Monday, June 5, 2017

হঠাৎ পাওয়া




সে আবার কি ? হঠাৎ করে কি কিছু পাওয়া যায় । কিছুটা এরকমই আমার হঠাৎ করে মনে হয়েছিল যখন এই টপিকটা ইভেন্ট হিসাবে ঘোষণা হয় । খাটতে খাটতে আর হারতে হারতে হঠাৎ করে কিছু যে পাওয়া যায় সেটা আর বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় । মিরাকলের বদলে জাঁতাকলে শরীর পেশা এক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে । জীবনের প্রতি মোড়ে মোড়ে একটি করে বাটি বসিয়ে রাখা আছে আমার জন্য, ঘামে না ভরালে সামনের রাস্তা আর দেখা যায়না । প্রথমে মেরিনেড, তারপর তন্দুরে সেঁকা, তারপর কুচি কুচি করে নিজের ডিম আর কিমার সাথে কষিয়ে আমি এখন রেডি টু সারভ মুর্গ মাসাল্লাম। কিন্তু পরের রসনাই তৃপ্ত করি এবং সর্বোপরি আমি একটা মুরগী হয়ে যাই জীবনের কাছে ।

       কোনও কিছুই প্লান প্রোগ্রাম ছাড়া হয়না। বাঁকা পিঠে বসে যখন হাজার আঁক কষতে কষতে এক পা এগোনো আর দুই পা পিছনো পায়ের প্রতিবরত ক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে , তখন থমকে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে দেখি, আমার চোখে ঠোঁটে গালে লেগে থাকা একটা “পাওয়া” আমার সাথে এখনও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে ছলেছে । সেই হঠাৎ পাওয়া সঙ্গী আমার অধুনা বান্ধবী এবং বর্তমান মস্তিষ্কপ্রক্ষালন জন্ত্রের অধিকারী আমার স্ত্রী , সাধুভাষায় বৌ । 

তখন ক্লাশ ইলেভেন । মাধ্যমিক পাশ করে “দিল চাহতা হ্যায়” দেখে , একটা গ্রুপ বানিয়েছি “দিল ঢুন্ডতা হ্যায়” । চরম উত্তেজনা। এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছি আর মাথায় হাত দিয়ে আকশের দিকে তাকিয়ে কবিতা লিখছি । বিড়ি সিগারেট মদ আর বেলেল্লাপানা , সব একসাথে । কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবো । তারপর মাধ্যমিকে স্টার । ল্যাজের ওপর আবার সোনার ঝালর। গঙ্গার ধারেই মোটামুটি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব এরকম একটা টার্গেট নিয়ে এগচ্ছি।

ধুম করে আবার প্রপোস করে বসলাম এক বান্ধবীকে। মাধ্যমিক পর্যন্ত যে ছিপিটা আটকে রেখেছিলাম সেটা শশব্দে খুলে গেল । কিন্তু গ্লাস ছিল ভুল এবং দামী । মাধ্যমিকের রেসাল্টে দেখা গেল মাধ্যমিকে শহর থেকে প্রথম হয়েছেন তিনি। আমি তলানি আর সাথে সাথে রিজেকশান । কি ব্যাথা খেয়েছিলাম । যেন রোজ একটা ফোঁড়া ফাটছিল । টিনেজে ল্যাজ টিকটিকির মত হয় । কেউ এসে খুঁচিয়ে দিলেই ঝরে পরে । সে ব্যাথায় কাতর হয়ে শয্যা নেওয়ার বদলে আমি বিন্দাস হয়ে গেলাম। বাবা নরমালি উদাসীন , তবু মাধ্যমিকের রেসাল্টের আগে ব্লাড আর ব্লাডার দুটোরই প্রেসার প্রচণ্ড বাড়িয়ে ফেলেছিল । তিনি তো মোটামুটি উচ্ছন্ন স্টেশনের পাশে ঘরভাড়া নেওয়ার প্লান করছিলেন আমার জন্য । আমিও ব্যাগ ট্যাগ প্যাক করে বসেই ছিলাম।

আরেক অদ্ভুত ব্যাথা তারুন্যে টুকি টুকি খেলে । “আমি কদাকার তাই কোনও মেয়ে কাছে ঘেঁষে না। ” তখনও এই ভাবনা আসেনি , মিস ইউনিভারসেও ঘানা আর কেনিয়া নিজেদের নমিনেশান পাঠায়। ব্যাপারটা যে সৌন্দর্য নয়, শুধুই কনফিডেন্স সেটা আর কে বোঝাবে। সাথে আবার সেই বয়শে ছেলেরা কাউন্ট করে কটা মেয়ে এসে তার সাথে কথা বলল । এমনকি দূর থেকে ভুল করে হাত নাড়ালেও  “সে আমার” হিসেবে কাউন্ট হতো । আমি তখন গান্ধী চশমা , বই প্রেমী , ভুতে ভয় পাই, মাসল নেই আর সদ্য রিজেকটেড বাই পোটেন্সিয়াল গার্ল , মানে প্রথাগত ফালতু ।

এমন এক সময়ে দুর্গাপূজার অষ্টমীতে ঘুরতে গেলাম আমার দিল ঢুন্ডতা হ্যায় এর লিডারের শহরে। সে বলল চল এক বান্ধবীর বাড়ির সামনে দুর্গাপূজা হয় সেখানে ঘুরে আসি । আমি ওকে। জেতে জেতে রাস্তায় একটা জুতোর দোকানের সামনে হঠাৎ করে আমার বন্ধুকে একটা মেয়ে নাম ধরে ডেকে ওঠে । বন্ধুও আমায় “চল না” বলে এগিয়ে যায়। ঘাড় এগোয় তো মাথা তো আসবেই । আমায় পরিচয় করিয়ে দেয় । আর আমাকে পরিচয় করায় , “তোর অর্ক” বলে । হঠাৎ বোমা পরায় হিরোসিমার হিরোগিরি বেরিয়ে গেছে । পরে জানতে পেরেছিলাম ওরা একই স্কুলের বন্ধু । বিনা কারনে না দেখেই নাম জড়িয়ে দেওয়ার এক অভ্যাস টিনেজ খিল্লিতে সাধারন মাপের রসিকতা।

মেয়েটা দেখতে চমকপ্রদ কিছু না । ঢ্যাঙা , লম্বা মুখ, কুতকুতে চোখ , ফর্সা তবে মনে হচ্ছিল পাউডার বেশী লাগানো, কপাল চউড়া , মোটা গলা। হলুদ রঙের সালওার কামিজে বিশেষ চাকচিক্য ছিল না। আর মুখটা ভয়ানক রকম শান্ত। যতক্ষন ছিল ততক্ষন এক্সপ্রেসানের বড় অভাব । শুধু মাঝে মাঝে ঝলকে উঠছিল একটা হাসি । গজ দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা হাসি। আমার আবার হাসিতেই বেশী এফিনিটি। কিন্তু সেদিন একেবারেই মনে ধরেনি। “কিরে কেমন লাগলো” এই ঘটকমার্কা প্রশ্নের পাশকাটিয়ে সেদিন কোনোরকমে বেরিয়ে গেছিলাম । কিন্তু রাতে সে এক অদ্ভুত সিনেমার মত গল্প। ভোরবেলার স্বপ্নে দেখলাম সেই হলুদ ওড়না আমার মুখে এসে লাগছে আর সে এসে আমার সাইকেলে বসলো। ব্যাপারটা আজকের দিনে লিখতে গিয়ে দমফাটা হাসি বেড়িয়ে আসছে বটে , তবে সেদিন বেশ সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছিলাম।

তারপর অদ্ভুত ভাবে একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা চলতে লাগলো জীবনে । দুর্ভাগ্য এই যে , এই মেয়েটাও স্কুলে মেধা তালিকায় আসতো আর আমি আস্ত পাঁঠা । কিন্তু কি জানি জেদ চেপে গেছিল । প্রথম প্রেম নিবেদনে প্রত্যাক্ষান আবার । কিন্ত এবার আমি নাছোড় বান্দা। দীর্ঘ ছ মাসের যোগ্যতা প্রদর্শনের যে লড়াই তার ফল্প্রসুত আমাদের এই দীর্ঘ সঙ্গ ।

কোনও কারন ছিল না সেদিনের অকস্মাৎ প্রথম দেখার । কিন্তু সেই দিন যে সারা জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়াবে কে জানতো । এরপর হাজার হাজার লড়াইয়ে আমার তূণীরে তীর ছিল তারই গড়া , তরবারির শানে তারই মুখ প্রথমে ভেশে উঠত, বুলেটের গতি তার বারুদের মিশ্রনেই নিরধারিত হতো ,  আমার যুদ্ধনাদের সমেও সে লক্ষ্যও সে । জীবনের উদ্যেশ্য স্থির হলে  লক্ষ্যভেদে শুধু মাছের চোখই দেখা যায় । সে সেই উদ্যেশ্য । সহশ্র তার বন্ধনে ক্রমমুক্তি আমার জীবনের ধারা। আমার গতি , আমার অবরোধ, আমার সাহস, আমার ভয় আর আমার জীবনের সাধন সে। তার অবাধ্যতা আমার উত্তেজনা। তার ভেঙ্গে পড়া আমার জেগে উঠে পাহারা দেওয়ার কারন । তার উত্থান আমার অবরোহণের লিপ্সা । তার গতি আমার অক্ষে । তার ইচ্ছা আমার প্রযত্ন। তার সম্মান আমার কর্ম । তার জীবন আমার জীবন । বহুবার ভেঙ্গে যেতে যেতে গড়ে ওঠা ফিনিক্স পাখির মত আমাদের সংসার সেই হঠাৎ পাওয়ারই একমাত্র নিদর্শন ।

শেষ করার আগে , সেই কবিতাটি, যেটা তাকে নিয়ে লিখেছিলাম যখন বহুদিনের প্রচেষ্টার শেষে একদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে দুটো সাইকেল থামিয়ে শুনতে পেয়েছিলাম , “হ্যা ব্যাপারটা বন্ধুত্বের থেকে অনেক বেশী। সারাজীবনের বন্ধুত্ব।”                            

আকাশে  চাঁদ  উঠেছিল  -- 
সামান্য কলঙ্কিত ( লোকেরা  বলে )
দেখলাম  তাকে ,  স্নান  করলাম তার জ্যোত্স্নায়, 
পুকুরে , আয়নায়  দেখলাম  তার  প্রতিবিম্ব। 
লুকোচুরি   খেললো  সে ।
কখনো  গাছের  মাথায়,
কখনো  গগনচুম্বী  অট্টালিকার  পেছনে। 
কখনো  প্রচ্ছন্ন, কখনও আচ্ছন্ন  হয়ে  থাকলো  মেঘের  পিছনে
মিষ্টি  হাসি  হেসে  জানলার  গরাদ  অবজ্ঞা  করে 
আমার  পড়ার  টেবিলে ছড়িয়ে  দিল  জ্যোত্স্না।
কবিতা  লিখলাম  সেই  আলোয়, 
 সে  দেখল  - তবু  অজানা  রয়ে  গেল  আমার 
হৃদয়  নিঃসৃত  শব্দরাজি  তার  কাছে
বিভোর  হয়ে  উঠলাম , তার  কল্পনায় । 
চাইলাম   তাকে  ছুঁতে
হঠাৎ  সবকিছু  ওলট  পালট  হয়ে  গেল।  
সবকিছু  জটিল  হয়ে  গেল।  
হারিয়ে  গেল  কবিতা, হারিয়ে  গেল  জ্যোত্স্না .
অন্ধ  হয়ে  গেলাম আমি । 
সুধা  সমুদ্রে  স্নানরত  কাশফুল , মিলিয়ে  গেল  নির্নিমেষ  অন্ধকারে
নিস্তব্ধতায়  বুঝলাম  রাত  হয়েছে।  
তবু  সেই  জ্যোত্স্নার  কুন্দসুরভিত  হাস্যময়  রূপ 
চোখে  দিল  না  সামান্য  আভা। 
জয়ী  হলো  সেই  ঔদ্ধত্য।
রূপের  দম্ভ  , উচ্চতার  অভিমান আর  দূরত্বের  গর্ব .

কাটল  দিন  ,
কেটে  গেল  যৌবনের  কিছু  অমূল্য  সময়। 
সেদিন  বাগানে  ঘুরছিলাম   এলোমেলোভাবে .
হঠাত  এক  অপূর্ব  সুগন্ধ -- 
আঘ্রানে  মনে  হলো,  স্বর্গের  কল্পনার  পারিজাত  ফুটেছে 
জন  অরণ্য  বা  কংক্রিট  জঙ্গলে 
কাছে  গেলাম , আরো  সুগন্ধ  ছড়ালো  সে।
দর্শন  করতে  চাইল  হৃদয়।
কিন্তু  অন্ধকার  পৃথিবী  অন্ধকারই  রইলো । 
ভাবলাম  আপন  করে  নিই 
আঘ্রাণ  চক্ষু  দিল , বাতলে  দিল  পথ ।
স্পর্শ  করতে  গেলাম  তাকে ।
তীব্র  কাঁটার  দংশনে  সে  বুঝিয়ে  দিল  
"আমি  সহজ লভ্য    নই ।"
কিন্তু  সেই  দংশনে  ছিল  না  দম্ভ , অভিমান  বা  ঔদ্ধত্ত  
ছিল  আত্মসম্মান , ছিল  আত্মমর্যাদা 
ছিল  কোনো  যোগ্য  হাতে  যাওয়ার  দুর্নিবার  ইচ্ছা ।
অবজ্ঞা  করলাম  লোহিত্গন্ধি  উষ্ণ  শোনিতকে, 
প্রয়োগ  করলাম  পৌরুষ, ছিন্ন  করলাম  বৃন্ত ।
বুকে  জড়িয়ে  ধরলাম  বিজেতার  মত  
হঠাৎ  পৃথিবী  আলোকিত  হলো। 
সকলই  আগের  মতন,  তবু  নতুন।
দেখলাম বুকের  মধ্যে  ধরে  আছি 

আমারই  রক্তে  রঙিন - একটি  লাল  গোলাপ  ফুল . 

No comments:

Post a Comment