“বার্ড ফ্লু তো কি হয়েছে? এখনই তো মুরগী খাবার সময় রে।“
“বল কি
নাড়ুদা। কিন্তু পেপারে তো বলছে এতো লোক মরছে মুরগী খেয়ে। শেষে সেই খেয়ে মরবো
নাকি?“
“পেপারে
তো এও বলছে যে মাংস যদি ভালো করে কষিয়ে রান্না করা হয় তাহলে বার্ড ফ্লর ভাইরাস মরে
যায়। “
“কিন্তু
কাঁচা মাংস পরিষ্কার করলেও তো হচ্ছে।”
“তোদের
সেসব চিন্তা করতে হবে না। দোকানে গিয়ে মুরগী পছন্দ করবি। দাম দিবি। বাকিটা আমি
দেখে নেবো। এতো সস্তায় মুরগী সারা জীবনেও খেতে পারবি না রে। এখন খেয়ে নে। যত পারিস , খেয়ে নে। ”
“তুমি
বলছো বটে নাড়ুদা , অথচ তুমিই তো মেনু থেকে চিকেন বাদ দিয়েছো।”
“ও তো
সবার জন্য। সবাই
আমার কথায় বিশ্বাস করবে না। খদ্দের
হারাবো। তোরা খেলে আমি বানিয়ে দিত পারি। গোটা
চিকেন নিয়ে আয় , যা বলবি তাই বানিয়ে দেব।”
গুপ্তিপাড়া
স্টেশন থেকে নেমে রাস্তা যেখানে দু ভাগে ভাগ হয়েছে সেখানেই ছিল নাড়ুদার দোকান। টালির চালের অস্থায়ী হোটেলের নাম আমি
ভুলে গেছি। কিন্তু
মনে আছে গরম ভাতের এক কোনায় অদৃশ্য সুগন্ধী ঘিয়ের গন্ধ। গ্রামের কলেজে পড়তে গিয়ে প্রথম বছর
কেটেছিল হোস্টেলের জঘন্য এক বদ্ধ জীবনে। মেস
নিয়ে পাঁচ বন্ধু যখন হোস্টেল ছেড়ে পাড়ি দিলাম মেসজীবনে তখন প্রথম সমস্যা ছিল
খাবারের। খাবার সর্বত্র। কিন্তু
কোথায় গেলে ভালো, সস্তা
ও সুন্দর খাবার পাওয়া যায় সেটাই খুঁজে
বার করা ছিল সবথেকে বড় সমস্যা। বেশ কিছুদিন পাল্টে পাল্টে অন্য অন্য ভাতের হোটেলে
খাবার খেয়ে শেষমেশ আমরা এসে পড়েছিলাম এই নাড়ুদার হোটেলে। খাবারের স্বাদ অন্যান্য হোটেলের থেকে
এমন কিছু ভালো নয়। বরঞ্চ বলতে গেলে বেশ কিছু হোটেলের থেকে খারাপই এবং দামিও বটে।
কিন্তু আমরা আটকে গেছিলাম ওই এক চামচ ঘিয়ে আর ঝাঁটা গোঁফের তলা থেকে বেরিয়ে আসা
আন্তরিক হাসিতে। খাবারের স্বাদের থেকেও বেশি সুস্বাদু ছিল নাড়ুদার আতিথেয়তা আর
আন্তরিকতা।
পড়াশুনা
ছিল না বিশেষ নাড়ুদার, কিন্তু ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল দুর্দান্ত। এই ঘি নিয়ে প্রশ্ন
করতে, বলেছিলো , “সবসময় পর্তায় পোষায় বললে চলে না। আমি জানি ওই আটানার ঘিয়ের জন্য তোরা
চোদ্দ টাকার ঝোল ভাত খেতে আসিস।“ আমি সেসময় শুকনো খেতে পারতাম না। আমার কাছে মাংস বা মাছের থেকে ঝোল
দিয়ে ভাত খাওয়াটা অনেক বেশি লোভনীয় নয় প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গাতেই
শুকনো মাংস বা কষা ডিম পাওয়া যেত। একদিন
নাড়ুদা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে , “ ডিম তো নিলি। খেতে পারবি না তো। একটু মাংসের ঝোল
দেব।” কথাটা মুখ নামিয়ে কানে কানে বলেছিলো নাড়ুদা, যাতে কেউ শুনতে না পায়। আমি মাথা নেড়েছিলাম। মাছ মাংসের দাম পিস্ পিছু ধার্য করা
যায় , কিন্তু ঝোল তো রাতের শেষে ফেলাই যায়। নাড়ুদা পরে বলেছিলো , “তোকে ঝোল দিতে
তাদের পাতে ঝোল কম দিই , যাদের প্লেটের ঝোল কলতলায় যায়।” ওই একটু ঝোল দিয়ে নাড়ুদা
আমায় আটকে রেখেছিলো পরের তিন বছর । কি
অদ্ভুত মানুষটার হিসাব।
সেদিন
তিন দিন নকশালদের ডাকা বাংলা বনধ ছিল। শহরে
এর প্রভাব বোঝা যায় না। কিন্তু
রাতের অন্ধকারে গ্রামের প্রত্যেক দোকানে লাল পোস্টারে হুমকি এসে পরে। আর এক জানা-অজানা আতঙ্কে পরের দিনের চিতা
টপকাতে নিঝুম হয়ে যায় গ্রামের বাজার। তিন দিন খাবো কি। কেউ বললো ট্রেনে চেপে কালনা শহর থেকে
লাঞ্চ করে আসবো। কেউ বললো বাড়ি চলে যাবো। আর
যেহেতু অধিকাংশ ছেলেই শহরের , তাই তারা বললো , “ধুর কিস্সু হবে না।” আগের দিন
রাতের খাবার পর নাড়ুদা ডেকে বললো , “বাড়িতে খাবার বানাবো। নিয়ে যাস বা খেয়ে যাস।” পরের দিন
সুনসান বাজারে ঘুরতে থাকা ক্ষুধার্ত ছেলেপিলের দলের পাশ কাটিয়ে স্বার্থপরের মতো
ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে এসেছিলাম, দুটো কারণে - এক নাড়ুদার আন্তরিকতা আর প্রতিদানে
নাড়ুদার সেফটি। গিয়ে
দেখেছিলাম শুধু আমরা নই , বেশ কিছু রেগুলার কাস্টমার আগেই এসেছে নাড়ুদার বাড়িতে
খাবার খেতে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাদেরও যারা নাড়ুদার খাবার বিস্বাদ বলে। সেদিন নয় নয় করেও প্রায় একশো জনকে
খাইয়েছিল নাড়ুদা।
একদিন
হঠাৎ-ঘোষিত রেল রোকোতে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছিলো গুপ্তিপাড়ার আগের স্টেশন বেহুলাতে। আমরা বন্ধুরা শুরু করেছিলাম রেললাইন
ধরে হাঁটা। রেল
ট্র্যাক ধরে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে যখন গুপ্তিপাড়া পৌঁছাই তখন বেলা তিনটে। খিদেতে পেট চুঁই চুঁই করছে। সব দোকান বন্ধ। মিষ্টির দোকানগুলো ঝাঁপ ফেলে ভেতরে
ঘুমোচ্ছে। নাড়ুদার
হোটেলে ফ্যান চালিয়ে নাড়ুদাও তখন ঘুমাচ্ছে। আমরা
গিয়ে তুললাম , “কিছু হবে নাড়ুদা।” ঘুম থেকে উঠে পিয়াঁজ দিয়ে আলুর ছোঁকা করে
দিয়েছিলো আর বেশি করে ঘি দিয়ে বলেছিল , “এখন তো আর ঝোল হলো না। একটু জল মেখে খেয়ে নে।” কি তৃপ্তি ছিল
সেই খাবারে।
একঘেঁয়ে
কাটা পোনার রগরগে ঝাল যখন বিরক্ত করে দিতো তখন মাঝে মাঝে নাড়ুদা নতুন নতুন মাছের
স্বাদ এনে দিতো। ছেঁড়া পরোটা আর ছানার জিলিপি
ব্রেকফাস্ট করে নাড়ুদার দোকানের পাশেই যেতাম সিগারেট খেতে। মাঝে মাঝে নিজেই এসে বলে দিতো , “আজ
দুপুরে দেরি করে আসিস। কিছু
খয়রা পেয়েছি সস্তায়। ” দেরি করে গেলে খালি হয়ে যেত হোটেল। আর তখন আমাদের জন্য
বেরিয়ে আসতো , ট্যাংরা , বোয়াল , খয়রা , চুনো। নাড়ুদার কাছেই প্রথম ভোলা মাছ খেয়েছি।
পাতে দিয়ে ভাগ্যিস বলে দিয়েছিলো মুড়ো
সাবধানে চেবাস , পাথর আছে। একদিন
কথায় কথায় শংকর মাছ খাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। কয়েকদিন পরে সকালে মেস বয়ে এসে বলে
গেছিলো আমাদের জন্য শংকর মাছ রান্না করে রেখেছে।
শুধু কি
মাছ , জীবনে প্রথম রাজহাঁসের ডিম নাড়ুদাই খাইয়েছে। কলেজ বেরোনোর পথে , একদিন পোল্ট্রির
দোকানে পেল্লাই ডিম দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিসের ডিম। নাড়ুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজহাঁসের
ডিম রান্না করে দেবে ? বলেছিলো , “ডিমের ডালনা খেলে বাত হবে। তার থেকে ভুরজি
বানিয়ে রাখবো রাতে আসিস।” সেদিন দুটো ডিমে পাঁচ জন পেট পুরে ভুরজি খেয়েছিলাম। নাড়ুদা বলেছিলো কচ্ছপের ডিম খাওয়াবে ,
কিন্তু সে আর হয়নি।
একবার
বৃষ্টি হয়নি অনেক দিন। গ্রামের
লোকজন কীর্তন দিয়েছিলো। যতদিন
না বৃষ্টি হবে , ততদিন কীর্তন হবে। নাড়ুদার
ভক্তি বিভক্তি কম ছিল। কিন্তু
মনে ছিল অফুরান ভালোবাসা, আর খুশি করার প্রবল ইচ্ছা। প্রথম দিন যখন শুরু হলো তখন আমরা
শহুরে ছেলেরা প্রচন্ড বিরক্তি দেখিয়েছিলাম। নাড়ুদা
বলেছিলো , “কাল আসিস। ফ্রি
তে খাওয়াবো।” পরের দিন দোকানে গিয়ে দেখি নাড়ুদা নেই। বৌদি বললো , “প্রসাদ বানাচ্ছে গো। তোমরা এলে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।”
দোকানের সামনেই বিশাল প্যান্ডেল করে কীর্তন চলছে। আর এক পাশে লোকে লাইন দিয়ে বসে খিচুড়ি
প্রসাদ খাচ্ছে। পেছনের
দিকে সামিয়ানা খাটিয়ে খিচুড়ি রান্না করছে নাড়ুদা। আমাদের দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। সেখানে গিয়ে গা ঘুলিয়ে উঠলো। বিশাল বিশাল চারটে কড়াই তে খিচুড়ি
রান্না হচ্ছে। আর পাশে
চারটে বিশাল বিশাল মাটির গর্তে সেই খিচুড়ি ঢালা হচ্ছে। সেখান থেকেই বালতি করে তুলে তুলে
পরিবেশন করা হচ্ছে খিচুড়ি। “নাড়ুদা,
এ খিচুড়ি খেতে পারবো না। ” আমাদের ইতস্তত করতে দেখে নাড়ুদা বললো , “ওরে ওই গর্তে
আগে দু পরতা নতুন মাদুর পাতা হয়েছে। তার
ওপর খিচুড়ি গিয়ে পড়ছে। তোরা বরঞ্চ পাতা নিয়ে বস। আমি এই কড়াই থেকেই সোজা তুলে দিচ্ছি।”
আমরা গিয়ে শালপাতা নিয়ে বসলাম মাটির ওপর। হাগতে
বসার মতো করে বসতে হয়। শালপাতার
থালা কানা উঁচু নয়। খিচুড়িও
আঁট নয়। মাঝখানে যখন এসে পড়লো তখন খিচুড়ি
খাওয়ার থেকে গড়িয়ে পড়া আটকানোর প্রচেষ্টাই ছিল বেশি। কিন্তু সেই স্বাদ আজও লেগে আছে জিভের
মনে।
কলেজ শেষ
হয়। মেসজীবন শেষ হয়। আমরা
নোঙ্গর তুলে নানা ঘাটে নোঙ্গর ফেলি। “আবার
দেখা হবে ” বলে চলে এসেছিলাম , বছর আটেক দেখা হয়নি নাড়ুদার সাথে। কলেজের স্মৃতি আমার বিশেষ মধুর নয়। তাই নস্ট্যালজিক হতে বিশেষ ভালোও লাগে না। ফিরে যেতে সত্যি ইচ্ছা করে না ওই
অন্ধকার চারটে বছরে। কিন্তু
ওই বারোশো দিনে কিছু বন্ধু ছাড়া সত্যি যদি কেউ পিছু ডাকে , সে নাড়ুদা। এই আত্মিক টান অদ্ভুত এবং অনেকের কাছে
নিতান্ত খেলো এবং বিনয়বিলাসী মনে হতে পারে। কিন্ত
যে ভোজনবিলাসী মানুষ মায়ের হাতের রান্না ছেড়ে অনেকদিন থাকে , আর নাড়ুদার মতো কেউ
এসে গরম ভাতে ঘি দিয়ে যায়, তবেই সে বুঝতে পারবে এই টানের মহিমা. আজ কেতাদুরস্ত
আইরকন্ডিশান হোটেলে কাঁটা চামচে খাবার মুখে তুলতে গিয়ে দেখি সব আছে, কিন্তু সেই
ছেঁড়া গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়া মানুষটার ঘেমো মুখ থেকে বেরোনো “আরেকটু ঝোল দেব “
কথার আন্তরিকতা কোথাও নেই। তাই বাঁশের ছাউনির খোলা দেওয়ালের মুছে যাওয়া দিন গুলি
আজও সত্যিই মাঝে
মাঝে পিছু ডাকে।