Saturday, April 28, 2018

৫০) আধ্যানের ডায়েরী - দেশে বিদেশে ( শেষ পর্ব )

এতকিছু হওয়ার পরের দিন সব ঠিক।  এবার আবার মাসির বাড়ি যাওয়ার পালা।  ওখানেই বাকিটা সময় থেকে আবার আমি আমার দেশে। বাকিটা সময় ওখানে আর বেশি কিছু ঘটেনি। অনেক কিছু শব্দ শিখেছি।  দিদা দিন রাত আমাকে বলতে থাকতো চল চল চল।  আমিও একদিন জিভটাকে মুখের ওপরের দিকে লাগিয়ে আওয়াজ করতেই বেরিয়ে এলো চ।  দু তিনবার করতেই বেরোলো চ-চ-চ।  তখন দিদার হাতই ধরা ছিল।  দেখলাম দিদাও বললো ঠিক আছে চ।  দিয়ে এগিয়ে গেলো।  আমি বুঝলাম চ মানে এগিয়ে যাওয়া।  তাই যখনিই কাউকে কোথাও নিয়ে যেতে হতো বলতে আরম্ভ করলাম চ-চ-চ।  দেখলাম সবাই ঠিক ঠাক এগিয়ে যাচ্ছে।  

একদিন  মাসির সাথে বসে বসে চু চু টিভি দেখছি।  সেখানে বলছিলো এস ফর ষ্টার।  আমার বেশ লাগে ষ্টার বলতে।  আমি বললাম এস - ষ্টার।  “ফর” বলতে বেশ প্রব্লেম , ঠোঁট টোট নাচাতে হয়।  মাসি আমার দিকে ঘুরে বললো।  “সিস্টার ? “ আমি বললাম এস-স্টা-আ-আ-র। মাসি তো খুব খুশি।  মাসি ভেবেছে আমি নাকি মাসিকে সিস্টার বলছি।  ভেবে খুশি হলেই হলো।  তারপর থেকে আমি মাসিকে দেখলেই বলতে আরম্ভ করলাম এস-ষ্টার।  কিন্তু ধীরে ধীরে আমার কথাও পাল্টে বেরিয়ে আসতে লাগলো সিস্টার।  সবাই খুব খুশি।  আমিও খুশি।  

এবার মায়ের বন্ধুদের পালা।  একদিন রাতে আমরা আবার টোটো চেপে একজনের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম।  যাবার আগে মা বলে দিয়েছিলো কোনো ঝামেলা না করতে।  মা নাকি বহু বছর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে।  বাবার কেসটা কেঁচিয়ে দেওয়ার পর মা বেশ চাপে ছিল।  যে লোকটা আমাকে টোটো থেকে কোলে তুলে নিলো সেটাকে দেখিয়ে মা বললো , ‘ এটা কাকু-মামা’ । সে আবার কি।  সেই কাকু মামা নাকি মা বাবার বিয়ের কারণ।  আর বাবা মা দু তরফেরই বন্ধু।  ইম্পরট্যান্ট পিপল।  বেশ আদর টাদর করে দিলাম।  সবাই খুশি।  ওখানে গিয়ে দেখি আমার তিন তিনটে বন্ধু।  খুব খেললাম, কিন্তু ঝগড়া বাঁধলো সেই গাড়ি নিয়ে। ওরাও ছাড়বে না।  আমিও ছাড়বো না।  ছাড়বো কেন ? গাড়ি গুলো কি সুন্দর।  আমার যেটা ইচ্ছা সেটা আমি নেবো।  কেউ যেন ঝামেলা না করে। ওরা করতে এলো আমিও ঝাঁঝিয়ে দিলাম।  কিন্ত এরা তো দেখি ফাইট ব্যাক করে।  কিন্তু আল্টিমেটলি আন্টি এসে সব ঠিক করে দিলো।  পুরো ট্রিপটাতে আমি শুধু বাবাকে বার বার সরি বলে গেছি আর মা আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে গেছে।   
সিস্টার একদিন আমাকে কোলে করে বারান্দায় ঘুরছিলো।  দেখি একটা লোক টু লিটিল মানকি নিয়ে ঘুরছিলো।  ঠিক আমাদের জানলার সামনে আমাকে দেখতে পেয়ে , থেমে গেলো। দুটো মানকিও থেমে গেলো।  আমি জানি মাংকিরা বেড এ জাম্প করে।  মাংকি গুলো দারুন ছিল কিন্তু লোকটাকে আমার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিলো না।  কি ভাবে মাংকি গুলোকে বেঁধে রেখেছে।  আমি টেনশন করছিলাম যে যদি মানকি গুলো আমার বেড এ উঠে এসে জাম্প করতে চায়।  অনলি মাংকি কে এলাও করতে পারি।  কিন্তু ওই লোকটাকে নয়।  কিন্তু কাউকেই ঢুকতে দিলো না মাসি।  ওরা ওখানে বসে বসে কত খেলা দেখালো।  দুটো মাংকি  কি সুন্দর।  আমি যদি ওদের সাথে চলে যেতে পারতাম খুব ভালো হতো।  বললামও, কিন্তু ওরা নিয়ে গেলো না।  

ফেরত আসার দু  দিন আগে  আমার ঠাম্মার স্কুলে একদিন যাওয়ার প্ল্যান ছিল।  ঠাম্মার নাকি আমার মতো ডে কেয়ার আছে।  সেখানে অনেক অনেক ছেলে আছে আমার মতোন।  আমি যখন আমার বাড়িতে ছিলাম।  তখন থেকে প্ল্যান করছিলো আমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য।  কিন্তু সময়ই হয়ে ওঠেনি।  তাই সেদিন বাবা আমাকে নিয়ে সোজা স্কুলে নিয়ে চলে গেলো।  বিশাল একটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি ঠাম্মা বাইরে দাঁড়িয়ে।  আমাকে কোলে করে নিয়ে ঠাম্মার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসলো।  আর সাথে সাথে এক গাদা টিচার এসে ঘরে ঢুকে পড়লো।  কি সাংঘাতিক ব্যাপার।  এতো লোক এইটুকু যায়গায়। সবাই আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে।  সবাই আমাকে কোলে নেবে।  জায়গা ছোট্ট।  হাঁফ ধরে যাচ্ছিলো। আর অতগুলো নতুন লোক। মনে হচ্ছিলো সবাই কামড়ে দেবে।  সবাই অথচ আদরই করছিলো।  আমি থতমত খেয়ে, ভয় পেয়ে, খাবি খেয়ে  কেঁদে ফেললাম।  এগেন আই অ্যাম সরি ঠাম্মা।  

বুঝতেই পারছিলাম ঠাম্মা সবার কাছে আমার সোশ্যালাইজিং স্কিল নিয়ে অনেক ভালো ভালো বলে এসেছে।  কিন্ত কি করবো , আমারও তো একটা লিমিটেশন আছে।  আমি একদম ঘাবড়ে গেছিলাম সেদিন।  খুব ঘাবড়ে গেছিলাম।  ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠাম্মা আমাকে কোলে করে নিয়ে ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিলো।  তখন আমায় পায় কে।  আমিও দৌড়ে বেড়াচ্ছি।  আর সবাই আমার সাথে সাথে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।  এর মধ্যে একজন এগিয়ে এসে আমাকে চকোলেট দিলো।  কিন্তু আমার নজর তার বুকে আটকানো পেন টার দিকে।  পেন টা নিয়ে আমি সব দেয়ালে লিখে দিয়ে চলে এলাম।  ওটাই থাকুক ওদের স্মৃতি হয়ে। 

এই পেন নিয়ে আরেকদিন তুমুল কান্ড হয়েছিল।  বাবা মা আমাকে নিয়ে কোনো একটা অফিসে গেছিলো।  ছোট্ট জায়গা।  অনেক টেবিল।  অনেক লোক ঘোরাফেরা করছে।  মা দেখলাম এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে দৌড়াদৌড়ি করছে আর বাবা আমাকে চেপে ধরে এক জায়গায় বসে আছে।  আমার কি বিরক্ত লাগছিলো।  কিন্তু কিছুতেই ছাড়ছিল না।  প্রত্যেক টেবিলে যে যে লোকগুলো বসে ছিল সবার হাতে একটা করে পেন ছিল।  পেন দিয়ে ওরা অনেক কিছু লিখছিলো।  শুধু দেখছিলো না আমার দিকে।  আমি একের পর এক টেবিলের সামনে গিয়ে জুল জুল করে তাকাচ্ছিলাম পেনের দিকে।  হাত বাড়াচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছিলাম না।  আমি তো গুড বয় তাই বায়না করছিলাম না।  আমি করিনা বায়না।  আই ডোন্ট লাইক ন্যাগিং।  আই ট্রাই , ট্রাই হার্ডার, তারপর ক্ষমা করে দিই।  কিন্তু হঠাৎ করে দেখি একজন বাবার কাছে এসে একটা পেন এগিয়ে দিলো, আর একটা কাগজ।  লোকেদের ক্ষমা করতে পারি।  কিন্তু বাবাকে নয়।  হামলে পরে পেন টা নিয়ে অনেক কাগজের ওপর লিখতে যাচ্ছিলাম, লোকটা আঁতকে উঠে কাগজ টেনে নিয়ে কেটে পড়লো।  বাবা কোনো রকমে আমাকে টেনে এনে বসলো।  আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে অপমানে মুখ চোখ লাল হয়ে কান্না বেরিয়ে এলো।  তখন একটা লোক এসে আমাকে একটা পেন দিয়ে শান্ত করলো।  

পেনের গল্প অনেক।  সব লিখলে সবাই বোর হয়ে যাবে।  কিন্ত সবথেকে বড় পেন হলো সবাইকে ছেড়ে চলে আসার পেন।  যেদিন চলে আসছি, সেদিন এয়ারপোর্ট এ সবাই কাঁদছিলো।  সব্বাই।  আমাকে ছাড়তে এসেছিলো দিদা , দাদু আর সিস্টার মানে মাসি। আমরা বাইরে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম কারণ অনেক আগে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম।  যখন আর বাইরে অপেক্ষা করা যাচ্ছে না।  তখন আবার কার্টের ওপর বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে আমরা যখন গেটের কাছে পৌছালাম তখন দেখি আমাকে আর মা কে কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।  এদিকে বাবা ঢুকে গেছে।  আমি পড়লাম ফাঁপরে।  তাহলে কি বাবা এবার আমাকে আর মা কে ছেড়ে আবার চলে যাবে।  জীবনের প্রথম এক বছর বাবাকে পাইনি।  সেই ভয়ঙ্কর সময়গুলো এখনো আমার মন থেকে যায়নি।  আর আমি চাইনা বাবাকে ছেড়ে থাকতে।  কিন্ত বাবার অঙ্গভঙ্গি দেখে মোটেই মনে হচ্ছিলো না যে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। 

বেশ কিছুক্ষন পর বাবা আবার বেরিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে ভেতরে চলে এলো।  পিছন ফিরে দেখলাম দাদু দিদার চোখে জল।  আবার আমি, বাবা আর মা।  প্লেনের গল্প আর নতুন করে করলাম না।  সেই এক ভাবেই অনেক কষ্ট সহ্য করে আমরা যখন আবার ফিরে এলাম তখন এখানে ঠান্ডা।  বাবার দেশে কি সুন্দর ওয়েদার ছিল।  আমাকে জ্যাকেট পড়তে হতো না , সর্দি নিয়ে হাঁসফাঁস করতে হতো না, খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতাম, গাছে পাতা ছিল , একটু ধুলো ছিল বটে , কিন্ত সব কিছু কি সুন্দর ছিল।  সবথেকে সুন্দর ছিল মানুষজন।  কত লোক ছিল আমার সাথে খেলার জন্য।  কত লোক ছিল দেখার জন্য।  যখন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাড়ির জন্য গাড়িতে চাপলাম তখন রাস্তার দুপাশ ধরে শুধু গাড়ি আর গাড়ি।  নেই অটো , নেই টোটো , নেই সাইকেল , নেই ভ্যান , নেই বাইক আছে শুধু গাড়ি গাড়ি আর গাড়ি।  

বাড়ি ফিরে প্রথমে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো।  সব চুপ চাপ।  শান্ত।  কোথাও কোনো আওয়াজ নেই।  নেই হর্নের প্যাঁ পোঁ।  কোথাও যেন কিচ্ছু নেই।  আমার পুরানো খেলনা গুলো ভুলে গেছিলাম।  আবার এক এক করে খেলনা গুলো মনে করতে লাগলাম।  আমার ঘর আমার বিছানা , আমার টিভি , আমার ব্যালকনি , আমার গাড়িগুলো সব আমার।  এটা আমার জায়গা।  আমার কাজের জায়গা।  আমার বড় হওয়ার জায়গা।  এখানেই আমায় থাকতে হবে।  আমি থাকবো। আর থাকবে বাবা আর মা।  আচ্ছা বাবা মা ও তো দাদু দিদা দাদু ঠাম্মাকে ছেড়ে চলে এসেছে।  আমার যেরকম কষ্ট হচ্ছিলো ওদেরও কি হচ্ছেনা।  আমি জানি বাবাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট।  আমি মা কে ছেড়ে এক রাত থেকে দেখেছি।  খুব কষ্ট লাগে।  আর এখন খুব কষ্ট লাগছে ।  খুব ফাঁকা লাগছে।  কিন্তু দ্যাট ওয়াস মাই ভ্যাকেশন।  পরের ভ্যাকেশন বাবা বলেছে আবার পরের পরের দূর্গা পুজোর সময়।  এবার যে সব ভুলত্রুটি করেছি।  পরের বারের আগে সব ঠিক করে নিতে হবে।  এর পরের বার গিয়ে আরো মজা করতে হবে।  অনেক অনেক মজা। আর  পরের বার সবাই কে গিয়ে বাংলায় বলতে হবে , “আমি আধ্যান - আমি আবার এসেছি। ”   


আধ্যানের ডায়েরির আগের পাতাগুলো 



No comments:

Post a Comment