Tuesday, October 17, 2017

জ্ঞান দা ও গ্রীন কার্ড


"উফ তোরা শুধু ফলটাই দেখিস। চাষীর মাসল টাও একটু দেখ। " জ্ঞান দা ভুরু কুঁচকে বলল, "আর এখনো তো বছর খানেকের গল্প। এখনি পার্টি পার্টি করে নাচলে হবে। রিজেক্ট  হলে পয়সা ফেরত দিবি তো?" ইনি আমাদের জ্ঞান দা।  প্রচুর জ্ঞান। মোটর থেকে মটর, ব্যাটার থেকে বাটার , চড়ুইপাখি থেকে চড়ুইভাতি কোনো কিছুতেই তার জ্ঞান কম না।  ভালো নাম পৃথ্বীশ চক্রবর্তী। আমেরিকান নাম প্রিট  - এর বেশি বলাতে গেলে বেজায় সমস্যা , তাই কয়েকদিন চেষ্টা করেই মা বাপের দেওয়া নাম কথ্য ভাষা থেকে বিদায় দিয়েছে। কিন্তু আমরা যখন অন সাইটে এসে তার সঙ্গে প্রথম আলাপ হলো তখন বুঝতেই পেরেছিলাম এরকম মাল দুনিয়াতে দুটো নেই।  সব কথায় জ্ঞান দেয়। 

তা সেই জ্ঞান দার গ্রীন কার্ড হয়ে গেছে। মানে আমরা তাই মানি। কিন্তু জ্ঞান দার ভাষায় এখনো অনেক দিন বাকি। "ওরে সবে তো প্রায়োরিটি  ডেট টা কারেন্ট হয়েছে।" দীপক প্রশ্ন করলো, "তুমি এপ্লাই করেছ কবে?" "বছর ছয় হলো।" আনমনা জ্ঞান দার উত্তর।  "ভ্যাজাল বোকো না তো। " প্রতীক খিচিয়ে উঠলো, "এই তো কয়েক দিন আগেই করলে। আমরা তখন সবে জয়েন করেছি অফশোরে।" মুচকি হেসে জ্ঞান দা বলল, "কত বছর হলো এই কোম্পানি তে ভাই?" তাই তো, ক্লায়েন্ট আর অনসাইটের  খিস্তি খেয়ে খেয়ে ৬ বছর হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি প্রতীক । বলল, "তাহলে এত বছর লাগে? আমরা তো তাহলে সব বুড়ো হয়ে যাব।" "না সবার লাগে না।  আমার মত  ক্যালাস দের একটু বেশি লাগে। আর একটু ঢাল।" গ্লাস টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে জ্ঞানদা বলে চলল, "সত্যি অনেক দিন হয়ে গেল. আমারই ভুল ছিল মাঝখানে বিয়ে করতে চলে না গেলে এতদিনে হয়ত হয়ে যেত।"
"বিয়ে করতে গেলে কি ভিসা ক্যানসেল হয়ে যায়? আবার এপলাই করতে হয়?" প্রতীকের চোখ বড় বড় , উনত্রিশে পা দিয়েছে তো।  "ধুর বললাম না ক্যালাস ও হতে হয় আমার মত।" "তুমি মামা একটু খুলে বল তো দেখি। প্রসেস টা কি?" প্রতীক উত্তেজিত,  জ্ঞান দা শীতল পাটি ,"আগে একটা পাটিয়ালা পেগ বানা। নাহলে জমছে না।  অনেক বড় গল্প। " গ্লাসটা হাতে নিয়ে বিন ব্যাগে হেলান দিয়ে শুরু করলো জ্ঞানদা।

"প্রথমে তোর কোম্পানি কে পেপার এ অ্যাড দিতে হবে যে তাদের একটা পজিশন খালি হয়েছে। এবং তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে যদি কেউ এপ্লাই করে।  সাধারণত আমেরিকার যা অবস্থা আমাদের দেশীদের থেকে বেশি জানা লোক জন পাওয়া খুব অসুবিধা। তাই বিশেষ কেউ এপলাই করে না।"  "এই তো গন্ডগোল করলে খুড়ো। যে দেশে মাইক্রোসফট আপেল এর মত কোম্পানি আছে সে দেশে তোমার আমার কাজ করার লোকের অভাব?" "যা অ্যাড দিয়ে দেখ।  কটা লোক পাবি আমাদের মত দশটা জিনিস একসাথে জানে, সাথে আবার এক্সপেরিয়েন্স আছে এবং সস্তা।  এরা স্পেশালিস্ট।  একটা জিনিস ধরে সারাজীবন বসে থাকে। আমাদের মত সব জিনিস হাতরায় না।  কিন্তু এখন যুগ মাল্টি-টাস্কিং এর।  এতেই বাছাধনরা উল্টোয়। এরা এতটাই......" "আচ্ছা ছাড়ো তুমি তোমার কথা বল।" আমি বাধা দিয়ে বললাম। "হ্যা আমার কথাই বলছি। আমার এই কোম্পানিটি  তখন খুব ছোট ছিল।  মোটে কুড়িটি লোক এদেশে আর জনা একশ দেশে। যাদের ভিড়ে তোরাও নাম লিখিয়েছিলিস।

তখন আমার তখনকার বস - মিস্টার কুট্টি। অনেক ভেজিয়ে ভেজিয়ে বললাম এবার গ্রীন কার্ড টা এপলাই করুন? তা সে বলল কালকের Detroit Free Press এ ad দিয়েছে। যদি লোক মেলে তাহলে এবারের মত হলো না।  না মিললে আমার নামে গ্রীন কার্ড ফাইল করবে।" "তাহলে তুমি কি এখনো সেই পোস্ট এই কাজ করছ যার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল?" "না ঠিক সেটা নয়।  কিন্তু ওই বিজ্ঞাপনে যে qualification এর লোক লাগত।  আমি তখনি সেই দক্ষতা অর্জন করেছিলাম। " এমন ভাবে বলল যেন অর্জুনের ধনুর্বিদ্যা।  " আমি তো প্রমাদ গুনছিলাম, যদি কোনো মাল এসে রেসুমে জমা দিয়ে আমার সবুজ বাতি লাল করে বেরিয়ে না যায়. কিন্তু কপাল আমার খারাপ হলেও ঠিক সময় সাথ দিয়েছিল।  সময়টা ডিসেম্বর। হ্যাপি হলিডে সামনেই ছিলো । দু তিনটে খাজা গজা যারা এলো তারা সবাই একে কে বাতিল হয়ে গেল। আর আমার লেবার ফাইল করা হলো।" "লেবার?" "পার্মানেন্ট লেবার সার্টিফিকেশন। তোদের ভিসা হওয়ার সময়ও একই জিনিস ফাইল করতে হয় কিন্তু সেটা temporary এরা এটাকে PERM বলে। এই ফর্ম দিয়েই কোনো এখানকার কোম্পানি কোনো বিদেশী কর্মী কে এখানে কাজ দিতে পারে।" "আর যারা টপকে আসে তাদের?" "তাদের তো জামাই আদর।  ওদের কথা ছাড় আমাদের আর চীনের জন্য যত কিছু নিয়ম কানুন।"

"তা কতদিনে তোমার লেবর approve  হলো?" "বেশিদিন লাগেনি। ৪ - ৫ মাসের মধ্যে এসে গিয়েছিল। তারপর যখন ই-১৪০ ফাইল করলাম তখন আমায় একটা ডেট দিল, মানে আমার লেবার ফাইল ডেট।  বলল ওটা রোজ চেক করতে। নতুন নাম দিল - প্রায়োরিটি ডেট। এটাই সবথেকে জটিল ও গুবলেট ব্যাপার।" "ডেট মানে তারিখ তো ? তোমাকে তারিখ দিল মানে।" "তোকে একটা তারিখ দেবে ধর সেপ্টেম্বর ২০০৫ হচ্ছে তোর তারিখ।  এটা তোর প্রায়োরিটি ডেট।  আর ভিসা বুলেটিন এ একটা ডেট থাকবে যেটা কারেন্ট ডেট। তোর প্রায়োরিটি ডেট যখন কারেন্ট ডেট হবে তখনই তুই পরের স্টেজ এ পৌছবি। কিছু বুঝলি?" "ঘেঁটে ঘ।", আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।  "ধুর তোরা দেখছি আমার থেকেও গাম্বাট। ল্যাপটপ টা বারা , তোর পায়ের কাছে পরে আছে।" আমি বাড়িয়ে দিতে বলল , " তুইই খোল বরঞ্চ , বডি ৪৫ ডিগ্রী এঙ্গেল এ থাকলে মাথাটা দিয়ে ৯০ ডিগ্রী বানালে স্ট্রেসটা বেশি পরে।  নিজে কর , শিখবি বেশি।" আরো ঘেঁটে গিয়ে ল্যাপটপ খুলতেই পাসওয়ার্ড চায়।  আমি জ্ঞান দার দিকে তাকাতে বলে , "নিয়ে আয়।" মুঠোটা উল্টো করে মধ্য আঙ্গুলের পেছনের গাঠ টা ফিঙ্গারপ্রিন্ট  scanner এ ঘষে দিতেই ল্যাপটপটা অন হয়ে গেল।  আমি বিষম চমকে উঠলাম। "ওটা তো ফিঙ্গার প্রিন্ট scanner?" জ্ঞানদার সেই মুচকি হাসি, "ওটা বায়োমেট্রিক scanner , তুই নাক ঘশলেও সেটাই তোর আইডেন্টিটি হয়ে যাবে।  কিছু পরবি না তো জানবি কথা থেকে। সিকিউরিটি দেখলি? একে বলে।" বিজয়ীর হাসি দিয়ে বলল, "ভিসা বুলেটিন লিখে গুগল কর।"

আমি জায়গায় পৌছে গিয়ে দেখলাম দুটো মাসের ক্যালেন্ডার দেওয়া আছে।  এই মাসের আর পরের মাসের। সবাই আমার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ল, "দুটো কালেন্ডের দেখছি যে।" "ওই দুটোই আমার গত ছ বছরের জগাই আর মাধাই। ওখানেই তুই দেখতে পাবি তোর এই মাসে কোন ডেট টা কারেন্ট আর কোন ডেট টা সামনের মাসে কারেন্ট হবে।  এমাসের টা বিশেষ কোনো কাজের নয়।  কিন্তু পরের মাসের যে ডেট টা কারেন্ট হবে সেটা যদি তোর প্রায়োরিটি ডেট এর পরে কোনো ডেট হয় তখন তুই আগে বাড়তে পারবি। এবার বুঝলি?" প্রতীক হাত বাড়িয়ে মাউসপ্যাডে পাতাটা ওপর নিচ ওপর নিচ করে সব গিলছিল। এবার বলল, "কিন্তু এখানে দেখব কি ভাবে। এসব কি? employment  based এক দুই তিন চার.. একি পুরুত দেরও গ্রীন কার্ড দেয় নাকি?"

"হে হে বাবা। সবারই হয়।  এখানে যারা পুরুত তারাও উচ্চশিক্ষিত। কিছু একটা পাশ টাশ ও করতে হয়।  ঠিক ঠাক জানিনা।" আমাদের চোখ আরো বড় বড়।  না না পুরুতের গ্রীন কার্ড এর জন্য নয়।  জ্ঞান দার জ্ঞানের বাইরে কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার জন্য। জ্ঞান দা তোয়াক্কা করলো না , বলে চলল ," ওই এক দুই তিন এর মানে আছে। প্রায়োরিটি আর কি।  এক হলো যারা বড় বড় লোক তাদের। মানে প্রফেসর, রিসার্চ করা লোকজন বা নানা দক্ষতায় পারদর্শী ইত্যাদি।" "আমিও দুটো ভুরু আলাদা নাচাতে পারি। আমিও পাব তাহলে।" "তোমার ভুরু আমার উরু দিয়ে পিষে দেব।  ফাজলামো করিস না।" জ্ঞান দা যখন জ্ঞান দেয় তখন তাকে বার খাওয়াতে পারো কিন্তু ফচকেমো চলবে না।  "এর মানে হলো যারা এই দেশের দুধে চিনি ঢেলে মিষ্টি করতে  পারবে কিন্তু দুধ উপচে যেন না যায়।  বুঝলি। তবে হ্যা ম্যানেজার রাও আছে এই কেটাগরি তে।  যাদের দ্বারা সত্যিই কিছু হয় না. কিন্তু কি আর করা যাবে।" আমি আর থাকতে পারলাম না, "তুমিও তো ম্যানেজার।" "আমার কথা ছাড়, আমি তো সর্বভূতে বিরাজমান। কি করিনা বল।  একটা কোড লিখতে গেলে তোদের constipation হয়।  তখন লেখে টা কে? " কথা টা গিলে নিলাম।
"তা এই প্রথম সারির লোকজন প্রথমে পায়. তার পরে দ্বিতীয় সারিতে থাকে মাস্টার ডিগ্রী আর তৃতীয় সারিতে ব্যাচেলর ডিগ্রী আর বাকি যারা যারা গাধা গরু।  আমার তোর মত."  প্রতীকের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল কারণ আমরা বাকিরা সব মাস্টার ডিগ্রী। "এই তৃতীয় সারিতে ভিড় প্রচুর। তাই অপেক্ষাও প্রচুর। প্রথম প্রথম রোজ সকালে উঠে একবার করে দেখতাম। তারপর ইন্টারনেট explorar এর হোম পেজ করে রেখেছিলাম। এখন তো মোবাইল app হয়ে গেছে। গত মাসে সেটাই টুং করে জানিয়ে দিল  সামনের মাসে আমার ডেট কারেন্ট হবে। ব্যাস লেগে পরলাম ই-৪৮৫ ফাইল করার কাগজ পত্র ঘাটাঘাটি যোগার যান্ত্রি করতে।"

আমি বললাম, "খুব কি তাড়াহুড়ো করে করার দরকার আছে?" "যে মাসে তর ডেট কারেন্ট হবে সেই মাসের শেষ তারিখের আগে এই ফর্ম সাবমিট হয়ে যাওয়া চাই. নাহলে আবার অপেক্ষা।" "কেন? পরের মাসেও তো তোমার ডেট কারেন্ট থাকবে। ডেট কি আবার পেছোয় নাকি?" "হে হে বাবা। এটা আমেরিকা। এরা সারা দেশের ঘড়ি বছরে দুবার পেছিয়ে দেয় তো ডেট তো কোন ছাড়।  আর এর চক্করেই তো আমার গেল।" "কেন ? তোমার কি করে গেল?" "আমি তখন দেশে। বিয়েটা পরবি পর ঠিক সেই মাসেই পড়ল যখন আমার কারেন্ট ডেট প্রায়োরিটি ডেট হলো।" "কেন ওখান থেকে এপলাই করা যায় না?" "না।  এই দেখ না।  এই ফর্ম ফাইল করার কিছুদিন পরেই বায়োমেট্রিক এর জন্য নোটিশ এসেছে। মানে ওই দশ আঙ্গুলের ছাপটাপ আর কি।  তো তার জন্য তো আমাকে থাকতে হবে।  তার ওপর মেডিকাল করতে হয়।  যদি কিছু ভ্যাকসিন ট্যাকসিন নিতে হয়।  মোদ্দা কথা এখানে না থাকলে কিছু হবে না।  মধুযামিনী করে যখন গিন্নি কে নিয়ে এখানে ফিরে এলাম তখন আমার কারেন্ট ডেট দু বছর পিছিয়ে গেছে। আর সেই দু বছর কভার হতে আরো দের বছর কেটে গেল।"

"বাপরে। এত লম্বা গল্প।" "RFE আর RFI এর কথা তো বলিনি। এই যতগুলো ফর্ম বললাম। প্রত্যেকটাতেই প্রায় একই রকমের documentation করতে হয়।  কিন্তু প্রত্যেক স্টেজ এই গভর্নমেন্ট থেকে RFE বা Request for Evidence আর RFI বা Request for Information আসতে পারে। তাতে আবার অতিরিক্ত লেখালেখি বা অতিরিক্ত কাগজপত্র দিতে হয়।  এবং হা , যেকোনো মুহুর্তে যেকোনো ভুলে ক্যানসেল হয়ে যেতে পারে। তাই বলছি এখন বেশি নাচিস না।  এখনো অনেক প্রসেস বাকি। ". আমি বললাম, "আবার কি? "

"এর পরেও আছে।  Adjustment  of  Status বা ই-৪৮৫ এর approval এর পর EAD বা Employment Authorization Card এর এপলাই করতে হয়. সেটা এলে তবে তুমি যেকোনো কোম্পানি তে চাকরি করতে পারো। আর এটা ভেবনা যে বাকি জীবনের জন্য তুমি সেফ।  EAD তেও তুমি যদি তিন মাসের ওপর বেঞ্চ এ বসে থাকো তাহলে বিদায়।" "মানে গ্রীন কার্ড মানেই টোটাল স্বাধীনতা নয়?" "না চাঁদু।  যতক্ষণ না সিটিজেন হচ্ছ ততদিন তুমি সেই ঘাপটি মেরে ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার করে যাও।" "আর সিটিজেন হলে তারপর?" "তারপর আর কি বেশি টাকা চাইবে কোম্পানির থেকে। আর কোম্পানি বলবে তোমার কাজ তো ইন্ডিয়া থেকে অফশোর কে দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়।  তোমাকে বেশি পয়্সা দিয়ে রাখব কেন? বলে টাটা বাই বাই। " "যাহ বাবা। তাহলে এত কষ্ট করে এখানে পরে থাকব কেন। দেশেই যাই."
জ্ঞান দা  মুচকি হেসে বলল , "স্কচ টা খা।  বেশি ভাবিস না। " 



No comments:

Post a Comment