Thursday, May 17, 2018

জাদুচক্র


একটা লোক সাধারণ জামাকাপড় পরে উঠে এলো স্টেজে।  ঢোলা ঢালা চেক হাফ শার্ট আর টেরিকটের প্যান্ট।  স্টেজে জ্বলে উঠলো আলো।  এতক্ষণ একের পর এক ম্যাজিসিয়ান রংবেরঙের পোশাক পরে উগ্র উত্যগ্র আলোর সামনে নানা রকমের ম্যাজিক পরিবেশন করে যাচ্ছিলো।  সারাদিন চলছে এই ম্যাজিক শো। লোকে আসছে যাচ্ছে। আমি বাথরুম চেপে বসেছিলাম যেন কিচ্ছু মিস না হয়ে যায়।  কি অদ্ভুত ছিল সেই দিনটা।  হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানুষ , পেটের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া করাত , মুখ থেকে বেরিয়ে আসা অজশ্র তাস , না শেষ হওয়া ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া আরো কত কি।  আলো জ্বলে উঠতে মনে হলো দৌড়ে গিয়ে বাথরুম করে আসি। লোকটা স্টেজে উঠে আসার সাথে সাথে অনেক ম্যাজিশিয়ান এক সাথে স্টেজে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।  সবার চোখে এক সম্ভ্রম। আর আউন্সআর ঘোষণা করলো “জাদুকর শশাঙ্ক ব্যানার্জি ” নাম।  ষাটোর্ধ বেঁটে খাটো মানুষটি হাতে তুলে নিলো একটা খাঁচা।  ফাঁকা খাঁচা।  স্টেজের ওপাশ থেকে একজন আরেকটা খাঁচার মধ্যে করে একটা পাখি নিয়ে হেঁটে এলো।  কোনো আড়ম্বর নেই।  নেই কোনো প্যাটার।  সবার সামনে তিনি সেই পাখিটাকে ওই খাঁচা থেকে বার করে নিজের খাঁচায় পুরলেন।  খাঁচাটাকে তুলে ধরলেন মাথার ওপর।  স্টেজের এক পাশ থেকে আরেক পাশে হেঁটে গিয়ে সবথেকে আলোকিত যে জায়গা সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন।  তিনটে কথা , “ওয়ান - টু - থ্রি ” ফট করে একটা শব্দ হলো আর খাঁচা ভেঙে দু টুকরো করে দু হাতে নিয়ে চলে গেলেন তিনি।  পাখি উধাও।  

আমার সেদিন গা ঘুলিয়ে উঠেছিল।  আগেরদিন থেকে স্কুলে বসেছে জাদুর জিনিস বিক্রির দোকান।  নানা ক্লাসে শেখানো হচ্ছে , জাদু হলো শুধুই হাতের কারসাজি।  গোগ্রাসে গিলছিলাম নানা ধরণের তাসের খেলা।  তীব্র শব্দ আর আলো কি করে মানুষের চেতনা অবশ করে সেটা বুঝছিলাম।  প্যাটার বা ক্রমাগত বকলে মানুষের দৃষ্টি যে জাদুকরের মুখের দিকে চলে আসে সেটা সেদিনই বুঝেছিলাম।  টপিট বা জাদুকরের কোটের ভেতরে থাকা পকেট যেখানে সব কিছু ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব , সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম।  আর বুঝেছিলাম ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া কেন শেষ হয়না।  কিন্তু এটা কি ? ম্যাজিকের খেলার জন্য ওই পাখিটাকে পিষে মেরে ঢুকিয়ে নিলো পকেটে? কি নৃশংস। আবার ম্যাজিক শুরু হতে ব্যাপারটা ধাতস্ত হয়ে গেছিলাম।  এবং পরে বুঝেছিলাম পাখিটা মরেনি।      

দিনটা অনেক বছর আগের।  তখন হ্যারি পটার সবে বেরিয়েছে , কিন্ত দেশের মাটিতে তখনও সে অজানা।  হগওয়ার্ট ভাবা হয়নি বাংলা সাহিত্যে।  তখন আমার ছোট্ট শহর চন্দননগরে ছিল সত্যি এক হগওয়ার্টের মতো সংগঠন - “চন্দননগর জাদুকর চক্র” .  ষাটের দশকে এই গোষ্ঠী চন্দনগরে সৃষ্টি হয় জাদুকর আর জাদুবিদ্যাকে এক সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য।  সময়ের সাথে সাথে কলকাতার জাদুকররাও জুড়তে থাকেন এই সংগঠনের সাথে। বিশ্বখ্যাত ম্যাজিসিয়ানরা আসতে থাকেন চন্দননগরে।  জাদু প্রদর্শনী নয় , জাদু বিদ্যার ওপর জ্ঞানগর্ভ লেকচার দিতে।  চন্দননগরে নিত্যগোপাল স্মৃতি মন্দিরে তাদের অ্যানুয়াল মিট হতো। তখন নাম ছিল , “চন্দননগর জাদু চক্র” . ডিমান্ড বাড়তে চন্দননগর ছেড়ে জাদু চক্র কলকাতার ভবানীপুরে তার দ্বিতীয় ও বিডন স্ট্রিটে তৃতীয় অফিস খোলে। সারা পৃথিবীর জাদুকর তখন এই জাদু চক্রের সাথে জুড়তে চায়।    

কিন্ত যখন সংখ্যা বাড়ে তখন বিভেদও বাড়ে। চন্দননগর জাদু চক্র ফিরে আসে চন্দননগরে , “চন্দননগর জাদুকর চক্র” নাম নিয়ে।  সে বছর থেকে বছরে দুদিন ম্যাজিক্যাল কনভেনশন হতে শুরু করেছিল।  সেই দু দিন আমার স্কুল কানাই লাল বিদ্যামন্দিরে জাদুকর রা আর জাদুসামগ্রী বিক্রেতাদের জমজমাট বাজার বসতো।  আর চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড এর ওপর বারোশো সিটের রবীন্দ্র ভবনে হতো নন স্টপ জাদুপ্রদর্শনী. সবাই এমেচার. দর্শকের হাততালি নয় , তাদের প্রয়োজন শিল্পের প্রদর্শন. রসকষহীন চোর সত্যবিজড়িত বিজ্ঞানের দ্বারা মিথ্যা কে সত্যে প্রমাণিত করার বিচিত্র প্রচেষ্টা. কি সুন্দর স্বপ্নময় ছিল সেই দিন দুটো. 

আজ এতো বছর পরে যখন স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভেসে উঠলো সেই দিন দুটির কথা তখন খুঁজতে লাগলাম তাদের অস্তিত্ব. অনেক বছর তারা নেই তারা সবার সামনে. যাদু আর জাদুকর ধীরে ধীরে মুছে গেছে ভিডিও গেম আর ইন্টারনেট এর যুগে. আজও কিন্তু সেই শিশু গুলো চোখ চেয়ে তাকিয়ে আছে অলৌকিক ইন্দ্রজাল দেখার জন্য. আজও কিন্তু সেই বিজ্ঞানমনস্ক কিশোর হৃদয় বসে আছে জাদুর খেলা ফাঁস করার জন্য. কিন্ত আজ সবই ওই কম্পিউটার এর মধ্যে . সারা বিশ্বে আজও জাদুবিদ্যা শেখানো ও চর্চা হয়. আর আমরা এখন মেতেছি পুজোতে. যা কোনো কিছুতেই বিজ্ঞান মানসকে উজ্জীবিত করে না. 

বহুদূরে থেকে যখন শহরের কথা ভাবতে ভাবতে সেই জাদুচক্রের খোঁজে ইন্টারনেট এ ঘুরছি , দেখলাম একটা ওয়েবসাইট পর্যন্ত ছিল এই জাদুচক্রের , কিন্তু শেষ এনাউন্সমেন্ট ছিল ২০০১ সালের জুন মাসে . কেউ কি জানো এদের কি হলো??

তাদের ওয়েবসাইট 


No comments:

Post a Comment