নাঃ
পুরোপুরি লেখক আমাকে বলা চলে না। একটাও
বই নেই আমার রেসুমে তে। আছে
একটা ব্লগ আর তাতেই চেষ্টা করি কিছু মনের কথা শব্দে লিখে রাখার। আর হ্যাঁ , হাত পাকাই। চেষ্টা করি , আরো ভালো , আরো ভালো
কিছু লেখার। এই
চেষ্টায় একাকিত্ব আছে , কারণ গোটা সমাজ নিংড়ে দু চার শব্দে সাজিয়ে রাখার জন্য চাই
নিবিড় মনোনিবেশ। তোমরা
ছুটে যাও , দাঁড়িয়ে থাকো , আনন্দে গড়িয়ে পর , শোকে শুকিয়ে যাও , চুমু খাও , থাপ্পড়
মারো। আমি থাকি রিংয়ের বাইরে। সুকান্ত পোস নিয়ে তোমাদের লড়াই দেখি
আর তোমাদের কথা লিখে যাই। তোমরা পড় , ভালো বল , খারাপ বল। কিন্তু পাঠক হয়ে পড়।
একটা
লেখকের পাঠক কেন দরকার হয় জানো? সেই রগরগে চোখ লাল মাস্টার গুলোর কথা মনে আছে ?
যারা প্রশ্নের উত্তর না পেলে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিতো। স্কুল কলেজের গন্ডি পেরোতে না পেরোতে
সেই চোখ লাল মাস্টার মশায়রা আর নেই। কেউ
তোমায় বলে দেবে না তোমার ভুল। শুধু
আলগোছে এড়িয়ে যাবে , করে দেবে একঘরে , ভুলে যাবে তোমার অস্তিত্ব। এই পাঠকরাই আমার সেই মাস্টার রা। যারা ভুল বার করবে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে ওটা “দাবি”
না “দাবী”। এই পাঠকদের মধ্যে থেকেই কারো কারোকে লেখক বেছে নেয় ক্রিটিক হিসেবে। হে
হে , তুমি ভাবছো ফেমাস ক্রিটিকরা পাঠকের সৃষ্টি ? না হে , লেখকরাই তাদের তৈরী করে।
মিথোজীবিতা তাদের মধ্যেই সম্ভব যারা একে অপরের পরিপূরক হয়। একটা লেখকের কেরিয়ার
একটা সমালোচক শেষ করে দিতে পারে , কিন্তু সেই লেখকও শেষ হতে হতে শেষ কামড় দিয়ে যুগান্তকরী
সৃষ্টি করে উপড়ে ফেলে দেয় সেই ক্রিটিকের অস্তিত্ব। যেমন একটা সমালোচকের অনেক লেখক আছে ,
তেমনিই একটা লেখকের অনেক সমালোচক আছে। কিন্তু লেখক সেই পাঠকদের সমালোচকের মর্যাদা
দেয় যারা সমালোচনার মধ্যে দিয়ে লেখকের লেখার মানবর্ধনে সমর্থ হয়।
কবিতা
আমার পায় , ভাবতে হয় না লেখার সময়। কিন্তু
একটা ছোটগল্প , প্রবন্ধ বা সহজ কথায় গদ্য লেখা অনেক পরিশ্রমের কাজ। নাথিং কামস আউট অফ নাথিং। কিছু ঘটনা , কিছু পরিস্থিতি অনুঘটকের
মতো লেখকের কল্পনাকে সুড়সুড়ি দেয়। এমনি
হলে কেমন হতো , অমনি হলে কি এমন হতে পারতো , এমন যদি নাই বা হয় , কেমন করে তাহলে
হবে। এই সমস্ত চিন্তাভাবনার ফুটন্ত তেলে
ভাজতে ভাজতে প্রথমে মনের গহ্বরে সৃষ্টি হয় চালচিত্র। ব্যাস , সৃষ্টির কাজ শেষ। এরপর আছে পরিবেশনার প্রক্রিয়া। চরিত্র নির্বাচন , শব্দচয়ন ,
গতিপ্রকৃতি , দৃশ্যায়ন আর শৈলী। চূড়ান্ত ধৈর্যের নিয়মানুবর্তীতায় লেখক শব্দের
বাঁধন দিতে থাকে।
ভাবছেন
ধুর , এসব হয় নাকি। বসে
টাইপ করলেই তো হয়। তা বটে। বসে
টাইপই তো করি। যখন লিখি
তখন কি এতো কিছু প্রসেস মাথায় থাকে নাকি ? আচ্ছা, টাইপ করা কি কখনো শিখেছেন? QWERTY কীবোর্ড এ যখন প্রথম আঙ্গুল
চালিয়েছিলেন তখন কি ঝরঝর করে লেখা ফুটে উঠতো স্ক্রিনে, বা টাইপরাইটারের পাতায়?
উঠতো না তো ? এক একটা অক্ষর ফুটে ওঠার ঠক ঠক শব্দ কানে বাজতো। A এর পর B এর বদলে S
কেন , সেই প্রশ্নে বেশ কয়েকদিন বিভোর ছিলেন। কি টাইপ করতে হবে সেটা পাশে কাগজে আগে
না লিখলে মাথায় আসতোই না কিছু। আরে বাবা অক্ষর খুঁজবো না সেন্টেন্স ভাববো। কিন্তু এখন দেখুন দিব্যি আঙ্গুল চলছে
আর মাথাও। প্রক্রিয়ার
নাম , অনুশীলন।
এই
অনুশীলনেই লেখকের প্রাথমিক রচনাকাল অতিক্রান্ত হয় পেপার ডাস্টবিনের পাশে বা
রিসাইকেল বিনের ধারে। লেখক
লেখে, পাঠক পরে , আর সমালোচক আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ভুল। পরের দিন সমালোচক থাকে
না , পাঠক তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি, নিজের সৃষ্টির ডাইপার চেঞ্জ করতে লেখক তখন আবার
অনুশীলনে বসে। কালকে
চোখ এঁকেছিলো , আজ ভ্রূ, কাল হয়তো গগলস পড়াতে হবে। পাঠক দুঃখে ব্যাকুল , লেখককেও তাই
রক্ত ঝরাতে হবে। লেখক
ভাবে অন্য ভাবে বলবো, পাঠক বলে ঐভাবে শুনবো না , সমালোচক বলে বলো কিন্তু অন্যভাবে।
পাঠক জুড়ে দেয় নিজের জীবন লেখকের হাতে
গড়া চরিত্রের পুতুলের সাথে। সমালোচক
পুতুলমেলায় ঘুরে এসে বলে , “ওই পুতুলের নাকটা তোমার পুতুলের থেকে টিকালো।” লেখক
বলে , “ওমা আমার তো নাকবোঁচা তিব্বতি পুতুল।” পাঠক বলে , “ আমার দুটোই চাই।” লেখক
একটু ভেবে বলে , “আচ্ছা দাড়াও , গড়ে দিচ্ছি টিকালো নাকের পুতুল। একটু সময় দাও। ” এই তর্কে বিতর্কে সৃষ্টি হয় আরেক
পুতুল , বাড়ে মান লেখকের সৃষ্টির।
এই
মিথোজীবিতাকে অতিক্রম করার কোনো উপায় নেই। যারা অনেক বেশি লিখতে চায়। তারা প্রতিটা সমালোচনা পাথেয় হিসেবে নেয়।
সাতশো কোটির পৃথিবীতে যদি সমালোচনার
বৈচিত্র না আসে তাহলে এক ঘেঁয়ে হয়ে যাবে এই পৃথিবী। লেখকের ভালো লাগে সূর্যোদয় , তোমার
ভালো লাগে সকালের ঘুম। তুমি বলবে, “ধুর, সকালে ওঠার গল্প বেকার। “ লেখক তখন নিয়ে
যাবে তোমায় সমুদ্রের ধারে , সি ফেসিং রিসোর্টের বিছানায়। প্রথম আলোয় উঠবে জেগে , তোমার সামনে
নীল সমুদ্রে ফুটবে লাল ফুল। খুশি
হবে তুমি।
যখন
কবিতা ছেড়ে গদ্য শুরু করি তখন কেউ বিশেষ পড়তো না। আমার এক বন্ধু ছাড়া। আজ পর্যন্ত সে আমার সবথেকে বড়
ক্রিটিক। প্রচুর
পড়াশোনা তার। কিন্ত
নিজে লেখেনা। আমার কত
কত লেখা , কিছুটা পড়েই বলে দিয়েছে , “ধুর, বেকার। ফালতু। ” এর মধ্যে কোনটা দেখে বলেছে
এই চার লাইনের কোনো মানে হয় না। বলেছে
, “এটা অন্য ভাবে ভেবে দেখতে পারিস।” বলেছে , “মুক্তগদ্য তো হাত পাকানো ,
চরিত্রায়ন করে যেদিন ফিকশন লিখবি সেদিন বুঝবো।” বলেছে , “ লেখ দেখি ডার্ক কিছু
নিয়ে।” বলেছে , “ লিখতে গেলে আগে পড়তে হবে।” শিখিয়েছে সমসাময়িক শব্দের
প্রয়োজনীয়তা। বহু কষ্ট
করে একটা লেখা মুখের ওপর বলে দিলো ফালতু। সেদিন
খুব রেগে গেছিলাম। মূল ধারা রেখে পুরো লেখাটা আবার লিখেছিলাম। না জানিয়ে ব্লগে পোস্ট করেছিলাম। সবাই ভালো বলতে ওকে বলেছিলাম দেখ
শালা। ও মিচকি হেঁসে বলেছিলো , “রি রাইট
করলি তো , এবার আগেরটা পরে দেখ। ” গত কয়েক মাস ধরে সে খুব মানসিক অশান্তিতে আছে। তার সমস্যার সমাধান আমি করতে পারবো
না। কিন্তু তার অনুপস্থিতি যে কি ভাবে
আমার সৃষ্টিশীলতাকে ধাক্কা দিয়েছে , তা বলে বোঝাতে পারবো না।
তাই লেখক
যেন সমালোচনাকে অবজ্ঞা না করে , আর সমালোচক যেন খেলো সমালোচনা না করে সেই কাম্য। সমালোচকের কাজ ভুল দেখানো , আর লেখকের
কাজ সেই ভুল ঠিক করে , অন্য পথে সমালোচককে পরিচালনা করা। আর পাঠক , সে তো ডোপামিনের সম্পর্ক। “শুভেচ্ছা” , “ভালোবাসা” , “খুব ভালো
লিখেছো” , “তার পর কি হলো ” , “ও মা ওকে মেরে ফেললে” , “ পরেরটার অপেক্ষায় থাকলাম”
, “ আমার খুব ভালো লাগে আপনার লেখা” , “ছেলেটাকে ফাঁসিতে না চড়ালেই পারতেন ” ,
“পরের গল্পটা কিন্তু মেয়েদের জন্যে লিখবেন ” ,”একদম মনের কথা লিখেছেন ”, “আপনি কি
আমায় চেনেন , যেন সব মনের কথা জানেন ”,
“গুরু চালিয়ে যাও ”, “তোমার হবে ভাই , ” কি ভালো লাগে শুনতে। মনে হয় এদের জন্য আরো লিখি আরও আরও। পাঠক যদি ওই ছোট্ট লাইকের বদলে দু
লাইন লিখে দেয়, লেখকের
মনে আসে বল ভরসা। চলতে
থাকে অনুশীলন , বাড়তে থাকে মাসল মেমোরি আর সৃষ্টি হতে থাকে সাহিত্য।
No comments:
Post a Comment