Saturday, November 26, 2016

সাহিত্যের ক্রোমোডায়নামিক্স .....

সাহিত্যের ক্রোমোডায়নামিক্স .....

সাহিত্য কি সে নিয়ে একদল ক্রমাগত বকে চলেছে।  আর কোনটা সুসাহিত্য আর কোনটা কুসাহিত্য তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা চিরন্তন। বিচারকের চেয়ারে সবসমই একদল লিবারেল একদল প্রোটেকশনিস্ট মানে উদার এবং সংরক্ষণশীল।  কিন্তু যা বয় তাকে বইতে দিতে হয়।  আটকালে সে টপকে বইবে বা উবে যাবে।  গুণগত মান বিচার করার ক্ষমতা পাঠকের।  আর যা একের কাছে ইলিশ তা অপরের কাছে চিংড়ি।  তাই ভালো খারাপ নির্ধারণ করা অযৌক্তিক।  তবে সর্বজন গ্রাহ্য বলেও একটা কথা আছে।  আর তার জন্যেই এতো চর্চা। 

আমরা যা পড়ি তাই শিখি আর শিখে কিছু করি।  সমাজের দ্রুতির সাথে সাহিত্যের শব্দসংখ্যা ক্রমাগত কমে এসেছে।  স্থিতিশীল শান্ত মনে যখন বিশাল উপন্যাসের রস নিতে হয় তখন দৌড়ে বাস ধরার ইচ্ছা থাকে না। তাই উপন্যাস থেকে বড় গল্প , থেকে ছোটো গল্প থেকে অনুগল্প থেকে চুটকি থেকে এখন দুলাইনের সাহিত্যের আগমন হয়েছে।  প্রতিনিয়ত ভাবসম্প্রসারণ এখন পাঠকের শব্দজব্দ।  আর শব্দের কারিগররা নানা জায়গা থেকে শব্দের আগমন ঘটাচ্ছেন। 

কিন্তু এই টুইটার এর ১৪০ অক্ষরে কি আর মনকে ব্যক্ত করা যায়।  হয়তো যায়।  আমার দ্বারা হয়না।  হয় যেটা সেটা সাংবাদিকতা।  কিন্তু উদ্যেশ্য কি? মনোরঞ্জন।  যদি "সবথেকে ছোটো রেসিগনেশন লেটার। ..... থুঃ " এই লেখা পরে যদি পাঠক দাঁত বার করেন, তাহলে এটাই সাহিত্য।

বছরখানেক আগে ফেইসবুক এর একটি গ্রূপে আমার এক বন্ধু আমাকে অ্যাড করে।  গল্পের সন্ধানে।  প্রথমে ভেবেছিলাম সেই যেরকম সমস্ত লেখক লেখিকার গ্রূপ থাকে সেইরকম।  কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম , না।  এটা খনি।  সবাই লেখে , বা লিখতে চায়।  যা ইচ্ছা লেখে , গুণগতমান নিয়ে কোনো চর্চা নেই।  আছে 'পকেটে যা কাছে বার করো ' ভঙ্গিমা।  লাইনে দাঁড়িয়ে কে লাইন মারছে না ভাঙছে সেইটুকু বিস্তার করলেও এখানে লেখক হওয়া যায়।  প্রথমে নাক শিঁটকে , ভুরু কুঁচকে ঘুরে এসে আবার দেখলাম।  ভুল আমার।  এই যেমন খুশি লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত স্বাধীনতা।  আর সাহিত্যের স্বাধীনতা সৃজনশীলতাকে বৈচিত্র দেয়।  যারা দু লাইন লেখে তারা লেখকের ১০০ লাইনের খোরাক যোগায়।  এটাও তো সাহিত্য। 

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংজ্ঞা, বনফুলের অনুগল্পের ব্যাখ্যা , বাণী বসুর উপন্যাসের বিশ্লেষণ আদপে সুষ্ঠ আখ্যান ছাড়া আর কিছু নয়।  চরিত্র মিশিয়ে , শব্দ বসিয়ে , ছন্দ জাগিয়ে কিছু ঘটনার বিবরণই সাহিত্য।  বঙ্কিমের দাঁতভাঙা বাংলা থেকে চন্দ্রিলের দাঁত "ক্যালানো" বাংলা সবই তো সাহিত্যের অঙ্গ।  শুধু লোকে মানতে চায়না।  বেরিয়ে আসে "ইশ" . মানছি , সবাই যখন কথা বলে তখন তাকে চ্যাঁচামেচি বলে।  কিন্তু সবাই যখন দান করে তখনি তো ভান্ডার পূর্ণ হয়। 

কেউ কেউ বলে নিম্নমানের শব্দে উচ্চমানের সাহিত্য বেরোয় না।  আচ্ছা তাই নাকি , "আমার পুত্র উজ্জ্বলজলজলবিভাষিতলোচনপ্রান্তে স্থিতিশীল আছে। " এর থেকে "ছেলেটা কাঁদছে" বললে কি ব্যঞ্জন রঞ্জিত হয় না? নবারুণের খিস্তিশীল সাহিত্যে যদি "বন্ধ্যা গজগামিনীর অন্থস্থলে মিশ্র অন্ডকোষ নিঃসৃত বিভ্রান্ত শুক্রাণুর পক্ষাঘাত " লাইনের সমাগম হতো তাহলে কি খুব ভালো হতো।  না। সাহিত্য তাই সর্বজনগ্রাহ্য হয় না।  একই লেখা কারো কাছে বালিশ , কারো কাছে ঠোঙা।

এই শব্দের কাঠামো গঠন করে সাহিত্য। আমরা সাহিত্যের গুণগত ম্যান বিচার করতে গিয়ে ভুলে যাই সমস্যা সেখানে নয় যখন লেখা আমাদের পাতে পরে।  তখন , যখন আমরা জঞ্জাল সাফ করতে করতে চর্চা করা ভুলে যাই।  আগামীর আহ্বান যেমন প্রয়োজনীয় , প্রাচীনের সংরক্ষণ তেমনই দরকার। শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল কত শব্দ মুছে গেছে বাংলা ভাষা থেকে।  যা অনায়াসেই ছন্দে ফেলা যায়।  কত শব্দে কত আধুনিক বাক্য শ্রুতিমধুর হয়।  অথচ আমরা সেই বিবেচনার শক্তি হারিয়ে ছোট্ট করে একটা ইংলিশ শব্দ দিয়ে আমাদের ইচ্ছাপূরণ করি।  এখানে আমার আপত্তি। 

সাহিত্য তাই অপাচ্য হয় না।  দুষ্পাচ্য হয়।  অধিকন্তু এখন খুব দোষায়।  পরিমিত শব্দে মনের ভাব বিস্তার করার দৌড়ে এখন সবাই দৌড়াচ্ছে।  নাক শিঁটকানো ছেড়ে হয় পড়ো নয় লেখো।  যা বইছে তাকে বইতে দাও।  ভালো লাগলে আবার পড়ো, খারাপ লাগলে উল্টে দাও।  কারো কথা না শুনে নিজের কথা শোনো। একদিন বই বেরোবেই "কোয়ার্ক (quark) বা গ্লউন (gluon)  সাহিত্য"। 


No comments:

Post a Comment