ে। কপালের ভাঁজ গুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে। মুখের সেই উজ্বল আভাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু মা তো মা ই হয়। দেখা দিয়ে কি আর হবে। ছেলে জড়িয়ে ধরে বলত “মা মা গন্ধ বেরচ্ছে” এখনও কি সেই গন্ধ বেরোয়। কি জানি।

গাড়ি পার্ক করে হাঁটতে হাঁটতে arrival এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো বিপাশা ও প্রতীপ। প্রচুর লোক। বিভিন্ন মুখভঙ্গি উত্তেজনার রকম ফের প্রকাশ করছে। বিপাশার পাশে এক যুবতী মেয়ে তার বাচ্চা মেয়েকে সামলাতে পারছে না। “বাবা কখন আসবে?” এই প্রশ্নই সে বার বার করে চলেছে। ছেলেটা কখন যে আসবে। ওদের কাছে ইন্ডিয়ার ফোন নেই। তাই ভেতর থেকে খবর পাওয়ার উপায় নেই। বাইরে থেকে বেশ কিছুটা ভেতর পর্যন্ত দেখা যায়। এক এক করে যাত্রীরা বেরিয়ে আসছে। আর বিপাশার বুকের ধকপকানি বেরেই চলেছে। কিসের এতো উত্তেজনা। সবাই উঁকি মেরে দিগন্ত বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিপাশাও একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিছুই আলাদা নেই। চোখের চশমায় বাষ্প জমে উঠছে মাঝে মাঝে। বিপাশা জানে কনাসাস আর সাবকন্সাস মাইন্ড দুটো স্বতন্ত্র ভাবে শরীরে মধ্যে দিয়ে তার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করে। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে বিপাশার।

ঝকঝকে তকতকে যুবক যুবতীরা বেরিয়ে আসছে। কেউ একা, কেউ দোকা, কেউ তেকা। তাদের পরনের পোশাক বেশ চকচকে। ছেলেটাও হয়তো আসবে সেইরকম ভাবে। বিপাশা কি চাইছে সে তার সেই পুরানো ছেলেটাকে ফিরে পাবে নাকি আরও ভালো কিছু আশা করছে, নাকি আরও খারাপ। ভালো খারাপের কি আছে । ছেলে তো সেই ছেলেই থাকবে। হয়তো একটু গায়ে গতরে বেরেছে। সেই দুষ্টুমিষ্ট হাসিটা কি এখনও আছে। ওর ওপর দিয়েও তো এই পাঁচ বছরে প্রচুর ঝড় চলে গেছে। নতুন দেশে সংসার পেতেছে, ঘর নিয়েছে, নানা জায়গায় ঘুরেছে। পালটাবে তো বটেই। Change is the only constant. পরিবর্তনটা যেন ভালোর  দিকে হয়। যেন দু চোখ ভরে দেখতে পায় তার নিজের সৃষ্টিকে। বুকের রক্ত যেন গলায় উঠে আসছে। তাহলে কি সত্যি হার্ট অ্যাটাক হবে নাকি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আর কিছুক্ষণ। ছেলে বলত ওর নাকি রোজ ভয় হয়। কাজের জন্য বাবা মা কে ছেড়ে থাকতে হয়েছে। বলে, “শুধু মরে যেও না আমার যাওয়ার আগে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।” না না , মরব কেন। এখনও নাতিপুতির মুখ দেখা বাকি। সারাজীবন তো সংসারের ঘানি টানতে চলে গেল। এখনি তো সময়।

ওইতো ওরা। ওরাই  তো। শাড়ির আঁচলে কাঁচ মুছে ভালভাবে দেখল। অনেক দূর। মুখ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মন বলছে ওরাই। প্রতীপ খোঁচা দিয়ে বলল “এসে গেছে।” তাহলে ঠিকই দেখেছে বিপাশা। ওইতো , সেই লম্বা চওড়া জোয়ান। পাশে বউ। দুজনেই কালো রঙের গেঞ্জি পরেছে। ছেলেটা একটা বিশাল কার্ট ঠেলছে। অনেক গুলো বড় বড় সুটকেস ওর ওপর। পাশে বউ আসছে। এবার মুখটা পরিস্কার। বউমার মুখে এক অদ্ভুত জেল্লা। ও তো অনেকদিন পর দেশে ফিরল। ওর বাবা মা কে ডাকলে হতো। বলেওছিল ওরা। কিন্তু ছেলের বাবার অধিকার বেশি তাই তাদের আনা হয়নি। বউমা এসে হয়ত তাদেরও খুঁজবে, পাবে না। দুঃখ পাবে। পেটটা কি ফুলেছে। নানা তিন মাসে কি আর দেখা যায় নাকি। ওসব মনের ভুল। তবে বেশ সুন্দার লাগছে। ছবিতে বেশ ভালো লাগে। সামনে যেন আরও সুন্দরী লাগছে। দুজনে খুব কথা বলছে আর হাসছে। এমনটাই তো দেখতে ভালো লাগে।


ওরা দেখতে পেয়েছে। হাত নাড়ছে। বিপাশাও হাত নাড়াল। একেবারে গেটের কাছে এসে পরেছে। পুরোটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বিপাশার ইচ্ছা করছে ব্যারিকেড ভেঙ্গে ছুটে যায়। কিন্তু উপায় নেই। দাড়িয়ে পরল কেন। গেটের কাছে সিকিউরিটির সাথে কি কথা বলছে। বিপাশা দেখছে। ওর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এতো সেই ছেলে। যার সাথে প্রতি weekend এ দেখা করে বিপাশা। দুদিন আগেই তো লাউ রান্না করতে পুড়িয়ে ফেলেছিল। গলার আওয়াজে মাধুর্য তো সেই আছে। বেশি মোটা তো হয়নি। গত সপ্তাহে পাকা চুল দেখাচ্ছিল। দূর থেকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। অনেক ফরশা হয়ে গেছে। সেই ভাবেই হাঁটে। একটু বড় বড় ভাব এসেছে। তা হবে না। হাজার হোক সংসারি। কিন্তু এ তো অচেনা নয়। মনে হচ্ছে রোজই যেন দেখা হয়েছে। রোজ বিকালে। সন্ধ্যা দেওয়ার পর। এর তো সব খবর জানে বিপাশা। ছোটো ছেলের যেমন জানে। বিপাশার মনেও হচ্ছে না যে ছেলেকে এতো বছর দেখেনি। ব্রাশ করতে করতে কথা বলত। রান্না করতে করতে কথা বলত। কালকেও তো বাড়ি ফিরে সেই ব্রাশ করতে করতেই বিপাশার সাথে কথা বলবে। নতুনত্ব কি। তাহলে কি মানুষটা শুধুই কথা। শুধু কিছু শব্দ যা জুড়ে জুড়ে মানুষ মানুষকে ব্যাখ্যা করেছে। নাকি প্রতিবন্ধির এক ইন্দ্রিয়ের অক্ষমতা যেমন অপর ইন্দ্রিয় কে অতিসবল করে তোলে, সেইরকম নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এর অসাড়তায় মনকে ক্রমাগত তুষ্ট করে গেছে চোখ আর কান। তাহলে যে এতকাল ঘ্যান ঘ্যান করে বিপাশা সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছে সবই ভুল। প্রতীপের ব্লাড প্রেশার বেড়েছে। ছোটোছেলের সাথে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। নিজের শরীর খারাপ হয়েছে। সবই কি বাকি ইন্দ্রিয় কে তুষ্ট করার জন্য। বিপাশা অবাক হয়ে অতিপরিচিত এক ছবি দেখতে থাকে।                       
ওরা এগিয়ে আসে। কার্টটা ফেলে ছেলে দৌড়ে আসে। জড়িয়ে ধরে বিপাশাকে। বিপাশা সত্যিই ভুল ছিল।   



গল্পগুলো