Monday, May 8, 2017

গিন্নী ও প্রবাস -- সব বাসি



"সব বাসি .... একটা কিছু টাটকা নয় .... কি যে ছাতার মাথা জায়গা বুঝি না।"
"এর থেকে দেশে থাকলেই তো পারতে, এত চ্যাচানোরও দরকার হত না আর আমাকে এত কষ্ট করে এই দেশে টিকতে হত না।"
আমি কি বলেছিলাম এখানে আসতে? বিয়েটা করেছে কে .... আমি না তুমি?
রোজ সকালে এই প্রশ্নে আমি চুপ করে যাই। সব কিছুর শেষ এই কথায় ... মেয়ে দেখতে যাওয়া ছাড়া সব কিছু আমিই প্রথম করেছিলাম। বিয়ের জন্য প্রথম লাফ টা আমিই দিয়েছিলাম। যৌবন জ্বালায় আর এত বাসন মাজার ঠ্যালায় কুপোকাত হয়ে আর পারছি না বলে শশুরের কাছে আর্জিটা আমিই নিয়ে গেছিলাম। তার পর, পর পর আমিই একের পর এক কাজ করে গেছি। সিন্দুর দেওয়া থেকে শুরু করে চাকরিঅলা বউ কে dependent   ভিসায় বিদেশে আনা পর্যন্ত সব। তাই এই একটি প্রশ্নে আমি চুপ।

আজকের টপিক টা কিন্তু এদেশে আসার জন্য নয়। লড়াই টাটকা আর বাসি নিয়ে। আমার গিন্নির একটু শাক পাতা টাটকা টাটকা খাওয়ার অভ্যেস। আমার শ্বশুরবাড়ির সামনে বাগান আছে। সাধারণ লোক হলে মরসুমী ফুলে ভরে যেত। কিন্তু আমার অসাধারণ শশুরবাড়ির বাগানে ফুটে থাকত থুড়ি ঝুলে থাকত টমেটো বেগুন লঙ্কা। আলো করে থাকত ঢ্যারোশ। ধনেপাতা সবুজের বন্যা ছড়িয়ে দিত। আর বিরাট বিরাট চাল কুমড়োর সাথে ঝুলে থাকত কালো কালো বেগুন। যখনই দরকার ঘ্যাঁচ করে কাস্তের কোপ পরত ... তারপর সোজা তেল এ।
              সেই অভ্যেস মত মাঝে মাঝেই গায়ের কাছে ঠেসে এসে সোহাগ সুরে বলে, "ওগো বাগানে একটা টবে লঙ্কা লাগালে কেমন হয়।" সোহাগের কারণ শুনে টেলি বেগুনে জলে, "কেন পেছনে গুঁজবে নাকি?" ব্যাশ আর যায় কোথায়। আবার শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমি এই আপত্তি কখনো সম্মতি তে পরিবর্তন করব না। আরে অনেক কিছু আছে লাগানোর। লঙ্কা দিয়ে প্রত্যেকবার শুরু করতে হবে?  অবশ্য ওর দোষ নেই। ভারতীয় লঙ্কা যেটা আক্ষরিক অর্থে ঝাল তা এখানে নিতান্তই দুষ্প্রাপ্য। এরা এখানে ঝাল বলতে গোলমরিচ বোঝে আর jalapeno নামক লঙ্কার মত দেখতে একটা সবজি কে ঝাল এর জন্য ব্যবহার করে। সেটার যেমন ঝাল ও নেই তেমনি নামেও গন্ডগোল। উচ্চারণ হলো হ্যালাপিনো। কারণ স্প্যানিশ এ J কে H এর মত উচ্চারণ করে।
সেই লঙ্কা আনতে যেতে হয় দু মাইল দুরে। এখানে বাথরুম করতে যেতেও গাড়ি লাগে। আর সেই গাড়ি কেনার এখনো সমর্থ হয়ে ওঠেনি। তাই যে সোমবার লঙ্কা শেষ হয়ে যায়। সেই সপ্তাহে আমার আর ঝাল ঝাল জিনিস খাওয়া জোটে না কারণ দু মাইল হাটতে হলে weekend  লাগে।
সে যা হোক। আজকের সকালে তুমুল লড়াইটা  শুরু হয়েছিল পালং শাক দিয়ে। এখানে ভুরি ভুরি ... থুড়ি ঝুরি ঝুরি .... থুড়ি .....প্যাকেট প্যাকেট পালং শাক পাওয়া যায়। টাটকা পালং শাকের দাম বেশি, তাই ফ্রোজেন শাক আনতে হয়। বউ সেই পালং শাক খেয়ে রোজ চিল চিত্কার করে। আমি খাদ্য বিলাসী বটে, কিন্তু আমার বউ এর মত জিভ আমার নেই। যে টাটকা বাশির এই সুক্ষ তফাত বুঝতে পারব। শুধু বুঝি কাঁচা থাকলে তেলে দিলে সেটা আবার টাটকা সবজি তে রুপান্তরিত হয়ে যায়। কিন্তু আমার গিন্নি তেলে দেওয়ার পরও বুঝতে পারে কোনটা টাটকা কোনটা বাসী।
সকালের চিত্কারটা কালকের রাত্রের মন কষাকষির ফল। কিন্তু কতক্ষণ আর একটা প্রশ্ন দিয়ে নিজের মুখ বন্ধ করা যায়। বলেই ফেললাম, "মুম্বাই তে তো জল কিনে খেতে। কুড়ি লিটার এর জল কিনে সাত দিন চালাতে।" "ওটা বিসলেরী। ওটা বাসী হয় না।" এতো পুরনোদিনের গঙ্গাজলে দোষ  হয়না কেস। বলে উঠলাম . "এখানেও তো সব ব্র্যান্ডেড। কিনে আনলেই হলো, প্যাকেট করা মাল।" "তুমি স্বাদের কি বোঝো। ডিপ ফ্রিজটাকে তো মর্গ বানিয়ে রেখে দিয়েছ। কোনো দিন দেখিনি বাপু একবার মাছ কিনে দু মাস ধরে খাওয়া যায়।কি স্বাদ পাও ওতে?"
"তাহলে আর কি। চৌবাচ্চায় জিওল মাছ পোসো। "

"আহা রে। একটা লঙ্কা গাছ লাগাতে বলেছি তাই নিয়ে এত কথা। সে আবার মাছ পুষবে। চৌবাচ্চা কি হ্যারি পটার দেবে?"
             আমার বউ আমাদের এপার্টমেন্ট এর ম্যানেজার কে হ্যারি পটার বলে। কারণ সব কিছু নাকি ম্যাজিক এর মত এনে দেয় আর তার কিছুদিন পরে রুল দেখিয়ে ভানিশ করে দেয়।
"তোমার কি লঙ্কা ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসে না? তুলসীও তো ভাবতে পারো।"
"হা আমি মরে গেলে তুলসী কাঠের মালা বানিয়ে পোরো । কোন রান্নায় তুলসী লাগে বলতে পারো ?"
"থাই রান্নায়।"
“তুমি কি থাই? তেলে তুলসি ফেললে তোমার মা তো সাগর পারে হার্টফেল করবে।”
"যস্মিন দেশে যদাচার কাছা খুলে নদীপার। "
"কাছা যদি খুলতেই হয় তাহলে একটা বাড়ি দেখো না যেখানে বাড়িতে লন আছে।"
"লন এ ঘাস হয় তোমাকে লঙ্কা করতে দেবে না।"
"তোমার সাথে তর্ক করা বৃথা। তোমায় তো আর হেসেল ধরতে হবে না। বেসি বললে তারপর বলবে এবার জিরে চাস কর। অতদিনের বাসী জিরে খাচ্ছ কেন? তোমার যুক্তি তর্ক পুরো ফালতু। "
"যখন ফালতু তখন এত কপচাচ্ছ কেন?"
"না কপচিয়ে যাব কোথায়? হ্যারি পটার এর ঘাস ছিড়ে তো আর রান্না করতে পারব না। যেখানে যাও শুধু কচি কচি ঘাস। আর কিছু নেই।"

এই ঝগড়ার অন্ত করতে একটা চাইনিস দোকান থেকে কিছু তুলসীর বীজ আর কিছু লঙ্কার বীজ নিয়ে এলাম। দুজনার কথাই  থাকলো। রাতেরে অন্ধকারে একটা খুঁটি নিয়ে বাইরে ঘাস জমি থেকে মাটি কেটে আনলাম। সকালে সুন্দর করে কুপিয়ে একটা ছোট বাটির মধ্যে সেই বীজ বপন করা হলো ভবিষ্যত ঝাল ঝাল স্বাদের স্বপ্নে।

এরপর শুরু হয়ে গেল প্রতিক্ষা। রোজ অফিস থেকে এসে উঁকি মেরে দেখি কোনো গাছ টুকি করছে কিনা। কিন্তু না, দশ দিন চলে গেল কালো মাটি কালই রয়ে গেল। কোনো সবুজের চিহ্ন নেই। একদিন অফিস থেকে ফিরে বসেছি , শুরু হয়ে গেল, "ওই কালো কালো বাসী বীজ গুলো থেকে কি আর কিছু হয়?" বীজ আবার বাসী কি করে হবে, "আমি কি করে জানব। দোকানটা তে সীড বলে আলাদা একটা সেকশন আছে সেখানে গিয়ে অনেক খুঁজে এই লঙ্কাটা পেলাম।"
"মেনে নাও তোমার দ্বারা কিছু হবে না। তার থেকে বাড়ির লঙ্কা কেটে বীজ ঢাললে কাজে দিত।"
"তো তাই করতে পরতে।"
"সেগুলোও তো মর্গে ফেলে ফেলে মেরে ফেলেছে। এই ছাতার মাথা দেশে আর থাকব না।"
"আরে এখানকার অর্গানিক গুলো খাও না কেন? ওগুলো তো টাটকা।"
"এক্স্পায়রী ডেট লেখা থাকে দেখনি? তার মানেটা কি? ততদিনে পুরো মেরে ফেলবে ফ্রীজে রেখে।"
"এরকম করলে তো টেকা যায় না। এখানে apple , অরেঞ্জ  ঝুলে থাকে, ওগুলো খাও। "
"কি বুদ্ধি।কি আমার ইংরেজ এসেছেন আপেল বা কমলালেবু বলতে কষ্ট হয়।  " ঝগড়ায় কি না চলে আসে, "আপেল দিয়ে মাছের ঝোল খাবে?  বল তো রেঁধে দি।"
"তাহলে উপায় তুমিই বাতলে দাও।"
"বিয়েটা কি আমি করেছিলাম না তুমি?"
          আবার চুপ। বিয়ের আগে আমার গিন্নি ইউনিভার্সিটি র question  সেটার ছিল। তার কথা বার্তা শুনেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রশ্ন তুলে ধরে। উত্তর তোমরা লেখ।

শেষমেষ একদিন মরিয়া হয়ে একটা বাঙালি হোলসেলার এর দোকানে গিয়ে মরিয়া হয়ে জিগ্গেস করলাম, "দাদা এখানে লঙ্কার বিচি কোথায় পাব।" ভদ্রলোক আমোদ নিয়ে বললেন, "কোথায় লাগাবেন?" পুরো নিরামিষ খাদ্যে আমিষ গন্ধ ভরে উঠলো। কিন্তু আমিও বেপরোয়া, "খুব ঝামেলায় পরেছি দাদা। বউ এর চাই টাটকা লঙ্কা , টাটকা টমেটো। কি করে যোগার করি বলুন তো। " আবার সেই হাসি, "কসরত করতে হবে।" কিছুক্ষণ এর কথায়  বুঝতে পারলাম কোনো উত্তর পাওয়ার আশা নেই। তাই চুপচাপ সরে পরলাম।
                দোকানটার সাথে লাগা একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে। ততক্ষণে আমার স্ত্রী ওয়েটার কে জিগ্গেস করে ফেলেছে , "পাঁচ দিনের কম বাসী কোনো জিনিস আছে কি?" ওয়েটার উত্তর দিল, " সবিই টাটকা বানানো হয় দিদি। সন্ধ্যে আট টার পর আসবেন, দেখবেন সব শেষ।" "আমি বলছি টাটকা সবজি দিয়ে বানানো কিছু আছে?" আমার স্ত্রী এর প্রশ্নে ম্যানেজার ছুটে এলো, "দিদি এটা আমেরিকা। টাটকা বলতে সবই দু তিন দিনের বাসী। এর থেকে বেশি কিছু যোগার করতে হলে ক্ষেতে যেতে হবে।আর অত দাম দিয়ে  সবজি কিনলেও আপনি তো অত দাম দিয়ে তরকারী কিনবেন না।"
অগত্যা বিদায়।
এই আলোড়ন চলছে চলবে ভাব নিয়ে দিনের পর দিন বেড়েই চলল। এক একটা বড়লোকের পার্টি তে যাওয়া হয় আর তাদের বাড়ির পেছনের লন এ ফলে থাকা চাল কুমড়ো আর নানা ধরনের সবজি দেখে রাতে প্রচুর গাতুনি খেতে হয়। আর রোজ আমার পিন্ডি চটকানো হয় টাটকা ভাবে।
                একদিন বাথ-টব এ বসে মন দিয়ে ভাবছি এর উপায়। আর স্বপ্নালু চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে কাকরা আর চিংড়ি। প্যাসিফিক এর ধারে থাকার এই একটা ভালো জিনিস। কাকরা প্রচুর। টাটকা। বললেই জল থেকে তুলে সোজা হয়  বেক করে দেবে নয় স্টিম করে দেবে। আমাদের স্বাদে জমে না তবুও টাটকা তো। কিন্তু এই উপায়ও উপায় নয় কারণ আমার স্ত্রী এর সেল - ফিস মানে খোলস ওয়ালা মাছে এলার্জি আছে। কখনো কখনো মনে হয় ভাবনা গুলো ভাবা এত সহজ কিন্তু এই  "কিন্তু " , "যদি" এই শব্দ গুলো সব কিছু কঠিন করে তোলে। বাথটবে স্বপ্ন ফ্লাশ করে চলে এলাম।
                "সত্যি বাপু বুঝি না। এত বড় সমুদ্র। টাটকা মাছ তো আনতে পারো। সবজি না হয় হলো না। মাছ ধরতে তো আর পয়সা লাগে না। " কি যে বলব, এই দেশে মাছ ধরতেও লাইসেন্স লাগে। সেটা যখন বললাম তখন উত্তর, "তা লাইসেন্স যোগার করলেই তো হয়।" কথাটা সত্যি কিন্তু লাইসেন্স যোগার করার কথাতেই সল্যুশন হয়ে গেল। নেট এ সার্চ মারতেই একটা জাপানীস সুপারমার্কেট এর নাম এসে গেল, যেখানে নাকি মাছ ধরার লাইসেন্স পাওয়া যায়।
                বউ কে ট্যাঁক এ গুঁজে দোকান টা  তে ঢুকতেই দেখি , এই তো টাটকা মাছের জায়গা। সারি সারি অকুঅরিউম এ কার্প , তিলাপিয়া, আরো কত কি মাছ ঘুরছে। কিনে নিলেই হয়। মেরে খেলেই হয়। একটা নৃসংশ প্রবৃত্তি তে মন টা ভরে গেল। বউ এর দিকে বিজয়ী মুখ নিয়ে তাকাতে দেখি শুকিয়ে গেছে।
"কি হলো এরকম শুকনো মেরে গেলে কেন?"
"এখানে তো সব দেখছি টাটকা মাছ।"
"হ্যা  তাই তো চাইছিলে তুমি। সামুদ্রিক মাছ আর তুলে খেতে হবে না। সব সুইট  ওয়াটার ফিস।"
"হ্যা সেটাও বটে।" একটা মন খারাপ করা আওয়াজ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে।
"কি হলো টা কি তোমার।"
"না কিছু নয়। মাছ গুলো কি সুন্দর লাগছে।"
মাছগুলো সত্যি সুন্দর লাগছিল। বড় বড় অকুঅরিউম এ বুদ বুদ কাটছে আর নিল জলে মাছ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেক মাছের নাম জানা নেই। কিন্তু মাছ গুলো দেখতে খুব সুন্দর। কি করে লোকে খায় জানা নেই। বলতে গেলে ইলিশ মাছের রূপও মনমহক কিন্তু দেখলেই জিভ লক লক করে ওঠে। আমি ঘুরে তাকালাম গিন্নির দিকে। দেখলাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোক গুলোর দিকে যারা একের পর এক মাছ তুলে যাচ্ছে অকুয়ারিয়াম থেকে আর পুরে দিছে একটা স্টিমার মেশিনে। বললাম, "কোনটা নেবে? তিলাপিয়া না সিলভার কার্প ?"
কোনো উত্তর এলো না। কিছু খন পরে বলল, "এই মাছ খেতে পারব না। চল।"
সেই থেকে গিন্নির আর টাটকা টাটকা বাতিক নেই। আর মাঝ খান থেকে আমার সব থেকে বড় লোকসান যে গিন্নি সপ্তাহে একদিন রান্না করে , আর পাঁচ দিন খাওয়ায়। ধীরে ধীরে আমিও বুঝতে শিখে গেলাম বাসীর স্বাদ কি?


-------------------------------------------------------------------------------
আগের ঝামেলা

No comments:

Post a Comment