আজ আধ্যানের
বাবার জন্মদিন। হ্যা, আজ থেকে ঠিক তিনশো পঁয়ষট্টি
দিন আগে আধ্যানের একটা বাবা হয়েছিল। আঠাশ ঘন্টা
ধস্তাধস্তির পর যখন আধ্যান বেরিয়েছিল তখন বাবাই আধ্যানের আম্বিলিকাল কর্ড কেটেছিল। ঠিক বেরোনোর কয়েক সেকেন্ড আগে এক সাথে আধ্যানের
আর আধ্যানের মায়ের পালসরেট জিরো হয়ে যায়। মেলার
আর মেলানোর জন্য যেন দুজনেই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করছিলো। শেষমেশ যখন রক্তাক্ত এক পিন্ড গলা ফাটিয়ে পৃথিবীর
বুকে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো তখন তার বাবা দৌড়াদৌড়ি করছিলো ক্যামেরা নিয়ে। ডাক্তার নার্সরা হাসাহাসি করছিলো টেক স্যাভির এক্সট্রিম
নমুনাটাকে নিয়ে। কিন্তু আধ্যানের বাবার কোনো
হেলদোল ছিল না। বমি উঠে আসা এমনিওটিক ফ্লুইডের গন্ধ
চাপতে
নাকে মাস্ক পরে আর পারফিউম স্প্রে করে সেও আঠাশ ঘন্টা আধ্যানের মায়ের সাথে ছিল । তার কাছে এই টিক টক করে চলে যাওয়া সময় ধরে রাখার
একমাত্র উপায় তার ক্যামেরা। তাই কে কি বললো
তার বিশেষ এসে যায় না।
আধ্যান জন্মানোর
আগে সে বাণী বসুর অষ্টম গর্ভ পড়ছিলো। সেই সময় আধ্যান পেটের মধ্যে ঘুঁষি লাথি চালাচ্ছিল।
আধ্যানের মায়ের পেটে হাত দিয়ে সে আধ্যানের খেলা অনুভব করতো তখন সদ্য পড়া অষ্টম গর্ভের
ধারাবিবরণীর মতো তার মনে হয়েছিল আধ্যান কিছু বলতে চায়। একদিন আনমনে লিখতে শুরু করেছিল " আমার ঘর
", আধ্যানের ডায়েরির প্রথম পাতা। পয়লা মে
দু হাজার ষোলো, আধ্যান আসতে তখনও সাতাশ দিন বাকি। সেই লেখা যখন আধ্যানের মা কে শোনালো তখন আধ্যান
যেন ,"ঠিক বলেছো" বললো।
আধ্যানের জন্মের
চল্লিশ দিন পর আধ্যানকে ছেড়ে আধ্যানের বাবা
দেশে ফিরে আসে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে অক্টবরের মধ্যে আবার ফিরে যাবে সে তার ছোট্ট
আধ্যানের কাছে। জে এফ কে এয়ারপোর্ট থেকে আবুধাবির
ফ্লাইটে সে একে সবাইকে মাফ করে দেয়। প্রথমেই
মাফ করে বাবাকে। কারণ বাবা না হলে বোঝা যায়না
বাবার সমস্যা। আঠাশ ঘন্টার ধস্তাধস্তি চোখে
ভেসে উঠতে থাকে বার বার আর সে মাকে বৌকে আর যত মহিলা আছে সবাইকে মাফ করে দেয় একে একে। দুর্বলতা গ্রাস করে মন, বুদ্ধি , চেতনাকে।
মুম্বাইতে
এসে শুরু হয় অন্য যুদ্ধ। একনাগাড়ে পাঁচ বছর
দেশের বাইরে থাকার জন্য দেশ তাকে ভুলে গেছে। তার আইডেন্টিটি তার জীবনধারণ সব গেছে পাল্টে। চূড়ান্ত গতিতে দেশ যে ভাবে পাল্টেছে তার খবর সে
রাখেনি। তাই মুম্বাইয়ের কঠিন বর্ষায় তার সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট যুদ্ধ শুরু হয়। আর সাথে শুরু হয় আধ্যানের সাথে ভিডিও চ্যাট। সকালে ঘন্টাখানেক , বিকেলে ঘন্টাখানেক। সময়গুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে থাকে। একদিন আধ্যানের ছবি আর ভিডিও ঘাঁটতে ঘাঁটতে আধ্যানের
উল্টো হাতে নাক ঘষার কথা মনে পড়ে যায়। আর সে
লেখে , "ভ্যাঙাচ্ছে
"
চতুর্থ মাসের
জন্মদিনে আধ্যানের সবথেকে বড় সমস্যা ছিল কমিউনিকেশন। কেউ ওর কান্নার কারণ বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাই ওর কষ্ট বুঝে সে একটা ছোট লেখা লিখলো ,
"চার
মাস" .
একদিন বসে
বসে ভাবছিলো সে কি অসহায় তার ওই ছোট্ট আধ্যানের কাছে। কেরিয়ারে এখনো পর্যন্ত ভালোই করছে। শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অটুট। রোজ সকালে উঠে টপ করে ওষুধ খেতে হয় না। সুখী মানুষের নিদর্শন হিসেবে একটা ভুঁড়িও আছে। কিন্তু ওই একটা ছোট্ট পাঁচফোড়ন সবাইকে কিরকম নাচিয়ে চলেছে।
বলশালী পুরুষ আর রূপবতী নারীর দম্ভ নিমেষে চূর্ণ বিচূর্ণ করার ক্ষমতা রাখে একটা
শিশু। সেটাই আধ্যানেই মুখে লাগিয়ে সে লিখলো
, "শোনো
বাবা ও মা !!"
এই সময় শুরু
হয় আধ্যানের খাওয়া নিয়ে সমস্যা। না ঘুমালে
সে দুধ খাবে না। ডাক্তারও বলে দিয়েছে গ্রোথ
কম। ওদিকে একদিন যখন একাধারে আধ্যানের খাওয়া
নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তখন একদিন সে শুনলো আধ্যানের মা মাছের টক বানিয়েছে। এদিকে সেদিনই আধ্যান আবার খাচ্ছে না। কেন খাবে।
এতো সুন্দর সুন্দর খাবারের গন্ধর জায়গায় আধ্যান কেন শুধু দুধ খাবে। ব্যাপারটা বুঝে সে লিখলো "খাবো না মানে খাবো
না " . পরে যখন খিচুড়ি খাওয়া শুরু হলো তখন তার খুশি নিয়ে , "সান্ধ্র খাবার".
যদিও সলিড ফুড আগেই দেওয়া হয়ে গেছে কিন্তু অন্নপ্রাশন না করলেই নয়।
কিন্তু অন্নপ্রাশনের দিন দেখা গেলো যে ধুতি দাদু নিয়ে এসেছে সেটা খাটো। সেইসব নিয়ে লিখলো , "আমার অন্নপ্রাশন"
.
এর মধ্যে চলে
এলো দূর্গাপূজা। আধ্যানের প্রথম দুর্গাপুজো। আর আধ্যানের বাবার প্রথম একা দুর্গাপুজো। সদ্য গজিয়ে
ওঠা বন্ধুগুলো অনেকবার বললেও তার মন কিছুতেই পূজামণ্ডপে যেতে সায় দিচ্ছিলো না। এবং শেষমেশ সারাটা পূজা সে ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিলো। যেহেতু ওখানে উইকেন্ড পুজো, অকাল বোধনের সেরা নমুনা। তাই উইকেন্ড এ পুজোয় আধ্যানের
ছবি দেখে সে ভাবলো সবাইকে আধ্যানের তরফ থেকে শুভ বিজয়া বলে দি। লিখলো "শুভ বিজয়া
" .
এদিকে অক্টোবর
পেরিয়ে গেছে অথচ ভিসার নামগন্ধ নেই। ওদিকে শাশুড়ির ফিরে আসার সময় হয়ে আসছে। দিশেহারা অবস্থায় বিচার্য্য হলো আধ্যানকে ডে কেয়ারে দেওয়া হবে। পনেরোই
ডিসেম্বর ভিসার ইন্টারভিউ। হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি
চলে আসবে সে। শাশুড়ি চলে এলেন , আধ্যানকে ডে
কেয়ারে দেওয়া হলো। কিন্তু ব্যাপারটা সুখকর
হলো না। সহ্য হলো না আধ্যানের। সমস্যা এতো গুরুতর হয়ে গেলো শেষে শশুর গিয়ে হাজির
হলেন। সমস্যা স্থিতু হলে একদিন বসে বসে আধ্যানের
"ডে
কেয়ার কড়চা" লিখলো সে।
পনেরোই ডিসেম্বর
ভিসা রিজেক্ট হলো। শুরু হলো পরের ভিসার জন্য
তোলপাড়। চারপাশ থেকে বস্তা বস্তা তীর এসে পড়তে
লাগলো আধ্যানের বাবার গায়ে। মানসিক ভাবে এতো
ভেঙে সে আগে কখনো পড়েনি। এদিকে আধ্যান বড় হয়ে
যাচ্ছে। হামা দিচ্ছে। মোবাইলের ওপাশটা কি সুন্দর। বৌ বাচ্চা , ঘর , আসবাব আর অপর দিকে একটা নোংরা
ওয়ান রুম কিচেন। এতো ফ্রাস্ট্রেশানের মধ্যে
আধ্যানের ডায়েরি তার কাছে এক অদ্ভুত পাওনা।
পুরানো ছবি ঘেঁটে ঘেঁটে স্মৃতি চটকে চটকে মিষ্টি মিষ্টি করে আধ্যানের কথা বলাটাই
তার কাছে আধ্যানকে পাওয়ার মতো। ছেলের পাসপোর্টের
ছবিটা হাতে নিয়ে লিখেছিলো , "পাসপোর্টের দিনে"
পরে একে একে বেরিয়ে আসে "আমি আমার মতো"
"সর্দি
কাশি " "মা বকেছে
" .
দেখতে দেখতে
এপ্রিল এসে গেলো আর তেসরা এপ্রিল শেষমেশ ভিসা পেলো সে। চূড়ান্ত আনন্দে লাফিয়ে কেঁদে তখন আধ্যানের সাথে
একাত্ম হয়ে লিখলো "বাবা আসছে"
কিন্ত বিধি বাম। ট্রাম্পের রুলের চক্করে দিনের
পর দিন পিছিয়ে যেতে লাগলো তার যাওয়া। শেষমেশ
একদিন আধ্যানের মা বললো , "এট লিস্ট যে করে হোক আধ্যানের জন্মদিনে এস " রাত
তখন দুটো কি মনে হলো যেনো আধ্যান কানে কানে একই কোথায় বলছে , "বাবা প্লিস জন্মদিনে
এসো " . সকালে উঠে প্রথমেই সে লিখলো , "আমার জন্মদিনে এসো"
. আধ্যানের মা কে পরে শোনানোর সময় কেঁদে ভাসিয়ে দিলো। বয়েস অলসো ক্রাই।
এরপর এক অদ্ভুত
মানসিক অবস্থা হতে লাগলো তার। অফিসে রোজ লড়াই
ঝামেলা ঝগড়া করে যখন শেয়ার অটোতে সামনের সিটে বসতো তখন হঠাৎ করে কি হতো একটা আওয়াজ
আসতো , "বাবা শোনো। ... " তারপর
আধ্যান যেন কথা বলতে আরম্ভ করতো। আর রোজ রাত্রে
এসে একে একে আধ্যানের ডায়েরি লিখে যেত সে।
মাঝ রাতে উঠে বেশ কয়েকদিন আলো জ্বালাতে হয়েছে তাকে। মনে হতো আধ্যান ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলছে ,
"কালকে যেটা বললাম সেটা লিখলে না তো। " এক অদ্ভুত হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি হলো
তার মনে। পর পর লিখে গেলো "আমার নেমসেক",
"মাদার্স ডে",
"আমার
ঘুম" , "ডাইপার তোলপাড়"
, "ভুবন
ভোলানো হাসি" , "এ শুধু আমাদের
মধ্যে" .
সে যা লিখতো
আগে সব ফেসবুকে পোস্ট করতো না। ওলোটপালট করে
যখন যা ইচ্ছা পোস্ট করতো। কিন্তু সে এখন নিয়মিত
পোস্ট করে যেতে লাগলো। শুধু "আমার জন্মদিনে এসো"
লেখাটা পোস্ট করেনি। মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে
ও ঠিক জন্মদিনে পৌঁছে যাবে। যেমন করে হোক। কিন্তু হ্যালুসিনেশন বাড়তে লাগলো আর জন্মদিন কাছে
আসতে লাগলো। শেষে হতাশ হয়ে এই লেখাটাও পোস্ট
করে দিলো। ব্যাস তার পর থেকে আরো মাথা খারাপ
হয়ে গেলো। সারাদিন সে আধ্যানের ছবি আর লেখা
নিয়ে বসে থাকতো। কখনো আপডেট করছে , কখনো বানান
ঠিক করছে , কখনো ছবি লাগাচ্ছে , কখনো লেখাগুলোতে যে কমেন্ট পড়েছে তার উত্তর দিচ্ছে।
মনে তার অদ্ভুত পাগলাটে খুশি। যেন সে দু হাত
ধরে তার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে আছে শব্দের মধ্যে দিয়ে।
একদিন সকালে
ধড়মড় করে উঠে বসলো কি একটা স্বপ্ন দেখে। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। রাতে ল্যাপটপ বন্ধ হয়নি। চলছে। আর
আধ্যানের ছবি ওয়ালপেপার। ব্রাশ করতে গিয়ে আবার
সেই শব্দ কানের কাছে , "শোনো বাবা। ...." ছুটির দিন তাই ল্যাপটপ খুলে বসলো
, এদিকে আধ্যান তখন বলে চলেছে। দুপুর বারোটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত ক্রমাগত সে
লিখে চললো। তিনটে লেখা এক দিনে বেরিয়ে এলো
, "দন্ত
বিকশিত" ,"ওই তারগুলো",
"শুধু
নো আর না" . শেষে রাতে আধ্যানের মায়ের পিং যখন এলো তখনও লিখে চলেছে। কিন্তু পিং এর শব্দে সেন্স ফিরে পেয়ে সে বুঝতে পারলো
ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। আধ্যানের হ্যালুসিনেশন
কিন্তু বেড়েই চললো।
এমন সময় হঠাৎ
এক সাংঘাতিক খবর আধ্যানের বাবার অন্থস্থল খেয়ে ফেললো। তার ফুলের মতো সাত বছরের ভাগ্নে হঠাৎ শ্বাসনালীতে
খাবার আটকে মারা গেলো। একদম ভেঙে পড়েছিল সেদিন। কিন্তু এই শকে আধ্যান চুপ করে গেলো।
আজ আধ্যানের
জন্মদিন। কিন্তু তার বাবার কাছে তার জন্য লেখার
মতো কিছু নেই। পৃথিবীর ওপ্রান্তে ভিডিও চ্যাটে
তার কেক কাটা দেখে খুব তাকে ছুঁতে ইচ্ছা করছিলো।
কিন্তু ফোনের দেওয়াল ভাঙার উপায় নেই।
এক ভয়ঙ্কর অসহায়তায় তার বাবা আজকে আবার খুলবে সব ছবিগুলো , সব ভিডিওগুলো , আবার
দেখবে , তার একমাত্র সাহারা এই চিত্র ও চলচিত্র গুলো। যখন সে ছেড়ে এসেছিলো তখন আধ্যান ঘাড় সোজা করতে পারতো
না, এখন সে হেঁটে বেড়ায়। কিসের শাস্তি যে সে
পাচ্ছে ভগবানই জানে। সব দুঃখের মধ্যে একটাই
সুখ, প্রতীক্ষার অন্ত এসে গেছে। আর বেশিদিন
নেই। বাবা আসছে , আধ্যানের বাবা যাচ্ছে তার
কাছে, খুব শিগগির, সামনের মাসেই।
আধ্যানের ডাইরির
সব পাতা এক সাথে
|
জন্মদিনে আধ্যানের জন্য রইল আশীর্বাদ... দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়ে উঠুক ও... আর বাবার জন্য রইল শুভেচ্ছা... খুব তাড়াতাড়ি ছেলের কাছে পৌঁছে যাবেন..
ReplyDeleteজন্মদিনে আধ্যানের জন্য রইল আশীর্বাদ... দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়ে উঠুক ও... আর বাবার জন্য রইল শুভেচ্ছা... খুব তাড়াতাড়ি ছেলের কাছে পৌঁছে যাবেন..
ReplyDelete