Wednesday, September 19, 2018

বাংলা পক্ষ ও গর্গ

আজ সকালে  ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখে বেশ মজা ও রাগ হলো।  গর্গ চ্যাটার্জির নাম অনেকেই জানে এখন।  ইনি এখন বাঙালির বাঙালিয়ানার এক অন্য দিক নিয়ে খুঁচিয়ে দিচ্ছেন জনমানসকে।  বাংলা পক্ষ বলে একটা গ্রূপ বানিয়ে বাংলা ভাষার এক আন্দোলন তৈরী করার চেষ্টা করছেন।  কলকাতার বুকে বাঙালির পরিবর্তে অবাঙালির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার দরুন যে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর একটা বিশাল ধাক্কা লেগেছে , তার বিরুদ্ধে ইনি চেষ্টা করছেন কিছুটা হলেও বাঁধা দেবার।  ইনি রাস্তায় কোনো এক মোড়ে দাঁড়িয়ে ফেসবুক লাইভ করছিলেন। তখন এনাকে আরেকজন ফেসবুক লাইভ করে।  আর জড়ো করে ফেলেন আরো কিছু লোক , উদ্যেশ্য একটাই , গর্গ কে হেনস্থা করা।  ভিডিওটি পুরো দেখে তারপর বাকিটা পড়ুন। .....

------------

এনার বিবরণ ও ভূমিকা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, কারণ সংবিধান মেনে কেউ যদি ঘাপটি মেরে এক কোণে বসে থাকা মূল সমস্যা কে ঘাড় ধরে সকলের সামনে এনে ল্যাংটো করে তাহলে সে তো ঠিক কাজই করছে।  লবি যে কি বড় শব্দ সে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারি।  আর বাংলায় বাঙালির লবি কমে যাওয়ার জন্য যে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে সে আমরা দেখতেই পারছি।  গর্গ চ্যাটার্জির আগেও বহু লোক বহু ভাবে এই কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিতে পারেনি কারণ বহুভাষিক দেশে কোনো ভাষার বিরোধিতা করা আসলে এক প্রকার রাজদ্রোহ।  তাই এর কোনো সমাধান হয়নি।

মহারাষ্ট্রে রাজ্ ঠাকরে পলিটিকাল এজেন্ডা হিসেবে ধর্মের পরিবর্তে ভাষা ও জাতীয়তাবাদ তুলে ধরেছিল তার একমাত্র কারণ ক্ষমতায় আসা।  আর কিচ্ছু না।  কারণ ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ জনজীবনে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। মারাঠি মানুষরা যখন হাত পেতেছে তখন হিন্দিতে কথা বলেছে , যখন হাত উল্টেছে তখন মারাঠিভাষির কাছে হাত খুলেছে।  ২০০৯ সালের একটা কথা বলি।  তখন মুম্বাইতে থাকতাম।  সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের বোরিভলি গেটের ঠিক পেছনে রাহেজা কমপ্লেক্সে ছিল আমার বাসা।  আইটি তে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আই এ এস এর প্রিপারেশন শুরু করেছি অনেকদিন।  ফর্ম ফিলাপ করতে তখন এটেস্টেড করতে হতো গ্যাজেটেড অফিসারের কাছ থেকে।  খুঁজতে খুঁজতে গেলাম এক গেজেটেড অফিসারে কাছে।  ভদ্রলোকের নিজস্ব বাড়ি ছিল ফ্ল্যাটে ঢাকা মুম্বাই শহরে।  দরজা নক করতে বেরিয়ে এসে হড় হড় করে মারাঠিতে বমি করে দিলো।  তখনও মারাঠি খুব একটা বুঝি না।  হিন্দিতে বললাম যে আমি মারাঠি বুঝতে বা বলতে পারিনা।  এবং আমার আসার উদ্যেশ্যও বললাম।  উনি আমাকে ধন্য করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন , "এটাস্টেশন অনলি ফর মাহারাস্ট্রিয়ান।  মি মারাঠি। জয় মারাঠা। "

ব্যাপারটা নাটকীয় লাগলেও সেই সময় এই নাটক হেব্বি চলছিল।  এম এন এস বা মনসে বা মহারাষ্ট্র নবনির্মান সেনা তখন চুটিয়ে উত্তরপ্রদেশীয় দের প্যাদাচ্ছে।  হুলিয়ে বিক্রি হচ্ছে রেপিডেক্স মারাঠি স্পিকিং কোর্স। আর মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে "জয় মাহারাষ্ট্রা " বা "জয় মারাঠা " । এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের মদে চুবে থাকা কিছু মানুষ নিজের ছোট্ট ছোট্ট পার্ট করছে।  তার মধ্যে এই গেজেটেড অফিসার একজন।

"গর্গ চ্যাটার্জি মানুষকে উস্কাচ্ছে ঠিক এই কাজটা করার জন্য" - এই ভাবেই আমি বলতে শুনেছি বাংলা পক্ষের বিরুদ্ধে।  আগেই বলে দিচ্ছি আমি নিরপেক্ষ , কারণ আমার মনে হয় স্বজনপোষণের বিরোধিতা করে সময় নষ্ট করা বোকামি।  এটা থাকবে।  আজ অবাঙালিরা করছে তার আগে বাঙালিরা করতো, এবং কেউ না কেউ কখনো না কখনো এটা করেই যাবে।  আর যারা ইম্মিগ্রেন্ট তারা তো করবেই, তাদের বেঁচে থাকতে হলে দল তারা বাঁধবেই।  আমি নিজের রুট থেকে অনেক অনেক দূরে যখন অবাঙালিদের ভিড়ে বাঙালি খুঁজি , তখন সেইসব অবাঙালিদের কথা ভাবি যারা আমার দেশে আমার শহরে এসে "অবাঙালি" মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে।  গর্গ বা বাংলা পক্ষ এর বিরোধিতা করে না।  কিন্তু ঠিক যেমন সব ধর্মই ভালো কিন্তু ব্যাখ্যা গুলো খারাপ , ঠিক তেমনি গর্গ যা বলতে চাইছে সেটা ঘেঁটে দিচ্ছে কিছু গোলমেলে মানুষ।

গর্গ বলতে চাইছে , পশ্চিমবঙ্গ বাঙালিদের জায়গা।  এখানে থাকতে হলে বাঙালি রীতিনীতি , সামাজিক ব্যবস্থা  ও ভাষাকে আপন করে নিতে হবে। সময় লাগবে কিন্তু করতে হবে।  কথাটাতে তো ভুল নেই।  আমরা বাঙালিরা যখন বাংলার বাইরে এসে বলি "সুট্টা মারনা হ্যায় অউর পানি পিনা হ্যায় " তখন তো সেই ফেমাস জোকস "সিগরেট চবাকে জল খাবো " বলে হাসতে তো অৰাঙলীদের গায়ে লাগে না।  আমরা বাঙালিরা সারা বিশ্বে যখন ছড়িয়ে পড়ি তখন সবথেকে "এডপ্টেবল" জাতি বলে তো আমাদের নামই আছে।  কয়েক ঘন্টার মধ্যে "শিডিউল" কেমন করে "স্কেডিউল" হয়ে যায় , জলের মগ পাল্টে যায় কাগজের রোলে।  আমরা যখন বাইরে বেরোবো তখন এডজাস্ট করবো তাদের   কালচারের সাথে , বাড়িতে যখন ফিরবো তখন এডজাস্ট করবো সেই তাদেরই কালচারের সাথে সে কেমন কথা।  "জয় শ্রী রামের " ধাক্কায় তো মনসা , শেতলা তো অনেক আগেই চলে গেছে।  এবার দুর্গার জায়গায় হবে গড়বা।

গর্গ এই নিয়েই বলে।  ওর পরিবেশনা অত্যন্ত জঘন্য।  কেতাদুরস্ত নয়।  অদ্ভুত ভাবে চুল কেটে এক মুখ দাড়ি নিয়ে একদম নাকের ডগায় ফোন ধরে বকে যাওয়াটা মোটেই দর্শকের কাছে চিত্তাকর্ষক নয়।  কিন্তু ওর উদ্যেশ্য খারাপ নয়।  শেষমেশ সেই পলিটিক্সে ঢুকে যাবে জানি।  কিন্ত আপাতত এই মানুষটার দরকার এই বাংলায়।  আর এর বিরুদ্ধে না গিয়ে প্রতিটাটা পয়েন্ট যেগুলো ও তুলছে সেটার পক্ষে বলাটা মনে হয় বাঙালিদের দরকার।  এটা একটা হেলদি কম্পিটিশন।  নিজের জায়গা কেউ ছেড়ে দিতে চায়না। কিন্তু বিপণন প্রয়োজন।  ব্যাপারী যদি রাজা হয়ে যায় তাহলে কি হবে তা অন্তত ভারতবর্ষ কে বলে দিতে হবে না।  তাই লড়াই থাকুক , আর এই লড়াইয়ে কখনো জিতবে অবাঙালি আর কখনো বাঙালি।  তবেই সৃষ্টি হবে সুন্দর সমাজ।  নাকউঁচু বাংলায় যখনিই নিজেরটা খারাপ বলে  নিতে গিয়ে নিজেরটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তখনিই আসে সমস্যা।

আর  গর্গর জন্য বলছি।  বিপ্লব ভালো , কিন্ত বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন মানুষদের।  সেই যুগ আর নেই।  যেখানে আদর্শ , ইসম , ঐতিহ্য পোশাক বা মোড়কের থেকে বেশি।  এখন মোড়কের দাম অনেক বেশি।  ভাষা বিপ্লব নিচের তলার লোক নিয়ে হবে না।  শুনতে খারাপ লাগলেও এটা অনেক বেশি ট্যাকটিক্যাল এবং প্র্যাকটিকাল।  এখন কেউ ভাষার জন্য প্রাণ দেবে না।  তাই কাগজে কিছু লিখে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিলে শুরুটা হয়ে গেছে বটে , আর কিন্তু এগোবে না।  পিষে দেবে মিডিয়া।  জানি বলা সোজা , কিন্তু যা করছো তার জন্য শুভেচ্ছা।

আর হ্যাঁ এই "হিন্দুস্থানী" "হিন্দুস্থানী" কি ? খুব কানে লাগে।  আমরা কি পাকিস্তানি। জানি ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে এটাই বেরিয়ে আসে অবাঙালিদের জন্য।  কিন্ত যখন ভাষার একটা বিপ্লব চিন্তা করেছো তখন ভাষা শুধরানো উচিত।  ঠিক যেরকম বাঙালি আর মুসলমান।  এইরকম অনেক কিছু ঠিক করা প্রয়োজন।