Sunday, October 29, 2023

বার্ডস ফিডার ও পাখির নেমক হারামি।

হাড়কাঁপানো শীতের শেষে বসন্তের প্রথমে গাছে আসা নতুন পাতাগুলোর সাথে শুরু হয়ে যায় পাখির কলরব। দেশ ভিন্ন, পাখি ভিন্ন, খাদ্য ভিন্ন। অর্ধেক পাখির নাম পর্যন্ত জানি না। এই শীতের শেষের দিকে তাই পাখিদের খাওয়ানোর একটা প্রজেক্ট নিয়েছিলাম। যে দেশে হাত ছেড়ে কাঁটাচামচ ধরেছে মানুষ, সে দেশে পাখি কি আর ছড়িয়ে দেওয়া খাবার খাবে? এদের জন্য আছে বার্ড ফিডার। নানা তার রূপ , নানা তার ভঙ্গিমা। কোনটা বাড়ির মতো দেখতে , কোনটা লম্বা মতন , আর ছোট ছোট ফুটো করা আছে। কোনোটা আবার ফুলের মতো, আর তার ওপর একটা ছোট্ট ফুটো। প্রথম কয়েকবার ওয়ালমার্টে গিয়ে ভেবড়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা থাকা একটা বড় ব্যাপার , আর ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপান্তর করা আরেক।


গার্ডেনের আইলে ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারলাম সব পাখি সব কিছু খায় না। পাখিদের খাবারের বাহার অনেক বেশি। মোটামুটি একটা ছক করে দেখলাম যে সূর্যমুখীর বীজ ( সাদা , কালো বা স্ট্রাইপড) ,মিলেট বা বাজরা , নাইজার বীজ , ভুট্টার দানা আর চীনাবাদাম এগুলোকেই মোটামুটি পাখীখাদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।


আমেরিকার ভূখণ্ড এতো বড় যে ক্যালিফোর্নিয়া কন্ডর থেকে হামিং বার্ড সবই আছে। কিন্তু আমার বাগানের আশেপাশে কারা থাকে সেটা না বুঝতে পারলে খাবার নিয়ে যাওয়া বৃথা। কারণ পেল্লাই পেল্লাই খাবারের বস্তা। গিন্নির কথা মান্য করে একটা সবথেকে ছোট মেলানো মেশানো প্যাকেট কিনে নিয়ে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় দিলাম ছড়িয়ে। "হাম ফেকা হুয়া খানা নেহি খাতে " বলে দু চারদিন কোনো পাখি এলো না। এর মধ্যে আবার বৃষ্টি পরে বীজগুলো নরমও হয়ে গেলো।


আমি দেখলাম কেলো। কলকাতা থেকে মুম্বাই যেখানেই খাবার ছড়িয়েছি সেখানেই পিলপিল করে পাখি এসে জুটেছে। কলকাতায় কাক আর মুম্বাইতে পায়রা। এখানে দুটোই পরিমিত নেই। আমেরিকায় নেই তা নয়। নেই আমার ব্যাক-ইয়ার্ডে। আছে কি ? গুচ্ছ গুচ্ছ চড়ুই। চড়ুই কলকাতা থেকে উধাও হয়ে গেছে অনেক বছর হলো। কিন্তু এখানে চড়ুই ঝাঁকে ঝাঁকে। চড়ুইয়ের ঝাঁকে মাঝে মাঝে নানা রঙের ছিটে মারা চড়ুই দেখা যায়। প্রথমে ভাবতাম বিদ্রোহী - রতন। বাবা মা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে দাদা-দাদুর মুখে কালি লেপে গান্ধর্ব মতে ভিনধর্মে বিয়ে করেছে। কিন্ত না , এদের নাম ফিন্চ।


একশো ধরণের ফিন্চ হয়। তাই বেশি বলতে গেলে অর্নিথোলজিস্ট হতে হবে। তার থেকে পরের প্রচেষ্টাগুলো বলি। ছড়িয়ে দেওয়া খাবার না খাওয়ায় আমি করলাম কি, একটা বাটির মধ্যে তিন চার মুঠো খাবার দিলাম রেখে। আর মায়ের কথামতো আরেকটা পাত্রে দিলাম জল। শুক্রবার বিকেল বিকেল এই পরিবর্তন প্রয়োগ করে ভুলে গেছিলাম শনিবারের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত। পুঁইডাটা চেবাতে চেবাতে নজর পড়লো বাটিগুলোর দিকে। একটা উল্টানো , একটা শূন্য।


কেসটা কি ? ভদ্রলোকেরা তাহলে চেটেপুটে সব খেয়ে নিয়েছে। শালা হেব্বি সাহেব চড়ুই তো। যাহোক , আমি আবার ওই বাটি ভরে দিয়ে , দিবানিদ্রা দিতে বেডরুমে চলে গেলাম। বিকেলে চা নিয়ে বাইরে এসেছি। দেখি আবার শেষ। ব্যাপারটা ঠিক লাগলো না। ছড়ানো ছিটানো নেই। আশপাশ চাঁচাপোঁছা। এতো পরিষ্কার করে তো পাখি খেতে পারে না। বাটি না ভরে, পরের দিন সকালে এলার্ম দিয়ে সূর্য ওঠার আগে উঠলাম। ভরে এলাম বাটিটা। আর ভেতর থেকে নজর রাখলাম বাটিটার দিকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এ খাদক ওড়ে না। রডেন্ট এলার্ট। একটা মোটাসোটা ও একটা ছোটোখাটো কাঠবিড়ালি। একটা গোদা একরঙা ধূসর স্কুইরাল আর একটা স্ট্রাইপড চিপমাংক।


প্রথমে দুর্বলের প্রতি সবলের প্রেম হিসেবে , "থাক না , খাক না।" বেরিয়ে এসেছিলো। কিন্ত দু তিন দিনে যখন দশপাউন্ডের প্যাকেট শেষ করে দিলো, আর পরিবার পরিজন নিয়ে আমার প্যাটিওর ডেকে এসে উৎপাত আরম্ভ করলো তখন তাদের নিরীহতায় বেশ প্রশ্ন উঠলো। জুলজুল করে চেয়ে থাকা লাল টুকটুক কার্ডিনাল গুলোকে এমন ভাবে খেঁদিয়ে দিতো যে মন সিপিএম হয়ে যেত। লাল টুকটুক পুরুষ কার্ডিনাল তার বাদামী লাল গিন্নি বা সহধর্মিনী নিয়ে নেহাতই অপেক্ষায় থাকতো এই দাঁতালো ঝটিতি জন্তু গুলোর উদরপূর্তির।


মাঝে মাঝে টক্কর নেওয়ার জন্য উড়ে আসতে লাগলো পার্পল মার্টিন। এক ঝলকে দেখলে কাক মনে হবে কিন্তু আলো পড়লেই বেগুনি আভার আভিজাত্য চোখে পরে। এরা বেশ বড় এবং পক্ষিসমাজের অভিজাতদের মধ্যে পরে। কিন্তু কাঠ্বেরালি কিছুতেই বাগ মানলো না। সেদিন প্রচন্ড কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙলো। আর সাথে একটা হাঁড়িচাচাঁর মতো বিকট আওয়াজ শুনে ধড়মড়িয়ে নিচে এসে দেখি এক গাদা ব্লু -জে এসেছে। উফ কি সুন্দর দেখতে পাখিটা। কিন্তু বলে না , সুন্দরী কথা বোলোনা। বললেই সিলেটি বেরিয়ে আসবে। সেই অবস্থা এই ক্যাঁক ক্যাঁকে পাখি গুলোর। কি বিকট আওয়াজ।


কিন্তু আমার ডেক সেজে উঠেছে। নানা পাখি আসতে লাগলো। শালিক বলে ভুল হতে পারে এরকম আমেরিকান রবিন, নানা ধরণের ফিঞ্চ , ঘুঘু , কালোমাথা চিকাডি কত কি। হঠাৎ করে একটা চড়ুই সামনে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে উঠলো। ভেবড়ে গিয়ে খুঁজে দেখি তাইতো , এখানে এক ধরণের চড়ুই গানও গায়। বেশ কিচিরমিচির ভালোই লাগছিলো কিন্তু বাড়তে লাগলো খরচ। কাঠবিড়ালিকে সাইড করতে বার্ড ফিডারটাকে ঝুলিয়ে দিলাম একটা হুকে যেখানে আগে ঝুলছিলো একটা পেটুনিয়ার ঝোলা। সেখানেও শুরু হলো কাঠবিড়ালির খেলা। দূর থেকে এমন লাফ লাফাতে লাগলো যে বার্ড ফিডারের হুকটাই গেলো একদিন ভেঙে। আবার ঠিক করে দিলাম।


একদিন দেখি বার্ড ফিডারের আসে পাশে প্রচুর ছোট ছোট পাখি। নিথর হয়ে উড়ছে। যেন আকাশের গায়ে চিপকে দেওয়া হয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করতে দেখলাম হামিং বার্ড। ওরা কিন্ত খাচ্ছে না। শুধু দেখছে। পরে জানলাম ওদের ফিডার আলাদা। ফুলের মতো দেখতে ফিডার কিনে রঙীন চিনিজল গুলে রেখে দিলেই ওরা আসে। লম্বা ঠোঁট বাড়িয়ে ফুলের মধু খাওয়া যাদের অভ্যাস তাদের মুরগি করে চিনিজল খাইয়েও দিয়েছে মানুষ। সেদিন কিন্তু সুন্দর এই পাখিগুলোর মধ্যেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওই কাঠবিড়ালীটা। আর সহ্য করা যাবে না।


এক বন্ধু বললো লংকার গুঁড়ো মিশিয়ে দে। রডেন্টরা ঝাল বুঝতে পারে , কিন্তু পাখিরা পারে না। পাখিদের খাওনোই যদি উদ্যেশ্য থাকে , তাহলে আরামসে পাঁচ পাউন্ডের বস্তায় পাঁচশো গ্রাম লঙ্কা ঢেলে দে। করলামও তাই। হেব্বি কাজ হলো। পোষালো না শুধু "আহারে" বলা জীবটির। বস্তা শেষ হতে নতুন বস্তা যখন নিয়ে এলাম তখন সে আর লংকার গুঁড়ো মেশাতে দিলো না।


ততদিনে কাজ মিটে গেছে। কাঠবিড়ালি গুলো বুঝে গেছে যে ব্যাপারটা তারা ভালো করেনি। তাই তারা আসা কমিয়ে দিয়েছিলো। এদিকে আমার আরা-পাড়া-প্রতিবেশী আমার বন্য পাখিদের খাওয়ানো বিশেষ নেক নজরে দেখেনি। হয় খুব বড়লোক, নয় আধপাগলা , এরাই পাখিদের এমনি এমনি খাওয়াতে ভালোবাসে। আমাদের মতো সুস্থ মধ্যবিত্তরা গলায় আঙ্গুল দিয়ে "ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরোও " বলিয়ে তবে শান্তি পাবে। সব কিছুতেই আর ও আই। কিপটের মতো ওয়ালমার্টের দশ পাউন্ড ওজনের জোয়ার বাজরা , সূর্যমুখীর বীজ মিশিয়ে বানানো ইকোনোমি মিক্স এর মতো সস্তার খাবার খাওয়াচ্ছি, তাতেও সমস্যা। সবার বক্রোক্তি চলতে থাকলেও আমি কারো কথায় কান দিইনি। আমার বেশ লাগতো যখন সারা প্যাটিও জল স্প্রে করে তাদের গু পরিষ্কার করতাম। মানছি কথাটা আধপাগলা শোনাচ্ছে। কিন্তু বেশ পিতৃত্ব জেগে ওঠে , বন্য আদিমতায়।


এই পিতৃত্বর ফুটানি কখন শেষ হয় জানেন তো। যখন ছেলে টাটা করে শ্বশুরের সাথে প্যারিস যায়। এক সপ্তাহ কাজে এমন বুঁদ ছিলাম যে নজরই করিনি আমার দু দিন অন্তর শেষ হয়ে যাওয়া বার্ড ফিডার এক সপ্তাহ হলো অর্ধেকও শেষ হয়নি। যখন খেয়াল করলাম তখন দেখলাম সত্যিই তো সারা দিন কোনো পাখির দেখা নাই। কি কেস ?


তদন্তে দেখতে পারলাম আমার প্রতিবেশী এক সুদৃশ্য বার্ড ফিডার নিয়ে এসে প্রিমিয়াম সিড মানে উচ্চমানের বীজ তার মধ্যে দিয়েছে। সেই খাদ্যে আছে সূর্যমুখীর বীজ , চীনাবাদাম , পেস্তা , ছাড়ানো কুমড়োর বীজ আরো কত কি। আমার জোয়ার বাজরা খেতে তাদের বয়ে গেছে। এদের জন্য এতো সময় ব্যয় , এতো লোকেদের টিটকিরি আর সাথে ওই অতো গু পরিষ্কার করেও প্রতিদান হিসেবে পেলাম দল বদল। মানুষকে দোষ দিয়ে হবে কি ? আদিমতা আর প্রকৃতির কাছে ঘেঁষে থাকা প্রাণীই যদি নেমকহারামী শিখিয়ে যায় তাহলে বিশ্বইতিহাসে বিন্দুসম মানুষ কেন হারামজাদা হবে না।


ঠিক করলাম সামনের সামারে একটা পাখি মারার এয়ারগান কিনবো। সারা সামার টিপ করে করে মারবো। পাতাঝরা মরসুমে যখন না খেতে পেয়ে ওয়াইল্ড টার্কি গুলো জঙ্গল ছেড়ে আমার প্যাটিওর সামনে ঘোরাফেরা করবে তখন খপ করে ধরে ফ্রিজে পুরে থ্যাংক্সগিভিং এ ফিষ্টি করবো। যেমন এরা নেমকহারাম ,আমিও ঠিক তেমনি হবো। কিন্তু ওই "আহারে" বলা মানুষটা যদি বাঁধ সাধে তো কিছু করার নেই।


প্রতিবেশীর কাছে সিড টার খোঁজ নিয়ে নেটে সার্চ মেরে ইনগ্রেডিয়েন্টস বার করে পুরোটাই দিয়ে দিলাম। কোনো দোষ নেই পাখিদের। সব দোষ পকেটের।

Sunflower Kernels, Peanuts, Pistachios, Hulled Pumpkin Seed, Vitamin A Supplement, Vitamin D-3 Supplement, Vitamin E Supplement, Menadione Sodium Bisulfite Complex, Thiamine Mononitrate, Riboflavin, Niacin, Choline Chloride, Vitamin B12 Supplement, Pyridoxine Hydrochloride, Biotin, Folic Acid, Ascorbic Acid (Vitamin C), L-Lysine Monohydrochloride, DL-Methionine, Potassium Chloride, Sodium Bicarbonate, Manganous Oxide, Ferrous Sulfate, Copper Oxide, Calcium Iodate, Zinc Oxide, Magnesium Oxide, Dextrose, Artificial Flavor.