Monday, April 23, 2018

48) আধ্যানের ডায়েরী - দেশে বিদেশে ( পর্ব - ৩)


এর মধ্যে একদিন বাবা মা আর আমি গেলাম বাবার প্রথম বাড়ি দেখতে। বাবা নাকি যখন আমার থেকে একটু বড় ছিল তখন ওই বাড়িতে থাকতো।  যে গাড়িতে আমাকে চাপিয়ে নিয়ে গেলো, আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ  , আমি হেব্বি ভয় পেয়ে গেছি।  সব দিক খোলা।  যে কোনো সময়ে ছিটকে পরে যাবার ভয় করছিলো।  এরকম গাড়িতে কেউ চাপে নাকি!  মা কে আঁকড়ে ধরে বসেছিলাম।  আগের গাড়ি গুলোতে এটলিস্ট চলে ফিরে বেড়ানোর ব্যবস্থা থাকে।  এটাতে তো মায়ের কোল থেকে নামলেই ধুপপা।  নামটাও কেমন একটা যেন - টোটো।  আমাদের এখানকার দোকানে যে শপিং কার্ট আছে না , সেটার থেকেও এই গাড়িটাা খারাপ ।  কিন্তু থাক সে কথা , আমরা ঠিক ভাবেই  পৌঁছে গেলাম আরেক ঠাম্মা দাদুর বাড়ি।  

বাবা নাকি মাকেও  এই বাড়িতে প্রথম বার নিয়ে এলো।  বাবা অনেক কিছু বলে যাচ্ছিলো।  কিন্তু আমার নজর ছিল একটা আয়নার ওপর।  আয়নাটা বেশ মিষ্টি।  ছোট্ট মতো।  আমি ধরে নিজের মুখ দেখছিলাম।  কিন্তু সবাই এতো হাঁ-হাঁ করে তেড়ে এলো যে ভেবড়ে গিয়ে দিলাম ছুঁড়ে ফেলে।  আর পরে গিয়ে খান খান হয়ে ভেঙে গেলো। এখানে একটা সমস্যা কিছু একটা ছুঁড়ে ফেললেই যায় ভেঙে।  আমার বাড়ির মতো তো আর কার্পেট নেই এখানে। সব শক্ত লাল কালো মেঝে।  আর হ্যাঁ , দোষ কি আমার নাকি।  এতো প্রটেকটিভ হলে চলে।  এবার যদি ভাঙা কাঁচ পায়ে ঢুকে যায় তাহলে? কিন্তু আমার এই ঠাম্মা সব পরিষ্কার করে দিলো , আর আমার নজর গিয়ে পড়লো তখন দাদুর হাতে থাকা পেনের ওপর।  কি সুন্দর সবুজ রঙের পেন।  দাদুও কিছুতেই দেবে না , আর আমিও নেবো।  শেষ মেশ দিতে বাধ্য হলো।  আর আমি তখন সব জায়গায় লিখে লিখে বেড়াতে লাগলাম।  

পেন জিনিসটা এখন আমার নতুন ভালোবাসা।  দেখলেই কিছু একটা করতে ইচ্ছা করে।  আর অনেক কিছু করাও যায়।  ঘষে দিলে লেখা পরে , চুষতে বেশ ভালো লাগে , যে কোনো জিনিসে আটকে যায় , স্পেশালি যেকোনো খাবারে।  মা যখন ম্যাগি বানিয়ে দেয় তখন হাতে ধরেই খাই , কিন্তু পেন ঢুকিয়ে দিতে আরো মজা লাগে।  দাদু ঠাম্মা একটা প্লেটে করে চারটে গোল গোল সাদা জিনিস এনে দিলো বাবার হাতে। আগেও দেখেছি ওগুলো।  দিলাম ঢুকিয়ে পেনটা। দেখলাম  আর সোজা উঠে চলে এলো পেনের আগায়।  প্লেট উল্টে চটচটে একটা জল পরে গেলো খাটের ওপর।  যেহেতু সেটা খাবার জিনিস , তাই জিভে লাগিয়ে দেখতে গেলাম।  ইশ কি বাজে খেতে - মিষ্টি তো।  মুখ বেঁকিয়ে বাবাকেই খাইয়ে দিলাম।  জিনিসটা খেতে খারাপ হতে পারে কিন্তু পেনের আগায়া ভালোই ওঠে তাই ওই চারটেই পেনের আগায় লাগিয়ে খাইয়ে দিলাম সবাইকে।  এবার বাড়ি ফেরার পালা। 

এর কয়েকদিন পরে আবার ঠাম্মা দাদুর বাড়ি যাবার দিন চলে এলো।  এবার আর ঠাম্মা দাদুর বাড়ি না , এবার বড় ঠাম্মার বাড়িতে যেতে হবে।  বাবার - বাবার - মা।  সেটা অনেক দূর।  সক্কাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সব্বাই রেডি।  বাবা গাড়ি নিয়ে এসেছে , মা আর আমি গাড়িতে উঠে আবার এক জায়গা থেকে ঠাম্মা দাদুকে তুলে নিলাম।  তার পর যাচ্ছি তো যাচ্ছি।  গাড়ি চলছে তো চলছে।  আমি ঠাম্মা দাদুর কোলে আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে আছি।  ঠান্ডা হাওয়ায় আমার একটু ঝিমুনি এসে গেছিলো।  হঠাৎ কি হলো দেখি বাবা পিছন থেকে আমাকে সামনের সিটে নিয়ে এসে বসলো। আরে আরে করছে কি ? কিডস আর নট এলাউড ইন ফ্রন্ট সিট।  

কিন্তু বাবা তো বাবা।  নিজের দেশে এসে বাবার একটা ল্যাজ বেরিয়েছে।  প্রচুর ইন্কারেক্ট জিনিস করে চলেছে। সবাই বারণ করছে কিন্তু শুনছে  না।  আমি কিন্তু বাবার এই আউট অফ দা বক্স এটিচুড বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছি।  কারণ আই এম দা ওয়ান হু ইস পজিটিভলি বেনিফিটেড ফ্রম ইট।  কিন্তু এটাকে আমি ঠিক মনে নিলাম না।  যদি কিছু হয়ে যায়।  কিন্তু কিছুই হলো না।  বরঞ্চ আমার কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেলো যে বাবা বা মা যখন গাড়ি চালায় তখন ওরা কি দেখে।  কি সুন্দর লাগে সামনের রাস্তাটা।  মনেই হয় না গাড়িতে আছি আর গাড়িটা এগোচ্ছে।  আমি একবার করে বাবার কোলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম।  আমি যখন আমার কার সিট্ থেকে ওঠার চেষ্টা করি তখন এই বাবাই চোখ লাল করে বারণ করে।  কিন্তু সেই বাবাই আমাকে এনকারেজ করছিলো দেখার জন্য।  

একটা বাঁক নিতে একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেলো।  দুটো পিগ রাস্তা পার হচ্ছিলো।  অইংক অইংক করতে করতে।  যে গাড়ি চালাচ্ছিল সে কি জোরে হর্ন বাজালো।  একটা টপকে গেলো কিন্তু একটার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলো লোকটা।  গাড়িটা একটু হেলে দুলে আবার সোজা চলতে লাগলো।  মা পেছন থেকে চিৎকার করে উঠলো।  বাবা শান্ত।  ঠাম্মা গুমড়োচ্ছে।  আচ্ছা ওই পিগটার কি হলো।  গাড়ি কারোর ওপর দিয়ে চলে গেলে কি হয়।  বাবা ব্যাক মিরর দিয়ে দেখে বললো পরে আছে।  ও আচ্ছা।  পরে গেছে তাহলে।  মায়ের না, সব কিছুতেই চিৎকার করা একটা অভ্যাস।  

আমরা যখন গিয়ে পৌছালাম তখন দেখি এক গুচ্ছ লোক বাড়িতে।  এই বাড়িটা কি বড়।  বিশাল বড়।  আমাদের বাড়ির থেকেও।  আর সামনে বিশাল খেলার জায়গা।  আর সবথেকে মজাদার হলো আমার দাদা , গলু।  হ্যাঁ গো হ্যাঁ , আমার একটা দাদা আছে।  আমাকে হেব্বি ভালোবাসে। আমার জন্মদিনে আমাকে উইশ করেছিল। আমি যেদিন এলাম , সেদিন আমার সাথে ফোন থেকে কথাটা বলেছিলো।  আর এখন সামনে আমার সাথে কত খেলা।  হেব্বি মজা। এই গলু দাদার মা টা পচা।  আমার জেম্মা , আমার নাম দিয়েছে পটল।  আই ডোন্ট নো হোয়াট পটল  মিন্স বাট ইট সাউন্ডস বাজে।  আর দাদাকেও ডাকে ভিন্ডি বলে।  কিন্তু জেম্মা আমাকে খুব আদর করেছে।  একটা সুন্দর জামা দিয়েছে।  সবুজ রঙের।  

সেদিন নাকি বাড়িতে কি একটা ফেস্টিভ্যাল।  দোল , অদ্ভুত নাম , বাট কোয়াইট ফেমাস ।  প্রচুর লোক , বাড়িতে অনেক কিছু করে বেড়াচ্ছে।  অনেকেই রান্না করছে।  নানা ধরণের রান্না।  কি না ভোগ নিয়ে যাওয়া হবে , কোনো একটা জায়গায়।  আমিও যাবো।  কিন্তু কে বা আমাকে নিয়ে যাবে।  তার থেকে আমি আর দাদা প্রচুর খেলে নিলাম।  এই বাড়িতে অনেক অনেক গাছ আছে।  বেশ বড় বড় গাছ।  আর গাছ থেকে অনেক অনেক পাতা পড়ছে।  দাদা দেখলাম গিয়ে সেই পাতার ওপর শুয়ে পড়লো। আর আমাকে ডাকতে লাগলো।  বাবা দেখি পেছন থেকে এসে চ্যংদোলা করে আমাকে সেই পাতার ওপর শুইয়ে দিলো।  আমি বললাম না , বাবা অনেক ইন্কারেক্ট জিনিস করছে , কিন্তু যা করছে তাতে বেশ মজা হচ্ছে।  কি মজা ওই পাতার ওপর শুয়ে।  দাদা আবার পাতা তুলে তুলে আমার গায়ের ওপর দিতে লাগলো।  আমিও দিতে লাগলাম।  যেরকম ভাবে ডেকেয়ারে উড চিপস নিয়ে খেলি সেরকম ভাবেই পাতা নিয়ে খেলতে লাগলাম।  আরো কত কিছু খেলা।  সেই প্রথম শিখলাম কারো পেছনে তাড়া করে ধরে ফেললে বলতে হয় , ‘এই যাঃ। ’ পরে যদিও অনেক জিনিসেই বলতে শুনলাম এই যাঃ। আমিও অনেক জিনিসেই লাগাতে আরম্ভ করলাম ‘এই যাঃ’।  

কিন্তু সত্যি সত্যি এই যাঃ হয়ে গেলো যখন আমরা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে ঘুরতে গেলাম।  সবাই মিলে সেজে গুজে হাতে থালা টালা নিয়ে যখন আমরা বেরোলাম তখন খুব মজা লাগছিলো।  আমাদের ওখানে যেরকম গাছপালা।  এখানেও সেরকম।  কত গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা রাস্তায় এসে হাজির হলাম।  সেখানে বেশ কিছু টোটো দাঁড়িয়ে ছিল।  আমি প্রমাদ গুনলাম।  আবার সেই সব খোলা গাড়িতে চাপতে হবে।  কিন্তু সেগুলো  ছেড়ে দিয়ে বাবা গিয়ে বসলো আর একটা গাড়িতে তাতে কিছুই নেই।  না ওপরে ছাদ , না ধরার কিছু।  সবটাই ফাঁকা।  সামনে একটা লোক সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে একটা সিটে গিয়ে বসলো আর তার পেছনে লাগানো একটা কাঠের বানানো জায়গায় সবাই টুক টুক করে উঠে পড়লাম। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো , “আধ্যানের ভ্যানেও চাপা হয়ে গেলো।” কি ভয়ঙ্কর গাড়ি রে বাবা।  আমায় মা আবার সামনে ধরে বসেছিল। টেকনিক্যালি , মায়ের কোলে ঝুলছিলাম।  যেকোনো সময় পরে যেতে পারি।  কিন্তু আমি বীরপুরুষ।  বাবা আমাকে দিন দিন সাহসী করে তুলছে।  আমি ভয় পাইনা বটে, কিন্তু সেদিন ভয় পেয়ে গেছিলাম।  

আরে তোমাদের তো বড় ঠাম্মার কথাই বলা হয়নি।  বাবার বাবার মা।  সে নাকি অনেক অনেক বড়।  অনেক দিন আগে হ্যাপি বার্থডে হয়েছিল।  কিন্তু কি মিষ্টি।  সব চুল সাদা।  আর সাদা শাড়ি পরে।  ছোট্টোখাট্টো।  আমি যখন গেলাম তখন অনেক গুলো ছবির সামনে চুপ করে বসেছিল। ওই ছবিগুলো আমাদের বাড়িতেও দেখেছি।  আমি চেটে দিতাম বলে এখন ছবিগুলোকে ঝুলিয়ে দিয়েছে।  আমার নাগালের বাইরে।  এখানে নাগালে পেয়ে ধরতে গেছি দেখি বড় ঠাম্মা আমায় ধরে চটকে দিলো।  কি মিষ্টি একটা গন্ধ গায়ে। কি নরম গা হাত পা।  আমি ভাবতাম মা ই সবথেকে নরম।  কিন্ত না , বড় ঠাম্মি একেবারে তুলতুলে।  কিন্তু আমার চামড়ার মতো চামড়া নয়।  কিরকম ভাঁজ করা করা।  বাবার চামড়া ধরে টানলে ওঠে না।  কিন্তু ঠাম্মার চামড়া ধরে বার বার টানলে দেখেছি কিরকম হাতে চলে আসে।  আর আমি টানলে ঠাম্মা কি মিষ্টি হাসি দেয়।  আমার নাম দিয়েছে পুতি।  এটাও কেমন যেন নাম।  কিন্ত ঠাম্মা যখন বলে তখন বেশ মিষ্টি লাগে।  

সেই বড় ঠাম্মাও আমার সাথে ওখানে গেলো।  গিয়ে দেখি অনেক লোক।  সবাই একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা পুতুল নিয়ে খেলা করছে। আমি উঁকি দিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম এই পুতুলটা কোথায় যেন দেখেছি।  তারপর মনে পড়লো ওই ছবিগুলো যেগুলো ঝোলানো আছে তাদের মধ্যেই একজন।  এখানে এসে থেকে আমি তাদের দেখে চলেছি যারা ছবিতে বা মোবাইলে থাকতো।  আমি কি তাহলে ফোনে ঢুকে পড়েছি।  কিন্তু ফোন তো ছোট্ট।  এই জায়গাটা তো অনেক বড়।  খুব কনফিউসিং। তবে এখানে আমার অনেক লোক।  সবাই আমাকে আদর করছে।  সবাই আমার সাথে খেলছে , সবাই মজা করছে।  ওখানে কেউ নেই।  

সে যাইহোক , ওই ঘরে ঢুকেই আমার আবার পটি হয়ে গেলো।  ওখানে যখন পটি হতো  , তখন আমার ডাইপার চেঞ্জ করে ধুইয়ে , পাউডার মাখিয়ে আবার ডাইপার পড়াতে বাবার বা মায়ের বেশি সময় লাগতো না।  সবার জন্য আলাদা জায়গা আছে।  কিন্তু ওখানে তো আর আমার মতো ডাইপার পড়া কেউ নেই , তাই আমার ডাইপার খুলিয়ে ধোয়াতে নিয়ে যেতে হলো একটা গোল মতো জায়গায়।  সেখানে মাঝখানে আবার আরো  বড় গোল আছে।  একটা বালতি দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।  সেটা সেই গোলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে টানতেই এক বালতি জল উঠে চলে এলো।  আমি অবাক।  কোনো কিছু নতুন দেখলে বেশ কিউরিসিটি বেড়ে যায়।  বাবার কোলে ঝানাপাঝাঁপি করতে বাবা বুঝতে পেরে আমাকে ওই গোলের মধ্যে উঁকি দিতে দিলো।  নীচটা খুব অন্ধকার।  আর কিছু একটা চকচক করছে।  কেউ মনে হয় নিচে থাকে যে এক বালতি জল ভরে দিলো। সেই দিয়ে ধোয়া টোয়া হয়ে গেলো।  ওখান থেকে কে একজন বলে দিলো , পায়ে জল দিয়ে আসবি।  


আধ্যানের ডায়েরির আগের পাতাগুলো 


No comments:

Post a Comment