“কমিউনিস্ট
, কমিউনিস্ট, কমিউনিস্ট , কমিউনিস্ট” চিৎকার শুনে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম সামনের মাঠে একদল ছেলে ক্রিকেট
ব্যাট নিয়ে বিশাল চীৎকার করছে, “কমিউনিস্ট , কমিউনিস্ট”, আর সামনে কয়েকটা ছেলে মুখ নিচু করে
দাঁড়িয়ে আছে। কি মজাদার দৃশ্য। হেরো
শব্দের পরিবর্তে সিপিএম শব্দটা কিরকম খাপে খাপে বসে গেছে। আর ওই শিশুদের মুখ থেকে কি দারুন
লাগছে শুনতে। আরো ভালো
লাগছে তাদের কথা ভেবে, যারা এই বালখিল্য দের মতো না বুঝে না শুনে সিপিএম আর
কম্যুনিজম এ ঘুলিয়ে শুধু আবির উড়িয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।
ওই
বাচ্চাগুলো কি জানে কমিউনিস্ট কি ? কম্যুনিজম কি? তারা শুধু জানে , বাবা কাকা যা
বলে , তা ভুল বলে না। তারা
অক্ষর চেনে আর মাত্রা বসাতে থাকে। ওরা
তো বাচ্চা , কিন্তু আমরা তো বড়। আমাদের
মধ্যে কতজন জানে সিপিএম আর কম্যুনিজম এক নয়। সারা
পৃথিবীতে কমিউনিস্ট হটাতে কেন লোকেদের এতো মাথা ব্যাথা। তারা কি দস্যু না দৈত্য। খেলো আলোচনা করা আধ কাঁচা বিদ্যে
বুদ্ধির মশাদের দিয়েই এই প্রোপাগান্ডার ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিয়েছে বিত্তবানেরা।
কম্যুনিজম
আর সিপিএম যে এক নয় সেটা অন্তত যেকোনো মানুষের বোঝা উচিত। একটা “ইসম” বা আদর্শ , আর একটা কিছু
আদর্শবাদীর দল। আদর্শ একান্ত আপন , কিন্তু যখন বেশি মানুষ এক আদর্শে চলতে শুরু করে
তখন তারা দল বাঁধে। আর যেহেতু মানুষ স্থান-কাল-পাত্র -বয়স - সামর্থ্যের সাথে সাথে
আদর্শের পরিবর্তন করতে থাকে , সেহেতু দলগত আদর্শ ক্ষণভঙ্গুর। সারা পৃথিবীতেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলো
এই ভাবেই ভেঙে গেছে।
দল খারাপ
হতে পারে কিন্তু আদর্শে কোনো ভুল নেই। যেকোনো
আদর্শ , যেকোনো তত্ত্ব চিরস্থায়ী নয়। যেকোনো
ইসম তৈরী হয় কোনো এক পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার জন্য। কম্যুনিজম , কার্ল মার্ক্স্ শুধু
নথিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু
এর বীজ সৃষ্টির সময় থেকে মানুষের মধ্যে আছে। একটা
শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন যে ন্যাকা আধ কাঁচা কমিউনিস্ট রা দেখেন তাদের জন্য বলি ,
ক্যাওস টু কসমস হওয়ার সময় সমাজ শ্রেণীহীনই থাকে। যখন কসমস তৈরী হয়ে যায় , যখন বাঁচার জন্য লড়াই থাকে না , তখন
তৈরী হয় ভালো থাকার লড়াই। এখানেই
ধীরে ধীরে সরে দাঁড়ায় কম্যুনিজম - গ্রাস করে ক্যাপিটালিজম।
আরো সোজা
করে বলতে গেলে , আমরা প্রত্যেকেই বাড়িতে কমিউনিস্ট , এবং বাড়ির বাইরে
ক্যাপিটালিস্ট। কেমন
করে ? ধরুন, আপনার
দুই ছেলে। আপনার
সম্পত্তির উইল করছেন। আপনি
কি দুই ছেলেকে তাদের ছেলে হওয়ার পারফরমেন্স এর ওপর বিচার করে উইল করে দিয়ে যাবেন ,
না সমান ভাগ করে দিয়ে যাবেন। বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই বুদ্ধিমান বাবা সমান ভাগ করে থাকেন। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই বাবা বাড়ির
বাইরে বেরোন রোজগারের জন্য , তখনই তিনি চেষ্টা করেন কি করে পরের ঘাড় ভেঙে পরের
পয়সা ঘরে তোলা যায়। গ্রিন
চ্যানেলে চলা আদর্শবাদী চাকুরীজীবি মানুষ , যে কোনোদিন জ্ঞানতো কারো পয়সা মারেননি
বলে নিজেকে গর্বিত ভাবে প্রচার করেন তার কথা সেই পেটুক মাসাহারী মানুষ গুলোর মতো
শোনায়, যে কোনোদিন প্রাণী হত্যা করেননি। এখন
এই দুই ছেলের মধ্যে যদি কোনো ছেলে বাবার টাকা মেরে নিতে চায় কৌশলে , সেও কিন্তু
চেষ্টা করবে তার সন্তানদের ক্ষেত্রে অর্থের সমান বন্টন করতে। তাহলে দাতা চাইছে সমান বন্টন , অথচ যে
গ্রহীতা সে চাইছে অপরের থেকে বেশি। আর
তাতেই শুরু হয় সমস্যা, তাতেই ভাঙে ইসম।
পিওর
কম্যুনিজম ইউটোপিয়ান, বা অলীক। ক্ষমতা
বা অর্থের সমান বন্টন কখনই সম্ভবপর হয়না। আমি
চাই ভোর বেলা সূর্যের আগে ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয়ের প্রথম আলোকে কবিতা লিখতে , আমার
বন্ধু চায় রাত জেগে পড়াশুনা করতে আর সকালে উঠে পাড়ার মাঠে শরীরচর্চা করতে। আমার লেখা ফেসবুক পোস্ট পরে লোকে ধন্য
ধন্য করলেও কেউ একটাও বইও কিনলো না , আর আমার বন্ধু তার কোম্পানিকে ৫ কোটি টাকার
প্রফিট এনে দিলো । এখন
আমি যদি গিয়ে বলি , আমি আজ থেকে তোর মতো নারিমান পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখবো,
তাহলে কি সেটা বাঞ্চনীয়। অবশ্যই
নয়। তাই ক্ষমতা বা অর্থের সমান বন্টন
কখনোই সম্ভবপর হবে না।
হবে না
তা নয় , হবে, যখন এক ভেঙে যাওয়া সমাজ আবার করে তৈরী হবে। যখন চাষির হাতের পেশী আর গণিতজ্ঞের
মস্তিষ্কের পেশীর জোর কোনো তুলাদণ্ডে মাপা হবে না। যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতি যখন
উঠে দাঁড়ায় , তখন কম্যুনিজম এক মাত্র পথ। তখন
সবাইকে বলতেই হবে আমরা সকলে সমান , ভাই তুই কোদাল চালা আমি ফ্রিকশান ক্যালকুলেট
করে বলে দিচ্ছি কোন এঙ্গেলে সহজ হবে। মধ্যপ্রাচ্যে
খুব শীঘ্রই আবার আসতে চলেছে কম্যুনিজম।
কম্যুনিজম
একটা কমিউনিটি গঠন করে। কিন্তু
কম্যুনিজম সেটা লালন পালন করতে পারেনা। যদি
একনাগাড়ে দীর্ঘকাল কোনো দল এই কম্যুনিজম দেখিয়ে সমাজ শাসন করতে চায় তখন এর মধ্যে
থেকে হয় “ডিক্টেটর” তৈরী হয় , নয় পার্টি নিজে “ডিক্টেটর” হয়ে দাঁড়ায়। যেটা সারা পৃথিবীর কম্যুনিজমের পরিণতি
থেকে আমরা দেখেছি। কিন্তু
কোনো ভাঙা সমাজ গঠনে ক্যাপিটালিস্ট বা কেন্দ্রীভূত শক্তি কখনো সাফল্য লাভ করতে
পারেনা। উদাহরণস্বরূপ , কোনো রাজা আজ পর্যন্ত
কোনো সমাজ সৃষ্টি করতে পারেনি। সমাজ
গঠিত হয়েছে আগে , তারপর সেই সমাজের রুটি-কাপড়া-মাকান সমস্যা শেষ হওয়ার পর , আরো
ভালো থাকার লড়াইয়ে যে সামাজিক ভাঙ্গনের সূত্রপাত হয় সেই সুযোগে কোনো “নেপো” হয়েছে রাজা।
আমরা এখন
এমন এক সময় দিয়ে যাচ্ছি , যখন না আমরা পুরোপুরি ভাবে সমাজতন্ত্র কে মানতে পারছি না
ধনতন্ত্র কে। ঘোলা জলে
সাঁতরে বেড়াচ্ছি। আমরা
আমেরিকার ধনতন্ত্র কে বলছি ভালো , অথচ ধনতন্ত্রের ফসল হিসেবে বেরিয়ে আসা বিশাল বড়
বড় স্ক্যামকে বলছি খারাপ। চীনের
কম্যুনিজম কে বলছি একনায়কতন্ত্র , আর তাদের সাফল্যে বলছি , “ঠিক এমনটাই করা উচিত।”
এই ঘেঁটে ঘ হয়ে যাওয়া চিন্তা ভাবনার মাঝে ক্ষমতাশালী “নেপো” রা লেলিয়ে দিচ্ছে
আল্লা আর রাম কে। আর
মানুষ তো লেনিনের মূর্তি ভাঙা , আর শ্যামাপ্রসাদের কালিমাখা মূর্তি দুধে ধোয়ানো
নিয়ে ব্যস্ত। হাতে
নাচো চিপস দিয়ে বাঁদর নাচ নাচাচ্ছে সবাই কে আর আমরাও নাচছি বাসন্তীর মত।
যাইহোক ,
এর থেকে সাধারণ ভাবে আর বলা সম্ভবপর না , উপরে যা বললাম সেটা একরকম হিন্দু-ইসম এর মানে “প্রণাম করা”। তবু বললাম, কারণ এটুকুও না জেনে মানুষ দিব্যি
কম্যুনিজম কে গালাগালি দিচ্ছে। সিপিএম
কে গালাগালি দিন , আপত্তি নেই , দুয়ো দিন চীন কে , আপত্তি নেই , কেউ নিজেকে কমিউনিস্ট বললে হেব্বি
খিস্তি করুন , কিন্তু দয়া করে কাউকে কমিউনিস্ট বলে ‘খিস্তি মেরেছি’ এই আনন্দে
নাচবেন না। উপরের দিকে
মুখ করে থুতুই ছুঁড়ছেন।